দুই নারী ভক্তকে ধর্ষণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত ভারতের স্বঘোষিত আধ্যাত্মিক গুরু গুরমিত রাম রহিম সিংকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে দেশটির আদালত।
Published : 28 Aug 2017, 04:20 PM
রাম রহিমের রায় ঘিরে নিরাপত্তার জালে বন্দি হরিয়ানা
ভারতে ‘ধর্ষক ধর্মগুরু’র কারাগারের বাইরে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা
ভারতে ‘ধর্ষক ধর্মগুরুর’ ভক্তদের তাণ্ডব, নিহত ৩০
ভারতজুড়ে টান টান উত্তেজনা আর কড়া নিরাপত্তার মধ্যে হরিয়ানা রাজ্যের রোহতক কারাগারে বিশেষ আদালত বসিয়ে সোমবার এই সাজা ঘোষণা করেন বিচারক জগদীপ সিং।
এনডিটিভির খবরে বলা হয়, দুই নারীকে ধর্ষণের জন্য ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে রাম রহিম সিংকে। দুই সাজা পর্যায়ক্রমে কার্যকর হবে বলে ভারতীয় গণমাধ্যমে ‘রকস্টার বাবা’ নামে পরিচিতি পাওয়া এই ধর্মগুরুকে মোট ২০ বছর জেল খাটতে হবে। সেই সঙ্গে ধর্ষণের শিকার দুই নারীকে দিতে হবে ১৫ লাখ রুপি করে ক্ষতিপূরণ।
আনন্দবাজার লিখেছে, আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক শেষে বিচারক সাজা ঘোষণার আগেই অস্থায়ী আদালতের মধ্যে কান্নায় ভেঙে পড়েন রাম রহিম। বার বার তিনি বলছিলেন- “মুঝে মাফ করদো!”
পঞ্জাবের ধর্মীয় গোষ্ঠী ডেরা সাচ্চা সওদার প্রধান ৫০ বছর বয়সী গুরমিত রাম রহিম সিং বলতে চেষ্টা করেন, আইনের প্রতি তার অগাধ ‘আস্থা’ রয়েছে। তিনি ‘নিরপরাধ’, কিন্তু তাকে ‘ফাঁসিয়ে দেওয়া হচ্ছে’।
অন্যদিকে ১৫ বছর আগে যে দুই ভক্ত রাম রহিমের বিরুদ্ধে ধর্ষণের এই অভিযোগ এনেছিলেন, তারাও সাজা বাড়ানোর দাবিতে উচ্চ আদালতে আপিল করার কথা বলেছেন।
এ মামলার তদন্তের দায়িত্বে থাকা সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) আসামি রাম রহিমের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড চেয়েছিল। সিবিআই এরইমধ্যে রাম রহিমের সাজা বাড়ানোর আবেদন করেছে এবং তার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে এ সংস্থার এক কর্মকর্তা এনডিটিভিকে জানিয়েছে।
বাবা রাম রহিম নামে পরিচিত এই ব্যক্তি ডেরা সাচ্চা সওদা নামে যে আশ্রমের নেতৃত্ব দেন, তা শিখ, হিন্দু, মুসলিম-সব ধর্মের চেতনার মিশেলে তৈরি।
ভারতীয় গণমাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী হরিয়ানা ও পাঞ্জাবে অন্তত পাঁচ লাখ ভক্ত রয়েছে রাম রহিমের। সারা বিশ্বে তার ছয় কোটি ভক্ত বলে দাবি শিষ্যদের।
রাম রহিমের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে ২০০২ সালে, তার আশ্রমের এক নারী সাধিকা প্রধানমন্ত্রীর কাছে বেনামী চিঠিতে ওই অভিযোগ করেন। ওই চিঠির ভিত্তিতে অভিযোগ তদন্তে সিবিআইকে নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট।
ওই বছরই কথিত এই ধর্মগুরুর বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করে সিবিআই। সেখানে বলা হয়, ১৯৯৯ সালে নিজের আশ্রমে দুই শিষ্যাকে ধর্ষণ করেন রাম রহিম।
২০০৭ সালে শুনানি শুরুর পর দশ বছরের মাথায় মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসে। চণ্ডিগড়ের পাঁচকুলায় সিবিআইয়ের বিশেষ আদালত গত শুক্রবার ওই মামলায় রাম রহিমকে দোষী সাব্যস্ত করলে পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় ব্যাপক তাণ্ডব শুরু করে এই ধর্মগুরুর আড়াই লাখ ভক্ত। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী দিল্লি পর্যন্ত।
