একুশে বইমেলায় ‘বান্ধবী’ নামে একটি বই লিখে আলোচনায় এসেছেন উঠতি ইউটিউবার ও উপস্থাপক রাবা খান। বাংলা-ইংরেজির মিশেলে বইটি লেখায় তাকে ঘিরে সমালোচনাও চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। বিষয়টি নিয়ে তৈরি হওয়ার কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর নিয়ে গ্লিটজের পাঠকদের সামনে হাজির হলেন তিনি।
Published : 06 Mar 2019, 09:41 PM
গ্লিটজ: ‘বান্ধবী’ বই থেকে পাঠকদের কাছ থেকে সাড়া কেমন পাচ্ছেন?
রাবা খান: ‘পাঠক’ বলতে আমি বুঝি, যারা আগ্রহ নিয়ে পুরো বইটি পড়েছেন কিংবা বইয়ের ৯টি গল্প থেকে ২-৩টি গল্প পড়ে ‘ট্র্যাশ’ বলে সরিয়ে রেখেছেন। আর ‘সাড়া’ বলতে বুঝি, আমার বই বা লেখার প্রতি সেই ভালোলাগা বা মন্দলাগার ব্যাপারটি।
যখন আমি এই সাক্ষাৎকারটি দিচ্ছি, তখন মাত্র ৯ দিন হলো বইটি বাজারে এসেছে। আমি মনে করি এখনও ‘পাঠকের সাড়া’ পাওয়ার সময় আসেনি। তবে সেই সাড়া পাওয়ার জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।
গ্লিটজ: বাংলা ও ইংরেজি মিশেলের কারণে বইটি নিয়ে অনেকে সমালোচনা করছে। ব্ষিয়টি নিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
রাবা খান: লেখালেখির জগতে আমি একদমই নতুন। তাই ইন্টারনেটের বাইরে এই প্রকাশিত বইয়ের বিশাল জগতে ‘অনেকে’ বলতে ঠিক কতজন বোঝায় বা আপনিই বা কতজন বোঝাচ্ছেন এটাই আমি এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। তবে হ্যাঁ, বেশ কিছু পাঠক (কারণ বইটি কেউ পাঠ না করে থাকলে জানার কথা না ইংরেজী-বাংলা মিশেলের বিষয়টি) আমার কাছে সরাসরিই জানতে চেয়েছেন এই বিষয়ে।
আমার অবস্থান খুবই পরিষ্কার-আমি মূলতঃ ‘হিউমার’ নিয়েই কাজ করি। তাই শুধু ভেতরে না, বইটির নামও ‘বাংলিশ’ করে আমি আমাদের ‘বাংলিশ’ প্রজন্মকেই এড্রেস করা বলেন বা একটু ক্লিন-স্যাটায়ার (ব্যাঙ্গ) করা বলেন; আমি সেটাই করার চেষ্টা করেছি।
লেখার কোয়ালিটি ঠিক করবেন পাঠক। এই বিষয়ে আমার কিছুই আসলে দাবি করার নেই। তবে আমি দেখেছি, যারা সত্যিকারের পাঠক তারা বইটি পড়েই সহজে বিষয়টি ধরে ফেলেছন। আবার আরও কিছু সত্যিকারের আবেগী পাঠক, যাদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হয়নি, তাদের ক্ষেত্রে হয়তো আমিই আমার হিউমারাস বার্তাটি পরিষ্কারভাবে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি।
কিন্তু বিষয়টি পরিষ্কার বলে নেওয়া ভালো- উনাদের আবেগের প্রতি আমি ততটাই শ্রদ্ধাশীল ঠিক যতটুকু আমার নিজের আবেগের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল!
