করোনাভাইরাসের সংক্রমণ চলছে বিশ্বজুড়ে। মালয়েশিয়ায়ও ছড়াচ্ছে এ ভাইরাস। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা তিন হাজার একশ ষোল জন। মৃত্যুর সংখ্যা পঞ্চাশ।
Published : 03 Apr 2020, 12:54 PM
সংক্রমণ কমাতে পুরো মালয়েশিয়ায় লক ডাউন চলছে ১৮ মার্চ থেকে, লকড ডাউন থাকবে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। এ অবস্থায় দেশটিতে পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা কেমন আছেন জানতে চেয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে টেলিফোনে কথা হয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। তাদের কথাগুলোই এখানে তুলে ধরা হয়েছে।
খুলনার ছেলে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শেখ আরমান হোসেন। তিনি জানান, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যারা থাকেন সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রতিদিন তিনবেলা খাবারের প্যাকেট আবাসিক হলের প্রতিটি কক্ষে পৌঁছে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তাদের ক্যাম্পাসের ভেতরে থাকেন শতাধিক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। তারা সবাই সুস্থ আছেন।
‘বাংলাদেশি স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন মালয়েশিয়া’ (বিএসওএম) এর সভাপতি ইব্রাহীম হক চৌধুরী বলেন, “বর্তমানে মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রীরা কিছুটা আতঙ্কিত অবস্থায় রয়েছে। এর মূল কারণ হচ্ছে দীর্ঘসময় মালয়েশিয়ায় ‘মুভমেন্ট কন্ট্রোল অর্ডার’ (এমসিও) জারি করা হয়েছে, যার ফলে সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ, খাবারের দোকান এবং পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের যে কাজকর্ম থাকে সেসব কিছু বন্ধ থাকায় কিছুটা আতঙ্কিত অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে যেসব শিক্ষার্থী একাই রয়েছেন এবং যারা মালয়েশিয়ায় এসেছেন বেশিদিন হয়নি তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা বেশি দেখা যাচ্ছে।
মালয়েশিয়া সরকার তাদের নাগরিকদের জন্য বিশেষ প্যাকেজ সুবিধা ব্যবস্থা করলেও ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের ক্ষেত্রে কোন ধরনের সুযোগ-সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, যার ফলে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের নিজস্ব ইউনিভার্সিটির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। আমাদের কাছে আসা তথ্য অনুযায়ী, কিছু পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সব ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিশেষ কিছু সুবিধা দিচ্ছে। তারা হোস্টেলে অবস্থানরত সব ছাত্র-ছাত্রীদের খাবার নিশ্চিতকরণ এবং সেইসঙ্গে হাত খরচ হিসেবে ১০০ রিঙ্গিত থেকে ৩০০ রিঙ্গিত পর্যন্ত দিচ্ছে। তবে এমন ইউনিভার্সিটির সংখ্যা কম।
ইব্রাহিম বলেন, “খোঁজ নিয়ে জেনেছি চলমান এ মুভমেন্ট কন্ট্রোল নির্দেশে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সেমিস্টার পেছানোর পরিকল্পনা করছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের কার্যক্রম বন্ধ বা স্থগিত করে দিয়েছে, এমতাবস্থায় বেশ বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা। ক্লাস, পড়াশোনাবিহীন দীর্ঘ সময় গৃহবন্দি থেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে অনেকেই। তারা বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন আমাদের যেন অচিরেই সরকারের বিশেষ উদ্যোগে এদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়।”
