তানজিম-শরিফুল-সৌম্যর দুর্দান্ত বোলিংয়ে নিউ জিল্যান্ডের মাঠে স্বাগতিকদের বিপক্ষে প্রথমবার ওয়ানডে জয়ের স্বাদ পেল বাংলাদেশ।
Published : 23 Dec 2023, 07:37 AM
বাংলাদেশে যারা সকালে ঘুম থেকে উঠে পিটপিট করে তাকিয়েছেন টিভি পর্দায় বা অনলাইনে দেখেছেন স্কোর, তারা চমকে গেছেন নিশ্চিতভাবেই। অনেকেই হয়তো চোখ কচলে তাকিয়েছেন আবার। তার পরও মনে হতে পারে যেন ঘোরের মধ্যে আছেন কিংবা কোনো স্বপ্ন। ম্যাচের চিত্র এতটাই অবিশ্বাস্য! সকাল সাড়ে ৮টার দিকে যাদের ঘুম ভেঙেছে, তাদের তো আরও ধন্দে পড়ার কথা। টিভি খুলে দেখেছেন যে খেলাই নেই। থাকবে কীভাবে, ১০০ ওভারের ম্যাচ যে ৫০ ওভারের আগেই শেষ!
সবকিছুই আসলে অভাবনীয়। নিউ জিল্যান্ডকে তাদের মাঠেই ওয়ানডেতে হারিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ, এটিই যথেষ্ট অবাক করে দেওয়ার জন্য। তার পর সেই জয় যদি হয় কিউইদেরকে ৯৮ রানে অলআউট করে এবং ১ উইকেট হারিয়ে ১৫.২ ওভারেই সেই রান তাড়া করে, তাহলে তো বিশ্বাস করা কঠিনই!
নেপিয়ারে শনিবার এমন বিস্ময়ই উপহার দিয়েছে বাংলাদেশ। তানজিম হাসান ও শরিফুল ইসলামের অসাধারণ বোলিংয়ের পর সৌম্য সরকারের দুর্দান্ত সুইং বোলিং মিলিয়ে নিউ জিল্যান্ড গুটিয়ে গেছে ৯৮ রানে। বাংলাদেশ জিতেছে ৯ উইকেটে।
সিরিজ আগেই জিতে নিয়েছিল নিউ জিল্যান্ড। কিন্তু শেষ ম্যাচের এই জয়টি বাংলাদেশের জন্য অনন্য ও পরম আকাঙ্ক্ষিত। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে তাদের মাঠে টানা ১৮ ওয়ানডে হারার পর ধরা দিল প্রথম জয়!
এই পরাজয়ে শেষ হয়ে গেল কিউইদের আরেকটি গর্বের পথচলাও। দেশের মাঠে টানা ১৭ ওয়ানডে জয়ের পর হেরে গেল তারা। এই ম্যাচ জিততে পারলেই তারা ছুঁয়ে ফেলত অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বরেকর্ড।
কিউইদের তা করতে দেয়নি মূলত বাংলাদেশের পেস আক্রমণ। ম্যাকলিন পার্কের পেস সহায়ক উইকেটে ৭ ওভারে স্রেফ ১৪ রানে ৩ উইকেট শিকার করেন তানজিম, ২২ রানে ৩টি শরিফুল। কিউই ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ড ভেঙে দেন তারা দুজনই। পরে সৌম্য বোলিংয়ে এসে ৩ উইকেট নেন ১৮ রানে।
রান তাড়ায় সৌম্য শুরুর দিকেই ড্রেসিং রুমে ফিরে যান চোখের সমস্যায়। পরে এনামুল হক ও নাজমুল হোসেন শান্তর জুটি এগিয়ে নেয় দলকে। এনামুল শেষ পর্যন্ত না টিকলেও ঝড়ো ফিফটিতে দলের জয় সঙ্গে নিয়ে ফেরেন অধিনায়ক শান্ত।