আর ‘ব্যাংলিশ' নিয়ে আরেকটু বলি- আমি ইংরেজি হরফে যেমন বাংলা লিখেছি ওদিকে বাংলা হরফে কিন্তু ইংরেজি বা অন্যান্য ভাষা লেখা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরেই। এমন কী বইয়ের নামেও কিন্তু বাংলা ও ইংরেজী হরফ মিলিয়ে লেখা প্রচ্ছদে গেছে অনেক প্রধান লেখকের।
আমি কোনোমতেই নিজেকে উনাদের সমান দাবি করছি না। শুধু বলছি, এটা একেবারে নতুন কিছু নয়। দিন শেষে-বাংলা হরফে ইংরেজি বা ইংরেজি হরফে বাংলায় লেখা অংশ'অলা বই বাজারে নতুন কিছু নয়। শুধু তাই নয় বিশ্ব সাহিত্যেও ইংরেজির ভেতর যার যার ভাষাতে সংলাপ লেখা হয়েছে আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত বইগুলোতেও।
সঙ্গে আরেকটু যোগ করি, আমার বইটিতে কিন্তু ইংরেজি হরফে হিন্দিও লেখা আছে, কারণ সেই একই। আমাদের প্রজন্ম যে হিন্দির প্রতিও ঝুঁকে পড়ছে বাজেভাবে- সেটা উপস্থাপন ও ব্যঙ্গ করা।
তবে শেষ কথা, ওই যে বললাম- আমার হিসাবে আমি তো এখনও ‘সাড়া’ পাওয়াই শুরু করিনি-কাজেই প্রতিক্রিয়া দেবো কী?
রাবা খান: সত্যি কথা বলতে সেরকম ভাবে আমার কোনো ‘পরিকল্পনা’ ছিল না; তবে হ্যাঁ, ‘স্বপ্ন’ ছিল। সমস্যা হলো- অনলাইনের মতো অল্টারনেটিভ মিডিয়ার চাইতে মেইনস্ট্রিম বা মূলধারায় সাহিত্য বা যে কোন ধরণের লেখালেখি বা লেখক মানেই আমার কাছে বিশাল কিছু!
তবে অনলাইন জগতে আমার পরিচিতি বা সামান্য খ্যাতি যে ভিডিওগুলো দিয়ে হয়েছে সেগুলো দেখলেই বুঝবেন আমার সব কাজেই মূখ্য হলো অবজার্ভেশনাল কমেডি,অর্থ্যাৎ আমার আশেপাশে-কাছে-দূরে যা ঘটছে, যা দেখছি, পড়ছি বা ব্যস্ত থাকার ভান করে অপরিচিত মানুষের যে কথা আড়ি পেতে শুনছি-সেগুলো পর্যবেক্ষণ করে সেখান থেকে নানা টুকরো তুলে নিয়ে সেগুলোকেই কিছুটা ব্যাঙ্গ করে, কিছুটা মজা করে উপস্থাপন করা। আর সেই ঘটনাগুলোতে রং মাখিয়ে ‘কনটেন্ট’ হিসাবে তৈরী করতে কিন্তু আগে লিখতেও হয়। আবার উল্টো করে দেখলে লেখালেখির জায়গাটাতেও কিন্তু পর্যবেক্ষণ একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
তবে, আমার এই ‘বান্ধবী’ বইটির প্রস্তুত করার পুরো প্রক্রিয়া বা গল্পটা বেশ দীর্ঘ।
সাহিত্যের প্রতি সম্মান থেকেই - আমার কখনো সাহসই হয়নি যে দুম করে ‘লেখক’ হয়ে যাবো। গত বছর অগাস্ট মাসের দিকে এমনি এক হাসিখুশি আড্ডায় লেখক ও সাংবাদিক অনিক খান আমার নানা অভিজ্ঞতার গল্প শুনে বললেন, এগুলো নিয়ে একটা বই আকারে লিখে ফেলতে। মনে মনে আমার গল্পগুলো কখনও কোনো একদিন দুই মলাটের ভেতর ছাপা হবার স্বপ্ন আমার আগে থেকে থাকলেও তার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ার অভিনয় করলাম আর মনে মনে বললাম আপনি মাত্রই যে ‘নতুন’ আইডিয়াটা দিলেন, তার অনেক আগে থেকে এই আইডিয়া আমার মগজে ঘুরপাক খাচ্ছে; তবে তার মতো একজন ‘সম্মানিত বুড়ো লেখক’র সামনে আসল ঘটনা বললাম না! কারণ, আমার তো আসলেই কোনো ধারণা নেই কিভাবে বই প্রকাশ করতে হয়, তাই উনাকেই উনার ‘একদম নতুন আইডিয়া’ বুঝ দিয়ে সুযোগটা হাতছাড়া যেন না হয় তার প্রথম ধাপ পার হলাম।
