বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এখনও দর্শক হৃদয়ে রাজার আসনে রয়েছেন রাজ্জাক। অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে তিনি প্রিয় নায়ক, প্রিয় অভিনেতা।
Published : 23 Jan 2015, 01:55 PM
‘নীল আকাশের নীচে’, ‘স্বরলিপি’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘এতটুকু আশা’, ‘রংবাজ’, ‘বাঁদী থেকে বেগম’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘আলোর মিছিল’, ‘অবুঝ মন’, ‘আনারকলি’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘অশিক্ষিত’, ‘দুই পয়সার আলতা’সহ অসংখ্য সুপারহিট ছবিতে অভিনয় করে বাংলাদেশের দর্শকদের মনে নায়করাজের আসন অধিকার করে নেন রাজ্জাক।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের এই কিংবদন্তি অভিনেতার জন্ম ১৯৪২ সালের ২৩শে জানুয়ারি অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। তার পুরো নাম আবদুর রাজ্জাক। নাকতলায় ছিল তাদের পারিবারিক বাসস্থান। শৈশবেই তিনি বাবা-মাকে হারান। টালিগঞ্জের খানপুর হাইস্কুলে তিনি পড়তেন। স্বরস্বতী পূজা উপলক্ষ্যে স্কুলের নাটকে অংশ নেন রাজ্জাক। সে সময় তিনি সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। স্কুলের নাটকে এক গ্রামীণ কিশোরের চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। সেটি ছিল নাটকটির কেন্দ্রীয় চরিত্র। তার অভিনয় সে সময়ের নামকরা অভিনেতা ছবি বিশ্বাসকে মুগ্ধ করেছিল। কলকাতায় কলেজে পড়ার সময় তিনি ‘রতন লাল বাঙালি’ নামে একটি সিনেমায় অভিনয় করেন। তার লক্ষ্য ছিল চলচ্চিত্রে নায়ক হওয়া। তাই ১৯৬১ সালে পাড়ি জমান মুম্বাইতে। সেখানে ফিল্মালয়ে কিছুদিন সিনেমা বিষয়ে পড়াশোনা করেন। মুম্বাই থেকে ফিরে তিনি কলকাতার ‘পংকতিলক’ এবং ‘শিলালিপি’ নামে দুটি সিনেমায় অভিনয় করেন। কিন্তু কলকাতায় তখন উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো নায়করা রূপালি পর্দায় রাজত্ব করছেন। এদিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতিও খুব একটা অনুকূলে ছিল না। ১৯৬৪ সালে তো রীতিমতো হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাই লেগে গেল।
১৯৬৪ সালে টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হলে তিনি সেখানে অভিনয়ের সুযোগ পান। তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে ধারাবাহিক নাটক ‘ঘরোয়া’য় অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল চলচ্চিত্রে অভিনয় করা। আবদুল জব্বার খানের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে কাজ করার সুযোগ পান তিনি। নায়ক হিসেবে নয়। সহকারী পরিচালক হিসেবে। কামাল আহমেদ পরিচালিত ‘উজালা’ সিনেমায় তিনি সহকারী পরিচালকের কাজ করেন। পরে সালাউদ্দিন প্রোডাকশনের ‘তেরো নাম্বার ফেকু ওস্তাগার লেন’ সিনেমায় ছোট একটি ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ পান। ছবিটির পরিচালক ছিলেন বশীর হোসেন। এর পর ‘ডাকবাবু’, উর্দু ছবি ‘আখেরি স্টেশন’সহ কয়েকটি সিনেমায় ছোট ছোট ভূমিকায় অভিনয় করেন। জহির রায়হানের চোখে পড়ে রাজ্জাকের সুন্দর চেহারা এবং বাচনভঙ্গি। তিনি ‘বেহুলা’ সিনেমায় লখিন্দরের ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ দিলেন তাকে। বিপরীতে ছিলেন সুচন্দা।‘বেহুলা’ ব্যবসাসফল হওয়ায় আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
সুদর্শন রাজ্জাক তার প্রমিত উচ্চারণ ও সুঅভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকপ্রিয়তা পান। প্রথমদিকের ছবিতে তার বিপরীতে নায়িকা ছিলেন সুচন্দা। ‘আনোয়ারা’, ‘সুয়োরাণী-দুয়োরাণী’, ‘দুইভাই’, ‘মনের মতো বউ’- এমনি অনেক সিনেমাতেই তার বিপরীতে ছিলেন সুচন্দা। জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে তার ও সুচন্দার জুটি দর্শক দারুণভাবে গ্রহণ করে।
রাজ্জাক-ববিতা জুটিও দারুণ জনপ্রিয়। ‘পিচ ঢালা পথ’, ‘স্বরলিপি’, ‘কি যে করি’, ‘টাকা আনা পাই’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘বাঁদী থেকে বেগম’, ‘আনার কলি’, ‘বাজিমাত’, ‘লাইলি মজনু’, ‘নাতবউ’সহ অনেক ব্যবসাসফল সিনেমায় ছিলেন এই জুটি।
রাজ্জাক সবচেয়ে বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন শাবানার বিপরীতে। ১৯৭০ সালে ‘মধুমিলন’ ছবি দিয়ে রূপালি পর্দায় জুটি বাঁধেন তারা। তারপর ‘অবুঝ মন’, ‘সাধু শয়তান’, ‘মাটির ঘর’, ‘দুই পয়সার আলতা’সহ অনেক সিনেমায় অভিনয় করেছেন তারা।
প্রায় ১৬টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন তিনি। তাঁর নিজস্ব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নাম রাজলক্ষী। অভিনয়ের জন্য পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কারসহ অনেক সম্মাননা। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
২০১৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আসরে আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন। দশকের পর দশক ধরে বাংলা সিনেমার পর্দায় রাজত্ব করে যাওয়া রাজ্জাক আজও সত্যিকার অর্থেই ‘নায়করাজ’।