গত শতকের ১৯৬১ থেকে ১৯৭৫ এর ১৪ অগাস্ট- এই ১৫ বছর বাড়িটি সাক্ষী হয়ে ছিল বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রতিটি ঘটনার। অথচ এক রাতের নির্মম হত্যাযজ্ঞে সেই বাড়ি এখন একটি জাতির অন্তত শোকের জাদুঘর।
Published : 14 Aug 2020, 05:17 PM
ইতিহাসের সেই কালো অধ্যায়ের ৪৫ বছর কেটে গেছে; ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িটি এখনও সাক্ষ্য দেয় ভয়ঙ্কর সেই দিনটির। প্রতি বছর ১৫ অগাস্ট আসে বাঙালির জীবনে জাতীয় শোক দিবস হয়ে। বিনম্র শ্রদ্ধায় বাংলাদেশের মানুষ স্মরণ করে তাদের জাতির পিতাকে।
করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে এবারের শোক দিবস এসেছে ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে। সঙ্কুচিত হয়েছে শোক দিবসের কর্মসূচি; প্রতিবারের মত এদিন আর ধানমণ্ডির বাড়িতে শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগও থাকছে না সাধারণ নাগরিকদের।
বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের কিউরেটর মো. নজরুল ইসলাম খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার ১৫ অগাস্ট অন্যবারের মত হচ্ছে না। কিন্তু আমরা মনের ভেতরে তো পালন করতেই পারি। আর তা হল মনের ভেতরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে এ মহামারীকালে আমরা আমাদের অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করতে পারি, খেটে খাওয়া মানুষের কর্মসংস্থান সুনিশ্চিত করতে পারি।”
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমণ্ডির এ বাড়িতে সপরিবারে বসবাস শুরু করেন ১৯৬১ সালে। এরপর সেই বাড়িটি হয়ে উঠে বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সূতিকাগার।
বন্ধুর পথ মাড়িয়ে বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের সেই মহান স্থপতিকে ইতিহাস স্বীকৃতি দিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে।
পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের রক্তে ভেজা এই বাড়ি ১৯৯৪ সালের ১৪ অগাস্ট জাতির জন্য উৎসর্গ করেন বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। সেটি এখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর।
সেখানে এখন চলছে শোক দিবসের প্রস্তুতি। অগাস্টের দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়ানো সেই বাড়ির প্রাঙ্গণ ছেয়ে যাচ্ছে ব্যানারে-ফেস্টুনে।
প্রস্তুতি পর্বের মধ্যেই বুধবার বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন শনির আখড়ার বাসিন্দা আবদুল মোতালেব।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “প্রতিবার ১৫ই অগাস্টে আমি দুপুরবেলা নাতি-নাতনিদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাতে আসি। এবার তো তা সম্ভব নয়। মহামারীর মধ্যে ওদের নিয়ে আসতে পারছি না। ধানমণ্ডিতে কাজ পড়ে গিয়েছিল, কাজ শেষ করে আজই এখানে এলাম শ্রদ্ধা জানাতে।”
অন্য সময় হাজারো মানুষের আনাগোণায় বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর অঙ্গন মুখরিত থাকত দিনের প্রায় সবটুকু সময়। মহামারীকালে সেই প্রাঙ্গণে আনাগোণা কমেছে। তবুও অনেকেই মনের টানে চলে আসেন এ বাড়িতে।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট যখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হল, সালাউদ্দিনের বাবা আর ঢাকাতেই থাকতে চাইলেন না।
“আব্বা খালি কইত, যে মানুষটা আমাদের স্বাধীনতা আইন্যা দিল, তারে আমরাই মাইরা ফেললাম। পরে আম্মা-চাচারা মিলে তারে বাড়িতে নিয়া গেলাম। আব্বা আর কোনোদিন ঢাকায় আসে নেই। আমি সুযোগ পাইলেই এখানে আইসা বইস্যা থাকি। জাতির পিতারে তো কোনোদিন সামনাসামনি দেখি নাই। এখানে আসি। তারে নিয়ে লোকজনের নানা কথাবার্তা শুনি।”
কলেজ পড়ুয়াদের একটি দলকেও দেখা গেল বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে এসেছেন। নিরাপত্তা কর্মীদের হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তারা অনুমতি পেলেন বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির সামনের লবিতে যাওয়ার।
তাদের একজন খালেদ মাহমুদ বলেন, “করোনাভাইরাস মহামারীর আগেও আমরা এদিকটায় বসে কত আড্ডা দিয়েছি। বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর থেকেই আমরা ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ কিনেছি। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কত কিছু জানতাম না। আমাদের জাতির পিতার জীবনী নিয়ে আরও পড়তে চাই আমরা।”
“আওয়ামী লীগ সরকার আসার পরে বিকৃত ইতিহাসকে সংশোধন করে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার কাজটি করছে।”
নজরুল ইসলাম জানান, করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে শারীরিকভাবে আসতে না পারলে ভার্চুয়ালি যে কেউ ঘুরে দেখতে পারেন স্মৃতি জাদুঘরটি। ইন্টারনেটের মাধ্যমে তারা ঘুরে বেড়াতে পারেন বঙ্গবন্ধুর বত্রিশ নাম্বারের বাড়ির নানা প্রান্তে।
তরুণ প্রজন্মের জন্য ভার্চুয়াল সে আয়োজনে ইতিহাসের নানা দলিলও উপস্থাপন করছে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর।
বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটিই এখন বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন কিউরেটর নজরুল ইসলাম খান।
“বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চের ভাষণে বলেছেন, ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’, পাকিস্তানের সামরিক শাসনের মতো করোনাভাইরাসও আমাদের এক মহাশত্রু। এ করোনাকালে অর্থনীতি যখন পঙ্গু হয়ে যেতে বসেছে, তখন বঙ্গবন্ধুর সেই ডাককে স্মরণ করে, তার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে যে যেখানে আছে, যার যা আছে, তা নিয়ে সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করি তাহলে আমরা এই করোনা থেকে পরিত্রাণ পাব।”