Published : 07 Jan 2017, 06:42 AM
গত কয়েক দিন আগে আমার এক পরিচিত লোক আমার কাছে এসে বলছে, দাদা দুইদিন পরে আমাকে ১০০০ টাকা ধার দিতে পারবেন? বললাম পারব, তবে কেন? কিসের জন্য আমাকে বলতে হবে। লোকটা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, ছেলে আর মেয়েটাকে স্কুলে ভর্তি করতে হবে তাই। লোকটা নারায়াণগঞ্জ শহরের রিকশা চালক, বাড়ি মতলব। এখানে অনেক বছর যাবত ভাড়া থাকে পরিবার পরিজন নিয়ে। ছেলে অষ্টম শ্রেণীতে আর মেয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। দুইজনের স্কুলে ভর্তির জন্য প্রয়োজন দুইহাজার টাকা। শহরে রিকশা চালিয়ে ছেলে-মেয়ের স্কুলে ভর্তির জন্য তীল-তীল করে কিছু জমানো টাকা নিজের কাছে আছে, বাদবাকিটা আমার কাছে চাচ্ছে হাওলাৎ। লোকটার হতাশা দেখে দিতে রাজী হয়েছি ঠিক, সে সাথে আমার পড়ালেখার কথা মনে পোরে গেলো।
আমার ছোটবেলায় শিক্ষার হাতেখড়ি কলাপাতা আর বাঁশের ছিঁপ। কলাপাতা হলো লেখার কাগজ, আর বাঁশের ছিঁপ হলো কলম। তখন একটা খাতা আর একটা কলম ছিল স্বপ্নে পাওয়া গায়েবী কিছু। স্কুলে ভর্তি ফি ছিল এক টাকা, সেও অনেক কিছু বিরাট ব্যাপার। প্রাইমারি স্কুলে একবার স্কুলে ভর্তি হলে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত আর কোন ভর্তি ফি'র দরকার হয় নাই। প্রাইমারি পাশ করার পর, হাই স্কুলে আবার নামমাত্র ভর্তি ফি দিয়ে ভর্তি হলেই হলো, একেবারে ম্যাট্রিক পর্যন্ত। আর এখন! প্রতি বছর বছর ভর্তি আর ভর্তি, ফি আর ফি। বর্তমানে আমাদের দেশে বছর শুরুতে দেখা যায় এই ভর্তি ফি'র আলামত। ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাস করলেও পুনরায় ভর্তি ফি দিয়ে তাকে ভর্তি হতে হবে, নয়তো সে আর তার প্রিয় স্কুলে প্রবেশ করতে পারবে না। এবাবও দেখা যায় এই আলামতের দৃশ্য, যা পত্র-পত্রিকায় চোখ রাখলেই দেখা যায়, পড়া যায় ভর্তি বাণিজ্যের খবর। এর সাথে আবার যোগ হয়ে যায় কোচিং বাণিজ্যের খবর।
সারাদেশের মত আমাদের নারায়ণগঞ্জেও বছরের শুরুতে শহরের বিভিন্ন এলাকার সরকারি-বেসরকারি স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই পৌঁছেছে। ছাত্র-ছাত্রীরা নতুন বই পেয়ে খুশিতে আত্মহারা, অনেক ছাত্র-ছাত্রীদের বই হাতে নিয়ে নাচতেও দেখা যায় স্কুলের মাঠে। অনেক স্কুলের অভিভাবক প্রতিনিধিরাও খুশির ঢাক-ঢোল বাজাতে দেখা যায়। তাদের এই খুশিতে কপালে হাত দিয়ে থাপড়াতে হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকদের, স্কুল কমিটির প্রতিনিধিদের হাঁসিতে ছাত্র-ছাত্রীদের বাবা-মায়ের আসে কান্না। কারণ; এই নতুন বইয়ের পিছনে আছে মোটা আংকের ভর্তি ফি, স্কুলের পোশাক-আশাক, নতুন জুতো সহ বহুকিছু। আর আছে ব্যাচ পড়ানো, আর কোচিং এ ভর্তির বিষয়। কোচিং এ ভর্তি না করলে তো পরীক্ষায় ফেল, এটা অনির্বায, আর ব্যাচে না পড়লে তো খেতে হবে বেঁতের বারি। এককথায় বোঝা যায়, পালাইবার পথ নাই যম আছে পাছে।