উইকেটের হিসেবে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয় এটি। তাদের বিপক্ষে এত বল (২০৯টি) বাকি রেখে জয়ও আগে কখনও ধরা দেয়নি বাংলাদেশের।
বাংলাদেশ বোলিংয়ে নামে টস জিতে। তবে আগে বোলিং নেওয়ার সময় অধিনায়ক শান্ত নিজেও হয়তো ভাবতে পারেননি, এতটা সহায়তা থাকবে উইকেটে। ঘাসের ছোঁয়া থাকা উইকেটে সিম মুভমেন্ট মিলেছে। বাউন্স ছিল অসমান ও অধারাবাহিক। কিছু বল লাফিয়েছে টেনিস বলের মতো। তবে বাংলাদেশের পেসারদের কৃতিত্ব দিতেই হবে, উইকেটের সহায়তা পুরোপুরি কাজে লাগানোয়।
আগের ম্যাচে খরুচে বোলিং করা তানজিম এ দিন শুরু থেকেই ছিলেন ভিন্ন চেহারায়। সিম মুভমেন্ট ও সুইং তো আদায় করে নিয়েছেনই, সঙ্গে নিখুঁত লাইন-লেংথে বোলিং করে ব্যাটসম্যানদের নাভিশ্বাস তুলে ছেড়েছেন তরুণ এই পেসার।
শরিফুল প্রথম স্পেলে উইকেট না পেলেও দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে বিধ্বংসী বোলিংয়ে তিন উইকেট নেন টানা তিন ওভারে। সহায়ক উইকেটে পরে জেন্টল মিডিয়াম পেসের ঝলক দেখান সৌম্য।
প্রথম তিন ওভারে তিনটি বাউন্ডারিতে নিউ জিল্যান্ডের শুরুটা ছিল বেশ সাবলিল। এরপরই বাংলাদেশের পেস দাপটের শুরু। দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে রাচিন রবীন্দ্রকে ফিরিয়ে দেন তানজিম।
দুই প্রান্ত থেকে আঁটসাঁট বোলিংয়ে আটকে যায় রানের গতি। তানজিমের বোলিংয়ে হাঁসফাঁস করতে করতেই শট বানিয়ে খেলার চেষ্টায় উইকেট ছুড়ে দেন হেনরি নিকোলস।
প্রথম তিন ওভারে ১৫ রান তোলা নিউ জিল্যান্ড পরের সাত ওভারে তুলতে পারে কেবল ১২ রান।
তাদের বড় বিপদ অনুমান করা যায়নি তখনও। উইল ইয়াং ও টম ল্যাথাম লড়াই করে জুটি গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
এরপরই শান্তর দারুণ একটি সিদ্ধান্ত এবং শরিফুলের জ্বলে ওঠা। দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে প্রথম ওভারেই ল্যাথামকে বোল্ড করে দেন তিনি ভেতরে ঢোকা ডেলিভারিতে। জুটি থামে ৩৬ রানে।
একের পর ছোবল দিতেই থাকেন শরিফুল। তার পরের ওভারে গালিতে মেহেদী হাসান মিরাজের চমৎকার ক্যাচে বিদায় নেন ফর্মে থাকা ইয়াং। তার ২৬ রানই হয়ে থাকে নিউ জিল্যান্ডের ইনিংসের সর্বোচ্চ।
ইয়াংকে ফিরিয়ে ওয়ানডেতে ৫০ উইকেট পূর্ণ করেন শরিফুল। ৩৩ ম্যাচে মাইফলফলক ছুঁয়ে বাংলাদেশের তৃতীয় দ্রুততম তিনি। তার চেয়ে কম ম্যাচে করেছেন মুস্তাফিজুর রহমান (২৭) ও আব্দুর রাজ্জাক (৩২)।
শরিফুল এরপর ভেতরে ঢোকা দারুণ ডেলিভারিতে উড়িয়ে দেন মার্ক চ্যাপমানের বেলস। তার দ্বিতীয় স্পেল ছিল ৩-০-৬-৩!