‘বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন ইউনিভার্সিটি পুত্রা মালেয়শিয়ার’ ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহ আহমেদ রেজা বলেন, “একটা অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে আমারা সবাই এগিয়ে যাচ্ছি। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর এখনও কোন সমস্যার সম্মুখীন হতে না হলেও ভবিষ্যতে প্রয়োজনীয় খাবারের দরকার হতে পারে। আমাদের ইউনিভার্সিটি থেকে খাবারের কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু সবাইকে বিশেষ করে সব বিদেশি শিক্ষার্থীদের খাবার পৌঁছে দেওয়া কর্তৃপক্ষের জন্য কষ্টসাধ্য। তাই আমাদের মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত দায়িত্বশীল সমাজ ও বাংলাদেশ হাই কমিশনের প্রতি আমাদের অনুরোধ রইল যে প্রত্যেকটি ইউনিভার্সিটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু সাহায্য দেওয়ার।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন ইউনিভার্সিটি পুত্রা মালেয়শিয়ার পক্ষ থেকে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে আমরা ঘরে আবদ্ধ অবস্থায় আছি। আমাদের এ সময়টুকু যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য একটি শিক্ষণীয় প্লাটফর্মের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেখানে সবাই বিনামূল্যে তাদের সময়টুকু ভার্চুয়াল ক্লাসের মাধ্যমে সঠিকভাবে নামাজের নিয়ম, ভিডিও ও গ্রাফিক্স এডিটিং, মেডিটেশেন ও শরীরচর্চা ইত্যাদি শিখতে পারবে।”
শাহ আহমেদ রেজা জানান, মালয়েশিয়ার এ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দুইশ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী, তারা সবাই ভালো আছেন। এখন পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়ায় কোন সমস্যা হয়নি কারো। তবে এ লকড ডাউন অবস্থায় নতুন মাস এপ্রিল কেমন যাবে তা এখনো বলা যাচ্ছে না। এই মুহূর্তে কেউ দেশে যেতে চায় না, কারণ এখন মুভ না করলে নিজের জন্য ও দেশের জন্য মঙ্গল হবে বলে মনে হয়।
ইউপিএমের আরেক শিক্ষার্থী তাহিয়া ইসলাম পরিবারের সঙ্গেই থাকেন মালয়েশিয়ায়। তিনিও বন্ধুদের খোঁজখবর রাখেন নিয়মিত। জানালেন সবাই সুস্থ আছেন।
চাঁদপুরের ছেলে লিমককউইন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি জানান, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি ক্যাম্পাসে অধ্যয়নরত প্রায় আড়াইশ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী সুস্থ আছেন। তারা অনলাইনে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।
ইউপিএসআই থেকে ময়মনসিংহের ছেলে নেছার উদ্দিন সোহাগ বলেন, “আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বাংলাদেশি ভালো আছে, আমাদের সবাই সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। এই মুহূর্তে কেউ দেশে যেতে চাই না। কারণ, দেশে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের ভোগান্তিতে ফেলতে চায় না কেউ। তাই এই কঠিন সময়ে যে যেখানে আছে সেখানে থাকাই ভালো মনে করি।”
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থী সবচেয়ে বেশি আছে ‘আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়ায়’ (আইআইইউএম)। সেখান থেকে কিশোরগঞ্জের ছেলে মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ বলেন, “করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আগামী জুন পর্যন্ত সব ধরণের অ্যাকাডেমিক কার্যকলাপ স্থগিত করেছে। এ অবস্থায় আমারা পাঁচ-ছয়শ বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রী এখানে আছি। আশার কথা হলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের খোঁজ খবর নিচ্ছে এবং তিন বেলা ফ্রি খাবারের ব্যবস্থা করছেন।
“তবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লম্বা ছুটি দেওয়ার কারণে সবার মাঝে একঘেয়েমি সৃষ্টি হচ্ছে এবং অনেকেই দেশে চলে যেতে চাচ্ছেন। এজন্য সবাই বাংলাদেশ হাই কমিশনের সাহায্য কামনা করছে। কিন্তু আমার মত হলো, এই পরিস্থিতিতে আমাদের এখানেই কিছুদিন থাকা দরকার। যেহেতু বাংলাদেশ সরকার থেকেও একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে, সেজন্য আমরা প্রবাস থেকে দেশে যাওয়াটা যুক্তিযুক্ত বলে মনে হচ্ছে না। পরিস্থিতি ভালো হলে দেশে যাওয়া দরকার আমি মনে করি।”