বর্তমানে দেশের সকল সরকারি-বেসরকারি স্কুলগুলোতে চলছে ভর্তি বাণিজ্য। গতবছর যেখানে ছিল ৭০০ টাকা ভর্তি ফি, এবার সেখানে ১০০০ টাকা, কোথাও কোথাও তার চেয়েও বেশি ১১০০ টাকা থেকে ১৬০০/১৭০০/২০০০/৩০০০ টাকা। নামীদামী স্কুলগুলোতে আরও বেশি। তাহলে একজন অভিভাবকের জন্য গলায় ছুঁড়ি ধরার শামিল। এরজন্য কোন প্রতিবাদ করতে গেলেও হয় বিপদ, তখন প্রতিবাদকারির সন্তানরা থাকে টার্গেটে। স্কুলে পড়া অবস্থায় ওইসব ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুল শিক্ষের অনুগত হতে পারেনা, তাঁরা থাকে শিক্ষকদের লাল চোখের দৃষ্টিতে। কারণ একটাই, কেন করল ভর্তি ফি নিয়ে বাড়াবাড়ি! তখন চলে অকারণে বেতের বারি, না হয় পরীক্ষায় ফেল।
এবিষয়ে একজন অভিভাবকের সাথে আলাপ করে জানা গেল যে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের করে দেয়া নীতিমালায় বর্ণিত নির্ধারিত ফি-ই আদায় কারা হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে, এর বেশি কিছু নয়। তিনি আরো বলেন, বছর বছর যদি সবকিছুর দাম বাড়তে পারে তবে ভর্তি ফি বাড়বে না কেন? ছাত্র-ছাত্রীদের বেতনের উপর-ই আমাদের স্কুলের খরচাদি আর মাস্টারদের বেতন। বললেন, অভিভাবক প্রতিনিধির একজন সদস্য। এরপর আমাকে তিন পৃষ্ঠা সংবলিত একটা কাগজ হাতে ধরিয়ে দিলেন ওই ওভিভাবক প্রতিনিধির সদস্য। নিম্নে তা ছবি আকারে দেখানো হলো।
নীতিমালার ১০ অনুচ্ছেদের (খ)
সেশন চার্জসহ ভর্তি ফি সর্ব সাকুল্যে মফস্বল এলাকায় ৫০০/- (পাঁচশত); পৌর(উপজেলা) এলাকায় ১০০০/- (এক হাজার); পৌর (জেলা সদর)এলাকায় ২০০০/- (দুই হাজের); ঢাকা ব্যতীত অন্যান্য মেট্রো পলিটন এলাকায় ৩০০০/- (তিন হাজার) টাকার বেশি হবে না।
এখানে গরীব ও নিঃস্ব মানুষের সন্তানদের জন্য কোন নীতিমালা প্রণয়ন কারা হয়নি। তাহলে গরীব মানুষের সন্তানেরা কি বছর বছর এত টাকা ভর্তি ফি দিয়ে পড়ালেখা করাতে পারবে? যদি আমার নিজের সন্তান এইদিনে শিক্ষার্থী হতো, আমি-ই বন্ধ করে দিতাম আমার ছেলে-মেয়ের পড়ালেখা। এমতাবস্থায় একজন রিকশা চালক কি এই ব্যবহুল খরচ করে সন্তানকে পড়ালেখা করাতে পারবে? সেই জবাব একজন গরীব মানুষের কাছেই পাওয়া যাবে। এরকম যদি বছরের পর বছর চলতে থাকে, তবে নিম্ন আয়ের মানুষের সন্তারা হয়তো কোন একদিন এদেশ থেকে শিক্ষা বঞ্চিত হয়ে পরবে। শুধু বিত্তবানদের সন্তানরাই স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করবে, গরিবের সন্তানরা নয়। তাই বলছিলাম, স্কুলে পড়বে ধনীর ছেলে, গরীবের ছেলে মাঠে কাটবে ঘাঁস।