তিনি বললেন, উনাকে কিছু লেখা পাঠাতে। আমি একটা ছোট গল্প পাঠিয়ে, অল্প দিনের ব্যবধানে আবার আড্ডায় বসে বইটির রকম-ধরণ নিয়ে আমার ও আমার ভাই ফাহাদের সব আইডিয়া-প্ল্যান বললাম। বইটির নাম যে অর্ধেক বাংলা অর্ধেক ইংরেজি হরফে হবে-সেটা থেকে শুরু করে সবকিছু।
অনিক খান সম্ভবত পছন্দই করলেন কারণ পুরোপুরি বাংলা সাহিত্যের মানুষ হয়েও তিনি ‘বাংলিশ’ বইটির সম্পাদক হতে রাজী হলেন-যেখানে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই বই সম্পাদনার অফার তিনি ফিরিয়ে দেন বলেই সবাই জানে। তবে তখনও তিনি ভালো-মন্দ বলেননি, শুধু ‘ইন্টারেস্টিং’ বলে, নানা যুগেই নানা ভাষার সাহিত্যে নানা রকম এক্সপেরিমন্ট হয়ছে বলে আমাকে কাজ এগিয়ে নেয়ার জন্য সাহস ও বলতে গেলে লাই-ই দিলেন।
কিন্তু অনিক খান আবার বর্ষাদুপুর প্রকাশনীর একজন অফিশিয়াল সম্পাদকও, তাই তিনিই প্রকাশককে রাজি করিয়ে, আমাকে সাহসে দিয়েই শেষমেষ বইটি লেখান। শেষমেষ বলছি কারণ অগাস্ট মাসে বইটির কাজে হাত দেবার পরেও বইটি বাজারে আসে পরের বছর ফেব্রুয়ারির ২৭ তারিখ!
এখন বই প্রকাশ হবার পর, আমার কাজের ক্ষেত্রে যারা অনেক আগেই বই লিখে ছাপিয়ে ফেলেছেন, তাদের কয়েকজন থেকে জেনেছি যে, দেশে বই প্রকাশের ক্ষেত্রে একটু জনপ্রিয় হলেই প্রকাশককে একটা পাণ্ডুলিপি ধরিয়ে দিলেই না কি বই ছাপা হয়ে বাজারে চলে আসে।
অথচ আমাকে শুধু বইয়ের লেখা কেন, একদম প্রচ্ছদের ডিজাইন, ছাপার ধরণ থেকে শুরু করে, ভূমিকা থেকে লেখক, বই পরিচিতি পর্যন্ত একজন সম্পাদকের কাঁচি পার হয়ে প্রকাশকের মতামত অনুযায়ী ও সম্মতিতেই বইটি বেড়িয়েছে!
এ কারণে আমাকে পরিশ্রম একটু বেশী করতে হলেও আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি দুইটি কারণে-
এক. আমি গর্ব করে বলতে পারি, একটি পরিপূর্ণ নিয়মের ভেতর দিয়েই আমার প্রথম বইটি প্রকাশিত হয়েছে।
দুই.বইটি নিয়ে কারো কোনো অভিযোগ থাকলে আমি সোজা আঙ্গুল তুলে বলে দিতে পারবো আমার কোনো দোষ নাই, সব দোষ ওই সম্পাদক অনিক খানের। (হাহাহাহা)
গ্লিটজ: প্রকাশের আগে ভেবেছিলেন কি না এমন সাড়া পাবেন?
রাবা খান: এখনও সত্যিকারের সাড়া পাবার অপেক্ষায় আছি।
গ্লিটজ: রকমারির বেস্ট সেলারের তালিকায় এসেছে ‘বান্ধবী’। বইটির এতো বিক্রির পেছনে প্রধান কারণ কী বলে মনে করেন আপনি?
