ছাত্রনেতা ছিলেন, একটি রাজনৈতিক দল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন, হয়েছিলেন সংসদ সদস্য-মন্ত্রী, নানা ঘটনায় বিতর্কিতও হয়েছেন; তবে সব কিছু ছাপিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ‘ইশতেহার’ পাঠকারী হিসেবে ইতিহাসে থেকে যাবেন শাহজাহান সিরাজ।
Published : 15 Jul 2020, 12:22 AM
মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা পর্বের সাক্ষী শাহজাহান সিরাজ দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভুগে মঙ্গলবার মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর।
মৃত্যুর সময় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানের পদে ছিলেন শাহজাহান সিরাজ; তবে তার রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছিল অন্য মেরুতে।
১৯৪৩ সালের ১ মার্চ টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে জন্ম নেওয়া শাহজাহান সিরাজ গত শতকের ষাটের দশকে ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনীতিতে যুক্ত হন।
১৯৬৪ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত টাঙ্গাইলের করটিয়া সাদত কলেজ ছাত্র সংসদের দুই বার ভিপি নির্বাচিত হন তিনি। এরপর ঢাকায় এসে ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের পর উত্তাল সময়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্বের পর্যায়ে চলে আসেন।
মুক্তিযুদ্ধের আগে ১৯৭০ সালে তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
তখন ছাত্র আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে ছাত্রলীগের যে চারজনকে ‘চার খলিফা’ বলা হত, তাদের একজন হলেন শাহজাহান সিরাজ।
১৯৭১ সালের শুরুতে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে ৩ মার্চ ছাত্র সমাজের পক্ষে স্বাধীনতার ইশতেহার পড়েছিলেন শাহজাহান সিরাজ।
তখন ‘চার খলিফা’র অন্য তিনজন ছিলেন ডাকসুর তখনকার ভিপি আ স ম আবদুর রব, ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী এবং ডাকসুর তৎকালীন জিএস আবদুল কুদ্দুস মাখন (প্রয়াত)।
একাত্তরের ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো রব সহযোদ্ধা শাহজাহান সিরাজের মৃত্যুতে ব্যথাতুর মনে স্মরণ করেন সেদিনের ঘটনা।
রব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে স্বাধীন দেশের জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচনের যে পরিকল্পনা হয়েছিল, সেই পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন শাহজাহান সিরাজ।
“ঐতিহাসিক তেসরা মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের লক্ষাধিক মানুষের জনসভায় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শাহজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। সেই ইশতেহার পাঠের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার কর্মসূচি ও আন্দোলন কীভাবে পরিচালিত হবে, সেটাও তিনিই পাঠ করেন। মুহুর্মুহু করতালি আর জনতার শ্লোগানে মুখর হয়ে গিয়েছিল পল্টন ময়দান।”
ঊনসত্তরের গণআন্দোলন পরবর্তী সময়ে শাহজাহান সিরাজের ভূমিকা স্মরণ করে রব বলেন, “শাহজাহান সিরাজ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে অসীম সাহসী সংগ্রামী হিসেবে আমার সাথে ছাত্র ও যুব সমাজকে সংগঠিত ও তাদের মাঝে স্বাধীনতার মন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভুমিকা রাখে। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে থাকার কারণেই সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের সাথে তিনি যুক্ত হন।
“১৯৬৬ থেকে শুরু করে ’৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত শাহজাহান সিরাজ, সৈয়দ স্বপন চৌধুরী ও আমি -আমরা তিনজন পাগলপারা হয়ে ঢাকা মহানগরীতে ছাত্রলীগ ও সাহসী নেতা-কর্মীদের সংগ্রহ করেছিলাম। সেই এক বিশাল ইতিহাস। কীভাবে মুক্তিপাগল ছাত্র-যুবাদের আমরা সংগ্রহ করেছি, তা এই মুহূর্তে আমি বলতে পারব না।”
শাহজাহান সিরাজকে স্মরণ করে ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ফেইসবুকে লিখেছেন, “স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক, মুক্তিযুদ্ধের গর্বিত সংগঠক জনাব শাজাহান সিরাজ মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি ইহজগত হতে পরলোকে গমন করলেও স্বাধীনতা যুদ্ধ সংগঠনের গৌরবে চিরঞ্জীব ও কালজয়ী মহান নেতা হিসেবে তিনি অমর হয়ে থাকবেন।”