ওই সহিংসতায় ৩৮ জন নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে সোমবার সাজা ঘোষণার দিন নেওয়া হয় ভ্যাপক নিরাপত্তা। সিদ্ধান্ত হয়, আদালতে রায় না দিয়ে রাম রহিম যেখানে আছেন, সেই রোহতক কারাগারে অস্থায়ী এজলাস বসিয়ে সাজা ঘোষণা করা হবে।
বিচারককে হেলিকপ্টারে করে রোহতকের বিশেষ কারাগারের আদালতে নিয়ে যাওয়া হবে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, এই রায় ঘিরে রোহতক কারাগারকে রীতিমত দূর্গে পরিণত করা হয়। কারাগারে পৌঁছানোর সব পথ বন্ধ করে দিয়ে আধা সামরিক বাহিনীর তিন হাজার সদস্যকে রাস্তায় নামানো হয়। কারাগারের দেড় কিলোমিটারের মধ্যে সাংবাদিকদেরও নিষিদ্ধ করা হয়।
হরিয়ানার পাশাপাশি পাশের রাজ্য পাঞ্জাব ও এবং উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদ ও নৈদারও কয়েক হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে রোহতকে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে বাসিন্দাদের ঘরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়।
কোনো ধরনের সহিংসতার ইংগিত দেখলেই গুলি করার নির্দেশ দেওয়া হয় পুলিশকে। নিরাপত্তার এই ঘেরাটোপের মধ্যে হেলিকপ্টারে করে এসে বিশেষ এজলাসে বসে সাজা ঘোষণা করেন বিচারক।
বাদী পক্ষের আইনজীবী উৎসব সিং বাইন বলেন, আরও অন্তত ৫০ জন নারী রাম রহিমের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে সামনে এসেছেন এবং তারা এ মামলার অধিকতর তদন্ত চেয়েছেন।
২০০৭ সালে শিখ সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে একজনকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে রাম রহিমের ভক্তদের বিরুদ্ধে। ধর্ষণের দায়ে দণ্ডিত এই ধর্মগুরুর বিরুদ্ধে শিষ্যদের নপুংসক করে দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
তিন মেয়ে ও এক ছেলের বাবা রাম রহিমের জন্ম ১৯৬৭ সালের ১৫ অগাস্ট, রাজস্থানের গঙ্গানগর জেলার শ্রী গুরুসর মোদিয়া গ্রামে। সেখানেই স্কুলে লেখাপড়া করেছেন তিনি।
তিনি পাঞ্জাবের ডেরা সাচ্চা সওদার নেতৃত্বে আসেন ১৯৯০ সালে। হরিয়ানার সিরসায় ১৯৪৮ সালে এই ডেরা গড়ে তুলেছিলেন শাহ মস্তানা নামের এক ‘ধর্মগুরু’।
রাম রহিম তার আশ্রম প্রাঙ্গণে নিয়মিত পপ কনসার্টের আসর বসাতেন। সেখানে নিজেই থাকতেন গায়কের ভূমিকায় থাকেন। ‘ইউ আর মাই লাভ চার্জার’সহ তার বেশ কয়েকটি গান বেশ জনপ্রিয়। জাকজমকপূর্ণ পোশাক পরে গানের ভিডিওতে আসার কারণেই তার নাম হয়ে যায় ‘রকস্টার বাবা’।
এই সিনেমাগুলির একটি ‘এমএসজি: মেসেঞ্জার অফ গড’ এর ট্রেইলারে অন্য গ্রহের বাসিন্দা, ভূত আর হাতির সঙ্গে লড়াই করতে দেখা যায় রাম রহিমকে; খলনায়কদের শায়েস্তা করতে দেখা যায়।
তার অভিনীত চলচ্চিত্র দেখতে হাজার হাজার গাড়ির বহর নিয়ে এসে তার অনুসারীরা কয়েকবার দিল্লির কাছের গুরগাঁও অচল করে দেন।
আনন্দবাজারের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে ৩৬ জন ব্যক্তি ‘জেড ক্যাটাগরির’ সুরক্ষা পেয়ে আসছিলেন, তাদের একজন ছিলেন রাম রহিম।