অধিনায়ক শান্তর আরেকটি সিদ্ধান্তও এরপর কাজে লেগে যায়। তানজিমকে দ্বিতীয় স্পেলে আনতেই প্রথম বলে আউট হয়ে যান টম ব্লান্ডেল।
এরপর সৌম্যর পালা। তীক্ষভাবে ভেতরে ঢোকা ডেলিভারিতে তিনি বোল্ড করে দেন শেষ স্বীকৃত ব্যাটসম্যান জশ ক্লার্কসনকে। একটু পর তিনি বোল্ড করেন অ্যাডাম মিল্নকে।
মুস্তাফিজকে টানা দুটি বাউন্ডারি মেরে রান একটু বাড়ান আদিত্য আশোক। তাকে ফিরিয়েই সৌম্য ধরেন তৃতীয় শিকার।
বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে অভিজ্ঞ মুস্তাফিজই ছিলেন সবচেয়ে বিবর্ণ। তবে খালি হাতে ফেরেননি তিনিও। উইল ও’রোককে বোল্ড করে নিউ জিল্যান্ডকে একশর নিচে আটকান তিনি।
২০০৭ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৭৩ রানের পর এবারই এত কম রানে গুটিয়ে গেল কিউইরা।
রান তাড়ায় বাংলাদেশকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। শুরুতে যদিও একটু অস্বস্তিতে পড়েন সৌম্য ও এনামুল। এরপর চোখে কোনো একটি সমস্যা দেখা দেয় সৌম্যর। শুরুতে চোখে পানি দেন তিনি, এরপর ড্রপ ব্যবহার করতে দেখা যায়। তার পরও ঠিক না হওয়ায় মাঠ ছেড়ে যান।
বাংলাদেশের আশা তাতে শেষ হয়নি। কিউইদের এলোমেলো বোলিংর সঙ্গে এনামুল ও শান্তর দাপুটে ব্যাটিংয়ে ছুটতে থাকে রান। দলকে জয়ের কাছে নিয়ে শেষ হয় ৫০ বলে ৬৯ রানের জুটি। এনামুল ফেরেন ৩২ বলে ৩৭ করে।
তবে শান্তকে থামাতে পারেনি কিউইরা। ৮ চারে ৪২ বলে ৫১ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে জয়ের হাসিতে মাঠ ছাড়েন তিনি মাথা উঁচু করে।
সিরিজ শুরুর আগে শান্ত বলেছিলেন, নিউ জিল্যান্ডে এবার নতুন কিছু করতে চান তারা। সিরিজ হেরে গেলেও অন্তত একটি ম্যাচ জিতে কথা রাখলেন তিনি ও তার দল।
এরপর তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে মুখোমুখি হবে দুই দল। নেপিয়ারেই প্রথম ম্যাচ আগামী বুধবার।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
নিউ জিল্যান্ড: ৩১.৪ ওভারে ৯৮ (ইয়াং ২৬, রবীন্দ্র ৮, নিকোলস ১, ল্যাথাম ২১, ব্লান্ডেল ৪, চ্যাপম্যান ২, ক্লার্কসন ১৬ , মিল্ন ৪, আশোক ১০, ডাফি ১*, ও’রোক ১; শরিফুল ৭-০-২২-৩, তানজিম ৭-২-১৪-৩, মুস্তাফিজ ৭.৪-০-৩৬-১, সৌম্য ৬-১-১৮-৩, মিরাজ ১-০-৩-০, রিশাদ ৩-০-৪-০)।
বাংলাদেশ: ১৫.১ ওভারে ৯৯/১ (সৌম্য আহত অবসর ৪, এনামুল ৩৭, শান্ত ৫১*, লিটন ১*; মিল্ন ৪-০-১৮-০, ডাফি ৫-০-২৭-০, ক্লার্কসন ২-০-১৯-০, ও’রোক ৪-০-৩৩-১, আশোক ০.১-০-২-০)।
ফল: বাংলাদেশ ৯ উইকেটে জয়ী।
সিরিজ: ৩ ম্যাচ সিরিজে নিউ জিল্যান্ড ২-১ ব্যবধানে জয়ী।
ম্যান অব দা ম্যাচ: তানজিম হাসান।
ম্যান অব দা সিরিজ: উইল ইয়াং।