মুজিব বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন শাহজাহান সিরাজ।
স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগে ভাঙনে আলাদা হয়ে যান চার ‘খলিফা’; নূরে আলম সিদ্দিকী ও মাখন থাকেন আওয়ামী লীগে; আর রব-সিরাজ ভেড়েন জাসদে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীকালে গঠিত আলোচিত দল জাসদের সহ সাধারণ সম্পাদক হন শাহজাহান সিরাজ। তখন তাকে কিছু দিন কারাগারেও থাকতে হয়েছিল।
আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য নূরে আলম সিদ্দিকী লিখেছেন, “রাজনীতিতে মতের ভিন্নতা থাকলেও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি আমার সহোদরপ্রতিম ছিলেন।”
স্বাধীনতার পর ঘটনা প্রবাহের প্রসঙ্গ টেনে রব বলেন, “স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠনে ও আন্দোলন-সংগ্রামে শাহজাহান সিরাজ বিশাল ভুমিকা রেখেছেন।”
আবেগপ্রবণ হয়ে রব বলেন, “আমি আর শাহজাহান সিরাজ এক আত্মা। সবাই জানে আমরা দু‘জন নয়, আমরা একজন। সে আমার আন্দোলন-সংগ্রামের সাথী, আমার অনুভূতি, আমার চেতনার অংশ।”
পরে সেই জাসদে দেখা দেয় ভাঙন; গত শতকের ৮০ এর দশকে এরশাদের কাছে ভেড়া রবের সঙ্গে শাহজাহান সিরাজের দ্বন্দ্ব দেখা দিলে আলাদা হয়ে যান তারা। দুজনে দুই জাসদ নিয়ে চলতে থাকেন।
শাহজাহান সিরাজের বাড়িতে তার কক্ষটির পাশে ছোট একটা পাঠাগার কক্ষ দেখা যায়। সেখানে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের নানা বইয়ের পাশাপাশি চীন, কিউবা, রুশ বিপ্লবের উপর বিভিন্ন বই দেখা যায়। রয়েছে নানা উপন্যাস, কবিতার বইও।
জাসদে ভাঙনের শুরুতে শাহজাহান সিরাজের সঙ্গে ছিলেন হাসানুল হক ইনু; পরে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাঁধলে ইনু আলাদা জাসদ গড়েন। তখন অনেকটা একা হয়ে পড়েন শাহজাহান সিরাজ।
ওই সময় সব দলের বর্জনের মধ্যে এরশাদের অধীনে ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে তার অংশগ্রহণও সমালোচনায় পড়ে। তার আগে ১৯৭৯ ও ১৯৮৬ সালে তিনি জাসদের হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
রাজনীতির শেষজীবনে বাম আদর্শের বিপরীতে হেঁটে ১৯৯৫ সালে বিএনপিতে যোগ দেন শাহজাহান সিরাজ।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত সংসদ নির্বাচনে বিএনপির হয়ে অংশ নিয়েছিলেন তিনি, পরে ২০০১ সালে আবারও ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচিত হন।
২০০১ সালে খালেদা জিয়া সরকার গঠন করলে বন ও পরিবেশমন্ত্রী করা হয় শাহজাহান সিরাজকে। তখনই বাংলাদেশে পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরিবেশ রক্ষায় যে সিদ্ধান্তটি ছিল প্রশংসিত। বায়ু দূষণ কমাতে টু স্ট্রোক অটোরিকশা নগরীতে বন্ধ করাও হয়েছিল ওই সময়ে।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে অনেক রাজনীতিকের সঙ্গে গ্রেপ্তার হন শাহজাহান সিরাজ। তখন দুর্নীতির মামলায় তার সাজার রায়ও হয়েছিল।
শাহজাহান সিরাজের স্ত্রী রাবেয়া সিরাজও তখন মামলায় জড়িয়েছিলেন। রাবেয়া বিএনপির সহযোগী সংগঠন মহিলা দলের নেত্রী থেকে পরে কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ তাঁতী বিষয়ক সম্পাদকও হয়েছিলেন।
সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে কিছু দিন কারাগারে থেকে মুক্তি পেলেও অসুস্থতার কারণে আর রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারেননি শাহজাহান সিরাজ। বাসা ও হাসপাতাল মিলিয়ে কেটেছে তার শেষ দিনগুলো।
গুলশানের ২৩ নম্বর সড়কের ২৮ নম্বরের বাড়ির চতুর্থ তলায় তার এপার্টমেন্টে গিয়ে দেখা যায়, যে কক্ষটিতে তিনি থাকতেন, সেখানে হুইল চেয়ার, ঔষধপত্র এখনও রয়েছে।
শাহজাহান সিরাজকে হারিয়ে রব বলেন, “যতদিন আমাদের স্বাধীনতা, জাতির অস্তিত্ব, পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত থাকবে ততদিন শাহজাহান সিরাজ বেঁচে থাকবে বাঙালির হৃদয়ে।”
মতাদর্শের দূরত্ব তৈরি হলেও নূরে আলম সিদ্দিকী মনে করেন, শাহজাহান সিরাজ তার ‘যথাযথ’ সম্মান-স্বীকৃতি জীবদ্দশায় পেয়ে যাননি।