আইআইইউএম এর আরেক শিক্ষার্থী ঢাকা আদাবরের ছেলে সাইদ সাদী। তিনি বলেন, “লকড ডাউনে এখানের বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা আলহামদুলিল্লাহ ভাল আছেন। ভার্সিটি থেকে পর্যাপ্ত পরিমান ফ্রি খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। ভার্সিটির কিছু খাবারের ক্যান্টিন এবং সুপারশপ খোলা আছে, তাই কারো তেমন বাইরে যাওয়ার প্রয়োজনও হচ্ছে না। ভার্সিটির সিকিউরিটি এবং মেডিকেল টিম সার্বক্ষণিক নজরদারি করছে। সব দিক মিলিয়ে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না।”
শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি কথা হয় মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ মেহেদী মাসুদের সঙ্গে। তিনি টেলিফোনে বলেন, “ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের কিছু পদক্ষেপের কথা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করছি। যে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীরা হলে অবস্থান করছেন, লোকাল কিংবা ইন্টারন্যাশনাল সবাইকে তিনবেলা খাবার ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করছেন। আর যারা হলের বাইরে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে থাকেন তাদের জন্য শুকনো খাবার পৌঁছে দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। যেমন চাল, নুডলস, চা, কফি, টুনা, ড্রিঙ্কস ও বিস্কিট ইত্যাদি।
“অবশ্য উপরে উল্লেখিত সহযোগিতা পেতে হলে ছাত্র-ছাত্রীদের অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে যেটা ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ শুরুতেই জানিয়েছে। এখন কেউ যদি রেজিস্ট্রেশন না করে বলেন কর্তৃপক্ষ আমাদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন না এটা তাদের ব্যর্থতা।”
মেহেদী মাসুদ আরও বলেন, “মালয় ইউনিভার্সিটি ১৮ মার্চ থেকে ২৬ এপ্রিল সব ফিজিক্যাল এবং অনলাইন ক্লাস বন্ধ ঘোষণা করেছে। ২৭ এপ্রিল থেকে ২৮ জুন পর্যন্ত অনলাইন ক্লাস এবং ১২ জুলাই পর্যন্ত অনলাইন ফাইনাল এক্সাম চলবে। লক ডাউন সময়টাকে পুষিয়ে নেবার জন্য এই সেমিস্টার ১২ জুলাই পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
তিনি বলেন, “কেউ কেউ বলছেন জুন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করা হয়েছে তাদেরকে বিনয়ের সঙ্গে বলছি, ইউনিভার্সিটি বন্ধ করা হয়নি, ইউনিভার্সিটির কার্যক্রম একটা ফর্ম থেকে অন্য একটা ফর্মে শিফট করা হয়েছে। আমাদের আরও একটা জিনিস মনে রাখা দরকার, শুধু ক্লাস হলেই ইউনিভার্সিটি খোলা আর ক্লাস না হলেই ইউনিভার্সিটি বন্ধ বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রতিনিয়ত অনলাইন মিটিং হচ্ছে, আমাদের রিসার্চের কাজ হচ্ছে, অনলাইন ক্লাস নিচ্ছি, অনেক কাজই আমরা অনলাইনে করছি।”
“আমার জানা মতে, মালয় ইউনিভার্সিটি শতাধিক বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রী আছেন। আলহামদুলিল্লাহ তাদের সবাই সুস্থ এবং নিরাপদে আছেন। এই মুহূর্তে কোনো ছাত্র-ছাত্রী দেশে যেতে আগ্রহী নয়। বরং অনেকেই বলেছেন তারা এখানেই ভালো আছেন। কিন্তু কেউ নিজ দেশে যেতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাধা দেবে না।”
এদিকে লক ডাউনে মালয়েশিয়ায় শিক্ষার্থীসহ সব পেশার আটকে পড়া বাংলাদেশিদের মধ্যে যারা দেশে ফেরত আসতে চান তাদের ফেরত আনার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে হাই কমিশনের পক্ষ থেকে। এ বিষয়ে হাই কমিশনের ফেইসবুক পেইজে একটি বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়েছে।
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |