স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে এ মাসে বাংলাদেশ সফরে এসে গোপালগঞ্জ আর সাতক্ষীরায় দুটি মন্দিরও পরিদর্শন করবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
Published : 11 Mar 2021, 10:01 AM
এর মধ্যে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ওড়াকান্দিতে মতুয়া সম্প্রদায়ের একটি মন্দিরও রয়েছে, যা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সফরের দ্বিতীয় দিন ২৭ মার্চ নরেন্দ্র মোদী গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যাবেন। সেদিনই তার দুই জেলায় দুই মন্দিরে যাওয়ার কথা রয়েছে।
সাতক্ষীরা থেকে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে যাবেন মোদী, সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে স্বাগত জানাবেন।
এরপর সেখান থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দিতে যাবেন জানিয়ে মোমেন বলেন, “ওদের ওখান থেকে সেদিনই ঢাকায় এসে তিনি দেশে ফিরে যাবেন।”
সাতক্ষীরার যশোরেশ্বরী কালী মন্দির সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি পবিত্র তীর্থ হিসেবে বিবেচিত।
আর মতুয়া মতবাদের প্রবক্তা হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মস্থান হল গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানার ওড়াকান্দি। ওই গ্রামের মন্দিরটি পরিচিত মতুয়া সম্প্রদায়ের কাছে সর্বোচ্চ মর্যাদার তীর্থস্থান হিসেবে।
বাংলাদেশ মতুয়া মহা মিশনের সংঘাতিপতি ও মতুয়াচার্য পদ্মনাভ ঠাকুর জানান, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফর সামনে রেখে দেশটির হাই কমিশনের কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে ওড়াকান্দি ঘুরে গেছেন।
পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের সময় মোদীর মতুয়া সম্প্রদায়ের মন্দির পরিদর্শন নিয়ে অন্য আলোচনাও হচ্ছে তার দেশে।
আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে- “পশ্চিমবঙ্গের মতুয়া ভোট টানতে বাংলাদেশ সফরে গিয়ে কি ‘মাস্টারস্ট্রোক’ দিতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী?”
ভারত-বাংলাদেশ মিলিয়ে মতুয়া সম্প্রদায়ের অনুসারীর সংখ্যা পাঁচ কোটির বেশি। এর মধ্যে প্রায় তিন কোটির বসবাস পশ্চিমবঙ্গে।
আনন্দবাজার লিখেছে, “প্রধানমন্ত্রী সেখানে গিয়ে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদকে প্রণাম করে এলে পশ্চিমবঙ্গের মতুয়া-ভোট টানা বিজেপির পক্ষে সহজ হবে বলে মনে করছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।”
পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন সরকারের আমলে মতুয়াদের কাছে টানার পদক্ষেপ চলেছে জানিয়ে মতুয়াচার্য পদ্মনাভ ঠাকুর বলেন, “বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনিও মতুয়াদের কাছে টানার জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। আমাদের জন্য কিছু করেছেন।
”তারপর তৃণমূল কংগ্রেস প্রধান মমতা বন্দোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসে ঠাকুর নগরের ঠাকুর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। কিছু উন্নয়ন করেছেন। মতুয়া ধর্মের প্রবর্তক হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিনকে তিনি সরকারি ছুটির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।”
ওই সম্মেলনে বক্তৃতা দেওয়ার কথা জানিয়ে পদ্মনাভ ঠাকুর বলেন, “ওই সম্মেলন থেকেই উনাকে মতুয়াদের প্রধান তীর্থপীঠ ওড়াকান্দি সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তিনি এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং ওড়াকান্দিতে আসতে সম্মতি জানান।”
ওড়াকান্দির ইতিহাস
ব্রাহ্মণ্যবাদ যাদের নিম্নবর্ণের অস্পৃশ্য জাত করে রেখেছিল, মূলত তারাই মতুয়া মতবাদের অনুসারী। তারা একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী; নারী ও পুরুষের সমান অধিকার এবং বিধবা বিবাহকে উৎসাহিত করা হয় এ মতবাদে।
মাতুয়া মতবাদের প্রবক্তা হরিচাঁদ ঠাকুর তার অনুসারীদের কাছে নিপীড়িত ও অবহেলিত মানুষের মুক্তির দূত হিসাবে বিবেচিত।
১২১৮ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসের ত্রয়োদশী তিথিতে মহা বারুনীর দিনে কাশিয়ানী উপজেলার সাফলীডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন হরিচাঁদ ঠাকুর। ১২৮৪ বঙ্গাব্দের একই দিনে তার মৃত্যু হয়। প্রতিবছর এই দিনে লাখো মতুয়া ওড়াকান্দির মন্দির প্রাঙ্গণে সমবেত হন, পুণ্যস্নানে অংশ নেন।
মূলত তিনিই সূচনা করেন মতুয়াবাদের, যা পরে বিস্তৃত হয় তার ছেলে গুরুচাঁদ ঠাকুরের হাত ধরে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর মতুয়া অনুসারীদের একটি বড় অংশ ভারতে চলে যান এবং উত্তর ২৪ পরগণার ঠাকুরনগরে নিজেদের ধর্মীয় কেন্দ্র গড়ে তোলেন।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাইরে আসাম, ত্রিপুরা, উড়িষ্যা, উত্তরাখণ্ড, উত্তর প্রদেশ, ঝারখণ্ড, আন্দামান, মহারাষ্ট্র, দিল্লি, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানাসহ বিভিন্ন প্রদেশে ভারত সরকার তাদের পুনর্বাসন করে।
ব্রিটিশবিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনে মতুয়াদের অংশগ্রহণের কথা তুলে ধরে মতুয়া অনুসারী সঞ্জয় বিশ্বাস বলেন, ”নীল কুঠির বিরুদ্ধে হরিচাঁদ ঠাকুর আন্দোলন করেছেন। সমাজে জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে লড়েছেন। জমিদারের লোকজন মতুয়া মতবাদ প্রচারে হরিচাঁদ ঠাকুরের অনুসারীদের বাধা দিয়েছেন। বর্বর নির্যাতন করেছেন। সেখানে তিনি এটি প্রতিহত করে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন।”
তিনি বলেন, মতুয়া মতাদর্শ প্রচারের আন্দোলন ব্যাপকভাবে প্রসারের অংশ হিসাবে গুরুচাঁদ ঠাকুর ১৮৩৬ সালের পর থেকে ব্যাপকভাবে পাঠশালা প্রতিষ্ঠা শুরু করেন। ১৯০৮ সালে ওড়াকান্দিতে মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। ঢাকা বিভাগের জন্য ১ হাজার ৬৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় অনুমোদন করিয়েছিলেন তিনি।
মোদীর আগমনে উচ্ছ্বাস
নরেন্দ্র মোদীর আগমনে উচ্ছ্বাসের কথা জানিয়ে নিজেদের বিভিন্ন দাবিদাওয়ার কথাও তুলে ধরে ধরছে ওড়াকান্দির মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ।
পদ্মনাভ বলেন, “ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জম্ম দিনে সরকারি ছুটি রয়েছে। তাই অবতার হরিচাঁদ ঠাকুরের জম্ম দিনে বাংলাদেশে ঐচ্ছিক ছুটি প্রচলন করেছে সরকার। আমরা দিনটিকে সরকারি ছুটি ঘোষণার প্রধান দাবি জানাচ্ছি।”
মতুয়া অনুসারী সঞ্জয় বলেন, “বিশ্ব এজতেমার পরে শ্রীধাম ওড়াকান্দিতে সব থেকে বেশি জনসমাগম হয়ে থাকে। সে কারণে ওড়াকান্দিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা ও মর্যাদার আসনে বসানোর দাবি মতুয়াদের রয়েছে। নরেন্দ্র মোদীর আগমনের মধ্যে দিয়ে এটি আরো প্রসারিত হবে।”
ওড়াকান্দির হরি মন্দিরের সেবাইত হরি গোসাই বলেন, “২৭ মার্চ মোদী আসছেন। তিনি এখানে পূজা দেবেন। আমি তাকে পূজায় সহযোগিতা করব। এখানে পূজা দিলে হরিচাঁদ ঠাকুর মোদীর মনোস্কামনা পূর্ণ করবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। তখন সকল মতুয়া ভক্ত ও বিশ্বের কল্যাণ কামনায় বিশেষ প্রার্থনা করা হবে।”