ভারতে ‘ধর্ষক ধর্মগুরুর’ ভক্তদের তাণ্ডব, নিহত ৩০

ভারতের স্বঘোষিত আধ্যাত্মিক গুরু গুরমিত রাম রহিম সিং ধর্ষণ মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও দিল্লিতে তাণ্ডব চালিয়েছে তার ভক্তরা, যাতে নিহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 August 2017, 12:10 PM
Updated : 25 August 2017, 09:58 PM

সহিংসতার আশঙ্কায় আগে থেকে সেনা-পুলিশ সব প্রস্তুত রেখেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি। দুই রাজ্যের অনেক শহরে রেল স্টেশন, পেট্রোল পাম্প ও টেলিভিশন চ্যানেলের গাড়িতে হামলা হয়েছে। দিল্লিতে একটি বাস ও ট্রেনের দুটি বগি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।

শুক্রবার হরিয়ানার যে শহরে রাম রহিমের মামলার রায় হয়েছে, সেই পাঁচকুলায় সবচেয়ে বেশি সহিংসতা ও প্রাণহানি হয়েছে। সহিংসতায় প্রাণহানি হয়েছে হরিয়ানার সিরসায় রাম রহিমের আশ্রম এলাকায়ও।

সহিংসতায় ৩০ জন নিহত এবং আড়াইশ মানুষ আহত হওয়ার খবর দিয়েছে এনডিটিভি। রাম রহিমের প্রায় আড়াই হাজার অনুসারীকে গ্রেপ্তারের কথা পুলিশের বরাত দিয়ে জানিয়েছে বিবিসি।

এই মামলার রায় ঘোষণার দিন থাকায় চণ্ডিগড়ের কাছের পাঁচকুলা শহরে চলে আসে রাম রহিমের দেড় লাখের বেশি ভক্ত। রায় ঘোষণার পর তারা তাণ্ডব শুরু করলে পুলিশ লাঠিপেটার পাশাপাশি কাঁদুনে গ্যাস ও জলকামান ব্যবহার করলেও আদালতের আশপাশের এলাকা কার্যত বিক্ষোভকারীদের দখলে চলে যায়।  

পাঁচকুলায় থানা এবং বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে রাম রহিম ভক্তরা আগুন দেয়। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় কয়েক ডজন গাড়ি, যার মধ্যে সংবাদমাধ্যমের গাড়িও রয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্রণে বিকাল ৫টার দিকে সেখানে সেনা মোতায়েন করা হয়।

বিকালে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল রয়টার্সকে বলেন, “সম্ভাব্য সব উপায়ে আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছি, কিন্তু বিক্ষোভকারীরা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।”

রাম হরিমের আশ্রম ডেরা সাচ্চা সওদার সদর দপ্তর সিরসায়ও পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সহিংসতা হয় তার ভক্তদের। সেখানে বেশ কয়েকটি ভবনে আগুন দেওয়া হয়। ওই এলাকায় সহিংসতায় দুজনের মৃত্যু হয় বলে এনডিটিভির খবর।

রায় ঘোষণার পর পর পাঞ্জাবের বাথিন্ডা, মালুত ও বাল্লুয়ানাসহ বিভিন্ন শহরে সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এই রাজ্যে দুটি রেলস্টেশনে আগুন দেওয়া হয়।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বলছে, পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গুলি চালানোতেই নিহতের ঘটনা ঘটে বলে শোনা গেছে। তবে প্রশাসনিকভাবে এ বিষয়ে এখনও কিছু বলা হয়নি।

চণ্ডিগড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ায় শহরজুড়ে এবং পাঞ্জাবের কয়েকটি এলাকায় কারফিউ জারি হয়।

হরিয়ানা ও পঞ্জাবজুড়ে তাণ্ডবের মুখে দুই রাজ্যের সীমান্তই সিল করে দেওয়া হয়। বাতিল হয়েছে এই দুই রাজ্যে চলাচলকারী প্রায় দুইশ ট্রেনযাত্রা। 

রাজধানী দিল্লির আনন্দ বিহার রেলওয়ে স্টেশনে একটি ট্রেনের দুটি বগিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়, বাসও জ্বালানো হয়েছে বলে জানিয়েছে দিল্লি পুলিশ।

রাম রহিমের অনুসারীদের তাণ্ডবে সরকারি সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় এই গোষ্ঠীর অনেক সম্পদ জব্দ করা হবে বলে আদালত বলেছে।

সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, “এটা খুবই বেদনাদায়ক।”

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ রাম রহিম সমর্থকদের শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। রাম রহিম নিজেও শান্তি চাইছেন বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

রাম রহিম সিংয়ের লাখো সমর্থককে চণ্ডিগড়ে ঢুকতে দেওয়ার জন্য হরিয়ানা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করেছেন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী অমরেন্দ্র সিং।

‘ধর্মগুরুর’ মামলার রায় শুনতে আগে থেকেই শহরটিতে রাম রহিমের দুই লাখের বেশি ভক্ত জড়ো হয়েছিলেন।

আদালতের রায় বিপক্ষে গেলে সহিংসতা শুরু হতে পারে- এমন আশঙ্কায় সকাল থেকে পাঁচকুলায় সেনাবাহিনী নামানো হয়। ৫০ হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয় হরিয়ানা ও পাঞ্জাবে।

উত্তেজনার মধ্যেই সিরসায় নিজের সাংগঠনিক দপ্তর থেকে ২০০ গাড়ির বহর নিয়ে রওনা হয়ে আড়াইশ কিলোমিটার দূরে পাঁচকুলা আদালতে পৌঁছান রঙদার চরিত্র রাম রহিম সিং।

আদালত দুপুরে রায় ঘোষণার পরপরই ৫০ বছর বয়সী রাম রহিমকে কড়া পাহারার মধ্যে আম্বালা কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। রায় শোনার পর আদালতের বাইরে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার বহু সমর্থক। টেলিভিশন ফুটেজে ওই সময়ই রাম রহিমের অনুসারীদের সহিংসতায় লিপ্ত হতে দেখা যায়।

বিবিসি লিখেছে, একাধারে ধর্মপ্রচারক, সমাজ সংস্কারক, গায়ক, চিত্রনায়ক ও পরিচালক বাবা রাম রহিমের মতো বর্ণময় চরিত্র ভারতের অজস্র ধর্মগুরুর মধ্যেও বিরল। তার আশ্রম- ডেরা সাচ্চা সওদা গড়ে ওঠে শিখ, হিন্দু, মুসলিম- সব ধর্মের চেতনার মিশেলে। ভারতের গণমাধ্যমে অনেক সময় তাকে বলা হয় ‘রকস্টার বাবা’।

হরিয়ানায় গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রতি সমর্থন দিয়েছিলেন রাম রহিম। লাখ লাখ ভক্ত থাকায় বড় ভোট ব্যাংক বিবেচনা করে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির অনেক নেতাই তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রাখেন।

কিন্তু পনেরো বছর আগে নিজের আশ্রমেই দুজন ভক্ত মহিলাকে ধর্ষণ করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।

অজ্ঞাতপরিচয় এক নারীর চিঠির সূত্র ধরে ২০০২ সালে এই ধর্মগুরুর বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করে সিবিআই। সেখানে বলা হয়, ১৯৯৯ সালে নিজের আশ্রমে দুই শিষ্যাকে ধর্ষণ করেন রাম রহিম।

২০০৭ সালে শুনানি শুরুর পর দশ বছরের মাথায় মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসে। বিচারের পুরোটা সময় নিজেকে নির্দোষ দাবি করে এসেছেন ডেরা সাচ্চা সওদার প্রধান।