রাবা খান: ‘এতো বিক্রি’র এই তথ্যটার পেছনের সূত্রটা আমি জানতে চাই। প্রকাশককে আমার সম্মানীর টাকা দেবার জন্য চাপ দেয়ার উদ্দেশ্যে। (হাহাহাহা)
রাবা খান: অবশ্যই আমার অনলাইন ফলোয়াররা বইটি কিনছেন তবে সেটা সামান্যই। আমি যে দুই দিন মেলায় গিয়েছি, বেশ কয়েকজন সিনিয়ার ক্রেতা বলেছেন তারা আমাকে চেনেন না, নামও শোনেননি কিন্তু বইটির উল্টেপাল্টে দেখে ভালো লেগেছে বলেই কিনেছেন। তাদের আগ্রহ শুধুমাত্র বইটি নিয়েই, অটোগ্রাফ বা সেল্ফি না তোলা পাঠক উনারা।
আমার ফেইসবুক ভিডিওজের ফলোয়ার হোক বা না হোক, প্রকৃত পাঠক যারা, তাদের হাতে বইটি পৌঁছাক এটাই আমার চাওয়া। শুধু সেল্ফি আর অটোগ্রাফের জন্য বইটি কিনে সেটা ফেলে না রেখে ক্রেতারা পড়বেন এটাও আমার আশা।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো-বই বিক্রির ক্ষেত্রে বেশ কিছু জায়গায় বইটি নাকি শুধুমাত্র টিন-এজারদের জন্য লেখা এমন ধারণা দিতে দেখেছি। এটা একেবারেই ভুল। মানে টিন-এজাররা তো বটেই, আমার এই বইটি মুরুব্বীরাও পড়বেন যারা আমাদের অর্থাৎ ‘মিলেনিয়াল জেনারেশন’-কে ঠিক চিনে উঠতে পারছেন না, তাদেরও আমাদের প্রজন্মের মনস্তত্বের বিষয়ে একটা ধারণা দেওয়াটাও আমার উদ্দেশ্য।
আবার কেউ যদি ভাবেন আমি আমার প্রজন্মকে খুব ভালো বলে এডভোকেসি করছি, সেটাও ভুল। আমি এই ‘বাংলিশ’ প্রজন্মের সঙ্গে আমাদের পূর্বের প্রজন্মদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি মাত্র।
আমি শুধুমাত্র ৯ রকম ৯টি মেয়ের ৯টা ‘গল্প’ বলেছি। বতর্মান সময়ের মুরুব্বীরা যেটাকে ‘ইয়ো কালচার’ বলেন, সেটাই দৃশ্যপট হিসাবে ব্যবহার করেই গল্পগুলো লিখেছি কিন্তু তারপরেই সেগুলো ‘গল্প’ই শুধু! অথচ কেউ কেউ ১০০ ভাগ আমার নিজের জীবনের সত্য ঘটনা ধরে নিয়ে আমার ‘ফিকশন’টাকে মোটামুটি ‘অটোবায়োগ্রাফি’ পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন! এটা করাও ঠিক না।
আরেকটু বলতে চাই- আমার যে কোনও একটা ফেইসবুক ভিডিও ধরুন যেখানে আমি হয়তো একটি বিশেষ ধরনের ‘আন্টি’দের নিয়ে বানিয়েছি। তারমানে কি আমি নিজেই সেই আন্টিগুলো? মোটেই না! তাই আশ্চর্য হচ্ছি যখন আমার ‘গল্প’গুলোকে কেউ কেউ ‘সত্য ঘটনা’ হিসাবে ধরে নিচ্ছেন!
গ্লিটজ: পরবর্তীতে আর কোনো বই লেখার পরিকল্পনা আছে?
রাবা খান: এই মুহূর্তে শুধু ‘বান্ধবী’ নিয়েই ভাবছি। পরবর্তীতে আবার ‘বন্ধু/ভাই/ভাবী/দুলাভই’ আসবে কী না তা নিয়ে আমি এখনও চিন্তা করছি না। তবে এতটুকু বলতে পারি আমার লেখার খাতায় বেশ কিছু গল্প জমে গেছে। এখন দেখার বিষয়- পাঠকের প্রতিক্রিয়া কেমন, আবারও সম্পাদক আর প্রকাশককে আমার লেখা দিয়ে খুশি করতে পারছি কি না; পারলে হয়তো আরেকটি বই বের হতেও পারে।
কিন্তু আমার বই প্রকাশের এমন সুন্দর একটি এক পা এক পা করে কয়েকটি স্তর পার হয়েই আমার বই বাজারে আসবে, সেটাই আমার চাওয়া। আমার চাওয়া এটাও যে সম্পাদক অথবা প্রকাশক একবার দুইবার আমার পাণ্ডুলিপি বই আকারে প্রকাশ যোগ্য না বলে ছাপবেন না, তাতে আমি আরো মনযোগী হয়ে আরও সিরিয়াসলি লিখবো। আমার জন্য দোয়া করবেন।