বহু প্রত্যাশিত রায় হওয়ার পর আদালতের বারান্দায় আইনজীবীদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দুই আঙুল তুলে বিজয়ের ‘ভি’ দেখালেন বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ; কিন্তু চশমার ফাঁক দিয়ে তখনও তার চোখ দুটি ছলছল, কপাল আর নাকের দুপাশে কান্নাচাপা কষ্টের ভাঁজ।
Published : 08 Dec 2021, 07:52 PM
একটু পরেই দণ্ডিত আসামিদের কারাগারে নিয়ে যেতে তোলা হল প্রিজন ভ্যানে। আবরারের কাছেপিঠেই তাদের বয়স। যাবজ্জীবনের আসামি ইসতিয়াক আহমেদ মুন্নার ছোট্ট বোনটি দু হাত বাড়িয়ে কাঁদছিল বাইরে; ভাইকে সে এভাবে জেলে নিয়ে যেতে দিতে চায় না।
ভাই যে খুনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে, সেটা বোঝার বয়স বোনের হয়নি। মুন্নার মত আরও পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত; আর ২০ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে বলা হয়েছে রায়ে।
আবরার ছিলেন বুয়েটের তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী, থাকতেন শেরেবাংলা হলে। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে ছাত্রলীগের এক নেতার কক্ষে নিয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়।
যে ২৫ জন আবরারকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, তারা সবাই বুয়েটেরই ছাত্র এবং ছাত্রলীগের কর্মী।
ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালের বিচারক আবু জাফর কামরুজ্জামান তার রায়ে বলেন, ‘মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন’ অভিযোগ এনে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে আবরারকে, ওই ঘটনা বাংলাদেশের সকল মানুষকে ব্যথিত করেছে। এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড যাতে আর কখনো না ঘটে, সেজন্যই আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিচ্ছে আদালত।
রায়ের পর চোখেমুখে ছেলে হারানোর বেদনা নিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “এই রায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট যেদিন বহাল রাখবে, আসামিদের সাজা যেদিন কার্যকর করা হবে; সেদিন আমি সন্তুষ্টি প্রকাশ করব।”
আবরারের হত্যাকারীদের দণ্ড যেন দ্রুত কার্যকর করা হয়, সরকারের কাছে সেই দাবি তুলে ধরেন বরকত উল্লাহ।
আবরারের মামা মোফাজ্জল হোসেন বলেন, নিম্ন আদালতের এই রায় উচ্চ আদালতেও বহাল থাকবে বলে তাদের বিশ্বাস।
সাজা ঘোষণার পর তারা মুষড়ে পড়েন। কেউ একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন, কেউ করছিলেন বিলাপ।
যাবজ্জীবনের আসামি অমিতের মা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলেন, “এ কেমন রায়। আমার ছেলে নির্দোষ, ঘটনার দুই দিন আগে অমিত পূজার জন্য বাড়িতে ছিল। এ কেমন বিচার।”
মুন্নার মা কোনো কথাই বলতে পারছিলেন না। রায় শুনে সঙ্গে আসা দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন শুধু।
আলোচিত এই রায়কে কেন্দ্র করে আদালত চত্বরে নেওয়া হয়েছিল কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। মামলার ২৫ আসামির মধ্যে কারাগারে থাকা ২২ জনকে সকালে প্রিজনভ্যানে করে পুলিশ বেষ্টনীর মধ্যে দিয়ে আদালতে নেওয়া হয়। বাকি তিনজন শুরু থেকেই পলাতক।
বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান বেলা ১২টায় এজলাসে আসন গ্রহণ করেন। পুরো বিচার কক্ষ তখন আইনজীবী, পুলিশ, আর সাংবাদিকে পরিপূর্ণ। দরজার বাইরে বারান্দায়তেও দারুণ ভিড়।
পাঁচ মিনিট পর রায় পাড়া শুরু করে সাড়ে ১২টার দিকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন বিচারক। তিনি পাঞ্জাব হাই কোর্টের বচন সিং বনাম রাষ্ট্র, ভরতের উচ্চ আদালতের মদনগোপাল বনাম রাষ্ট্র, আকবর আলী বনাম রাষ্ট্র মামলার রায় থেকে উদাহরণ টানেন।
বিচারক বলেন, “অপরাধ যথন এতটাই গুরুতর, পূর্ণ শক্তিতে বিচারের তরবারি চালাতে আমাদের দ্বিধা করা উচিত নয়।”
রায়ের পর সেই প্রিজনভ্যানে করেই ২২ তরুণকে আবার কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। তখন তারা দণ্ডিত আসামি।
প্রিজনভ্যানটি রাখা ছিল আদালতের প্রিজন সেল থেকে ৫০ মিটার দূরে। লম্বা লম্বা পা ফেলে দ্রুত গাড়িতে উঠে যান বুয়েট এই ‘সাবেক’ শিক্ষার্থীরা।
পাশে দাঁড়িয়ে একজন পুলিশ সদস্য যখন গুনে গুনে তাদের গাড়িতে তুলছিলেন, ভিড়ের মধ্যে একজন আফসোস করে বলে উঠেন- ‘এতগুলো মেধাবী ছেলে, আহারে!’
রায়ের প্রতিক্রিয়া জানাতে সাংবাদিকদের সামনে এসে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, “এ রায়ে আজ দেশ কলঙ্কমুক্ত হল। সাক্ষ্য প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে বিচারক যেটা ভালো মনে করেছেন, তাই রায়ে এসেছে। আমি পাবলিক প্রসিকিউটর হিসাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এ ধরনের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
“যাদের শাস্তি হয়েছে, তারা যেন বুঝতে পারেন, কী ধরনের অপরাধের সঙ্গে তারা জড়িয়ে গিয়েছিলেন। ভবিষ্যত প্রজন্ম এবং ভবিষ্যতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ভবিষ্যত শিক্ষকমণ্ডলী যেন এ ঘটনা ভুলে না যান। তারা যেন সতর্ক হন। প্রত্যেকের সজাগ হওয়া উচিৎ, প্রার্থনা করা উচিৎ, কারো জীবনে যেন এমন ঘটনা আর না ঘটে।“
অন্যদিকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মাজেদুর রহমান মাজেদ, হোসেন মোহাম্মদ তোহা ও সামছুল আরেফিন রাফাতের আইনজীবী মো. রেজাউল করিম সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সম্পূর্ণ রায় পাইনি। রায় পেলে পর্যালোচনা করে আমরা আপিলে যাব। আশা করি সেখানে ন্যায়বিচার পাব।”
দণ্ডিতদের প্রিজন ভ্যনে তোলার সময় একজনকে চিৎকার করতে দেখে সাংবাদিকরা জানতে চাইছিলেন- তিনি কার আত্মীয়।
উত্তরে তিনি বলেন, “আমি ২৫ জনেরই বাবা, এ রায় আমি মানি না। “
অন্য মামলায় অনেক সময় রায়ের পর কোনো এক পক্ষকে সাংবাদিকদের সামনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা যায়। আবরার হত্যার রায়ের পর তেমনটি দেখা যায়নি।
জাকির হোসেন নামের এক আইনজীবী বললেন, “এটা হৃদয় বিদারক একটা ঘটনা। আবরারকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। আর যারা আসামি তারাও আবরারের মতই মেধাবী। আসলে সব পক্ষেই সহানুভূতি কাজ করছে। সবার হৃদয়েই রক্তক্ষরণ হচ্ছে।”