উনিশশ নব্বই দশকের শুরুতে যখন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবিতে আন্দোলন তুঙ্গে, ঠিক তখনই বায়ান্নর ‘ভাষা সৈনিক’ হিসাবে শোনা যেতে থাকে জামায়াতে ইসলামীর তখনকার আমির গোলাম আযমের নাম।
Published : 15 Jul 2013, 03:53 AM
রাজধানী ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে সে সময় গোলাম আযমকে ‘ভাষাসৈনিক’ অভিহিত করে চিকা মারা হয়। ভাষা দিবস পালন করতে দেখা যায় একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতকেও।
ভাষা আন্দোলন গবেষক ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর বিষয়টিকে ব্যাখা করেন এভাবে, “১৯৭৮ সালে দেশে ফেরার পর যখন উনি (গোলাম আযম) দেখলেন ধর্মের কথায় আর সুবিধা হচ্ছে না, তখন ৯২ সালে নাগরিকত্ব নেয়ার আগে তিনি ভাষাসৈনিকের তকমা নিলেন। নিজেকে দাবি করলেন একজন ভাষাসৈনিক হিসাবে।”
ভাষা আন্দোলনের মতো একটি গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলনে নিজেদের সম্পৃক্ততা জাহির করাকে জামায়াতে ইসলামীর একটি সেই সময়ের একটি ‘রাজনৈতিক কৌশল’ অভিহিত করেন তিনি।
আর যে সূত্র ধরে জামায়াত সে সময় গোলাম আযমকে ‘ভাষাসৈনিক’ দাবি করে, তার প্রেক্ষাপটও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের কাছে তুলে ধরেন এই বাম নেতা।
তিনি বলেন, ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এক সমাবেশে ভাষণ দেন৷ সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) পক্ষ থেকে তাকে দেয়া একটি মানপত্রে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়৷
বদরুদ্দীন উমর বলেন, “ভাষাসৈনিক হিসাবে গোলাম আযমের দৌড় কিন্তু এ পর্যন্তই।”
আর সেটুকুও যে গোলাম আযম ‘অনেকখানি চাপে পড়ে’ করেছিলেন, তার প্রমাণ মেলে ১৯৭০ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শুক্কুরে গোলাম আযমের সম্মানে আঞ্জুমানে ইয়ারানে শক্করের উদ্যোগে এক সম্বর্ধনা সভায় তার দেয়া বক্তৃতায়।
সেখানে তিনি ভাষা আন্দোলনকে আখ্যায়িত করেন ‘মারাত্মক রাজনৈতিক ভুল’ হিসাবে।
১৯৭০ সালের ২০ জুন ‘বাংলা ভাষার আন্দোলন করা ভুল হইয়াছে’ শীর্ষক প্রতিবেদনে গোলাম আযমের সেই বক্তব্য প্রকাশিত হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার পঞ্চম পৃষ্ঠায়।
তাকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, “মুসলমানদের অধিকাংশ তমদ্দুন ও ধর্মীয় জ্ঞানের ভাণ্ডার উর্দু ভাষায় সংরক্ষিত আছে।”
জাতীয় ভাষার প্রশ্ন ওঠার পর পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলকারীদের মধ্যে তিনিও ছিলেন- তা উল্লেখ করে শ্রোতাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন গোলাম আযম। বলেন, “পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিকোণ থেকে তা মোটেও সঠিক কাজ হয়নি।”
ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর সম্পৃক্ততা প্রমাণের ‘রাজনৈতিক কৌশল’ প্রসঙ্গে ‘ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর ভেলকিবাজি’ শীর্ষক একটি নিবন্ধও লিখেছেন উমর।
তিনি বলেন, “এ কাজ তারা এখন আবার নতুন করে শুরু করেছে৷ সম্প্রতি তারা ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে৷ এর কভারে লেখা আছে ‘মাতৃভাষা বাংলা ভাষা খোদার সেরা দান’৷ সবকিছু ছেড়ে দিয়ে এরা এখন মাতৃভাষাকে খোদার ‘সেরা দান’ হিসেবে জনগণের কাছে উপস্থিত করার চেষ্টা করছে৷”
ওই ভিডিওতে গোলাম আযম দুই দফা সাক্ষাৎকারে নিজেকে ভাষা আন্দোলনের ‘একজন সক্রিয় নেতা’ হিসাবে জাহির করার চেষ্টা করেছেন বলেও উল্লেখ করেন উমর।
ভাষা আন্দোলনে গোলাম আযমের ‘অগত্যা’ অংশগ্রহণের কাহিনী, সেজন্য ১৯৭০ সালের দুঃখ প্রকাশ এবং ভাষা আন্দোলনকে ‘ভুল’ আখ্যায়িত করা, এরপর ১৯৯২ সালে আবার নিজেকে ‘ভাষাসৈনিক’ হিসেবে প্রচার এবং বাংলা ভাষাকে ‘খোদার সেরা দান’ হিসেবে গৌরবান্বিত করার চেষ্টাসহ পুরো বিষয়টিকে বদরুদ্দীন উমর আখ্যায়িত করেন “জামায়াতে ইসলামীর জাদুর খেলা” হিসাবে৷
তিনি বলেন, “এর সঙ্গে যে প্রকৃত ইসলামী নৈতিকতার কোনো সম্পর্ক নেই, একথা বলাই বাহুল্য।”