২০১২ সালে তথ্য মন্ত্রণালয় যৌথ প্রযোজনা ইস্যুতে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করলেও তা যথাযথভাবে মানা হচ্ছে কি না তা তদারকির আসলে কেউ ছিল না। দৃশ্যপট পাল্টে যায় ২০১৪ সালে। ‘মোস্ট ওয়েলকাম’ খ্যাত পরিচালক অনন্য মামুনের ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’ সিনেমাটির বিরুদ্ধে ‘নীতিমালা লঙ্ঘন'-এর অভিযোগ এনে সেন্সর বোর্ডের শরণাপন্ন হয় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি। পরে তথ্য মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র বিভাগেরও দ্বারস্থ হয় তারা।
সে সময় পরিচালক সমিতির মহাসচিব মুশফিকুর রহমান গুলজার গ্লিটজকে জানিয়েছিলেন, সিনেমাটি যৌথ প্রযোজনার ৬ নং ধারাকে ‘অমান্য করেছে’। এ ধারায় দুই দেশের শিল্পী সংখ্যা সমানুপাতিক হারে নির্ধারিত হওয়ার কথা থাকলেও তা অনন্য মামুন করেননি, এমনকি তিনি ভারতেই বেশিরভাগ শুটিং সেরেছেন বলে অভিযোগ আনেন গুলজার।
পরিচালক সমিতির তোড়জোড়ে সিনেমাটির বিরুদ্ধে নীতিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগ আনে তথ্য মন্ত্রণালয় চলচ্চিত্র বিভাগ। চলচ্চিত্র বিভাগের তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব (চলচ্চিত্র) রেবা রাণী সাহাও বলেছিলেন, ‘সিনেমাটি নীতিমালা মানে নি।’ যদিও আইনী প্রক্রিয়ায় অনন্য মামুনের সিনেমাটির প্রদর্শনী ঠেকানো যায়নি। তবে পরিচালক সমিতি থেকে মামুনের সদস্যপদ বাতিল করে দেয়া হয়।
যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা ভাঙায় অভিযুক্ত ভারতীয় প্রযোজনা সংস্থা এসকে মুভিজ কিন্তু বসে থাকেনি। ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’ ব্যবসাসফল হওয়ার পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় প্রযোজনা সংস্থা জাজ মাল্টিমিডিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে ফেলে তারা।
এরপর ঢাকাই সিনেমার প্রথম সারির নায়িকা মাহিয়া মাহির বিপরীতে টালিগঞ্জের অভিনেতা অঙ্কুশ হাজরাকে নিয়ে ‘রোমিও বনাম জুলিয়েট’ সিনেমাটি নির্মাণ করে তারা। পাঞ্জাবি সিনেমা ‘সিং ভার্সেস কাউর’ এর অনুকরণে নির্মিত সিনেমাটি বাংলাদেশে মোটামুটি ব্যবসা করলেও মুখ থুবড়ে পড়ে ওপাড় বাংলায়।
এ সিনেমার বিরুদ্ধে কাহিনি, দৃশ্য নকলের অভিযোগ ছাড়াও, ভারতেই বেশিরভাগ অংশ দৃশ্যায়নের অভিযোগ ছিল, ছিল বাংলাদেশি শিল্পীদের কম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ের অভিযোগও, যা ৬ নং ধারার পাশাপাশি অন্য নীতিরও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
তবে এত অভিযোগের পরও থেমে থাকেনি জাজ-এসকে মুভিজের অভিযান। এরপরই মাহি এবং ওমকে নিয়ে নির্মিত হলো ‘অগ্নি-২’। এই সিনেমাটির বিরুদ্ধেও নীতিমালা ভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে।
সিনেমাটি মুক্তির পর জানা যায়, বাংলাদেশ ও ভারতে প্রদর্শিত ‘অগ্নি-২’-এর মধ্যে রয়েছে ব্যাপক তফাৎ। সিনেমাটি ভারতে মুক্তি পায় ‘অগ্নি’ নামে। এমনকি বাংলাদেশের চেয়ে ভারতে প্রদর্শিত সিনেমাটির ব্যাপ্তিও অনেক বেশি ছিলো বলে নিশ্চিত করেছে প্রযোজনা সংস্থা এসকে মুভিজ।
তবে সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে জাজ কর্ণধার আব্দুল আজিজ বলছেন, “আমরা যথাযথভাবে নীতিমালা মেনেই সিনেমা নির্মাণ করছি।”
যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নীতিমালা - ২০১২ (সংশোধিত)-এর ৩ এর গ ধারায় বলা হয়েছে যৌথ প্রযোজনার নির্মিতব্য চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য পরীক্ষার জন্য বিএফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে সভাপতি ও বিএফডিসির পরিচালককে (উৎপাদন)-কে সদস্য সচিব করে সাত সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি করা হবে। চিত্রনাট্য অনুমোদনের পাশাপাশি যৌথ প্রযোজনার শর্তানুযায়ী চলচ্চিত্রটি নির্মিত হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করবে এ কমিটি। কমিটির ইতিবাচক অনুমোদনের উপর নির্ভর করে চলচ্চিত্রটি আলোর মুখ দেখবে কি না।
কমিটির কার্যক্রম নিয়ে গ্লিটজের তরফ থেকে যোগাযোগ করা হয় বিএফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম-সচিব তপন কুমার ঘোষের সঙ্গে। তিনি যৌথ প্রযোজনা ইস্যুতে বিস্তারিত কথা বলতে চাইলেন না। বললেন, “এসব বিষয়ে কথা বলার মতো যথেষ্ট সময় নেই আমার। কমিটির সদস্য সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।”
“আমরা যৌথ প্রযোজনার সিনেমাগুলোর ক্ষেত্রে নীতিমালা অনুসরণ করছি। সিনেমাগুলো যদি নিয়মের ব্যতয় করে তবে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব। যারা যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে আসছে, তাদের আমরা সতর্ক করে দিচ্ছি বারেবারেই।”
যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্রের অনেকগুলোই ভারতীয় সিনেমার হুবুহু নকল, এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
তবে সেন্সর বোর্ড সচিব মুন্সী জালাল উদ্দিন বলছেন, যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্রগুলো প্রায়ই নীতিমালা মানছে না। সেন্সর বোর্ডের রিভিউ কমিটির বরাত দিয়ে তিনি স্বীকার করেন, যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্রে ভারতীয় চলচ্চিত্রের ছায়া দেখা যায়।
“আমরা প্রায়ই দেখি, সিনেমাগুলো নানাভাবে নিয়মের ব্যতয় করে। তখন আমরা পরিচালক, প্রযোজকদের জানাই, এগুলো সংশোধন করতে।”
সিনেমার শিল্পী সংখ্যা, দৃশ্যায়ন ইস্যুতে সেন্সর বোর্ড সচেতন রয়েছে বলে জানান সচিব। সিনেমাগুলোতে প্রায়ই বিভিন্ন দেশের পুলিশ, আইনকে বুড়ো আঙুল দেখানোর মতো অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, “নীতিমালায় স্পষ্ট করেই বলা আছে এ ব্যাপারে। কিন্তু রিভিউ কমিটি এ ব্যাপারে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। আমরা পরবর্তী সভায় এ নিয়ে অবশ্যই আলোচনা করব। অন্য দেশকে কিভাবে উপস্থাপন করা হবে, তা নিয়ে আরও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আমরা অবশ্যই পরিচালকদের জানাব।”
যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা প্রসঙ্গে তথ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বিএফডিসির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম হারুন-অর-রশীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। কিন্তু তথ্য মন্ত্রণালয়ের এই অতিরিক্ত সচিব নীতিমালা নিয়ে কথা বলতে চাননি।
এদিকে জাজ বলছে, “নীতিমালা কঠোর হোক, তাতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। শিল্পী নির্ধারণ, গল্প ইস্যুতে এত অভিযোগ। কিন্তু মানুষ তো আমাদের সিনেমা দেখছে। আমরা হলগুলো থেকে টাকা তুলে আনতে পারছি। ভারতের বাজারে আমাদের সিনেমার বাজার উন্মুক্ত হয়েছে। আমাদের ইন্ডাস্ট্রি কি তবে লাভবান হচ্ছে না!”
আব্দুল আজিজ আরও জানালেন, জাজ এখন থেকে শুধু যৌথ প্রযোজনার সিনেমাই নির্মাণ করবে।
“তিন কোটি টাকার দেশী সিনেমা নির্মাণের চেয়ে পাঁচ কোটি টাকা লগ্নি করে যদি আমি যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারি, তাহলে আমি ব্যবসা করতে পারছি। ভারতের বাজার থেকেও আমি টাকা তুলে আনতে পারছি। আমরা আর দেশী সিনেমা নির্মাণ করছি না।”