১৯৭৩ সালে থেকে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, তুরস্ক, শ্রীলংকার সঙ্গে যৌথভাবে সিনেমা নির্মাণের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ। আলমগীর কবির ভারতের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায় ‘ধীরে বহে মেঘনা’ নির্মাণ করেন। এরপর আশির্বাদ চলচ্চিত্রের কর্ণধার হাবিবুর রহমান খান ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সিনেমাটি প্রযোজনা করেন। ভারতীয় নির্মাতা ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত সিনেমাটিকে অবশ্য কখনও যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র হিসেবে উল্লেখ করেননি হাবিবুর রহমান।
গ্লিটজের সঙ্গে আলাপে পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান বলেন, যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্দেশ্য শুধু যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ছিলো, এমন নয়। মুক্তিযুদ্ধের পর দুদেশের চলচ্চিত্র শিল্প আবার ঘুরে দাড়াতে চেয়েছিলো। উর্দু বা হিন্দি ছবির প্রকোপ থেকে চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল ইন্ডাস্ট্রি।
আলমগীর কবির আবারও যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। বুলবুল আহমেদ-জয়শ্রী কবির-রাজশ্রী বোস অভিনীত সিনেমাটির নাম ‘সূর্যকন্যা’। সেই বছরই রাজেন তরফদার পরিচালিত যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র ‘পালঙ্ক’-এ অভিনয় করেন আনোয়ার হোসেন।
১৯৭৬ সালের পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে ক্রমেই পুঁজি সঙ্কটের মুখোমুখি হতে থাকে ঢাকাই সিনেমার প্রযোজকরা। সে সময়ে বাংলাদেশে আসতে শুরু করেন ভারত-নেপাল-পাকিস্তান-শ্রীলংকা-তুরস্কের চলচ্চিত্র প্রযোজকরা। ১৯৭৬ সাল ১৯৮৩ সাল অবধি কোনো যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নির্মিত না হলেও বিদেশি প্রযোজকদের আনাগোণায় বেশ মুখরিত হয়ে ওঠে চলচ্চিত্রাঙ্গন। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের যৌথ প্রযোজনায় ‘দূরদেশ’ সিনেমাটি নির্মিত হয়। সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৮৩ সালে। এরপর সৈয়দ হাসান ইমাম ও শক্তি সামন্ত যৌথভাবে প্রযোজনা করেন মিঠুন-রোজিনা-উৎপলের ‘অবিচার’ সিনেমাটি।
১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ,পাকিস্তান, তুরস্ক তিন দেশ যৌথভাবে প্রযোজনা করেন ‘লাভারস’ সিনেমাটি। তারপর বাংলাদেশ –পাকিস্তানের যৌথ প্রযোজনায় ‘মিস লংকা’ (১৯৮৫) সিনেমায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করে ববিতা কুড়ান প্রশংসা। বাংলাদেশ- পাকিস্তানের প্রযোজনায় ‘গুনাহ (১৯৮৯), ‘ঝড় তুফান’ (১৯৯৪), ‘লেডি র্যাম্বো’ (২০০০) এবং সর্বশেষ ২০০৪ সালে ‘ফুল আউর পাথর’ নামে সিনেমা মুক্তি পায়।
এরপর বাংলাদেশ-পাকিস্তান-শ্রীলংকা-নেপালের যৌথ প্রযোজনায় ‘সাত সেহেলি’ সিনেমাটি নির্মিত হলেও তা বাংলাদেশে প্রদর্শিত হয়নি। ১৯৮৬ সালে প্রণীত যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা ভঙ্গ করে সিনেমাটি মুক্তি দেয়া হয়। পাকিস্তানি প্রযোজকদের বিরুদ্ধে তখন প্রতারণায় অভিযোগ তোলেন পরিচালক আজিজুর রহমান। শ্রীলঙ্কান প্রযোজকরাও ‘সর্পরাণী’ সিনেমাটি ‘কালাগুণ’ নামে মুক্তি দেয়।
১৯৮৬ এবং ১৯৮৭ সালে ‘হিমালয়ের বুকে’ এবং ‘আপোষ’ নামে দুটি সিনেমা নির্মিত হয়। নব্বইয়ের দশকে ‘জীবন পরীক্ষা’, ‘লেডি স্মাগলার’, ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’, ‘প্রতীক্ষা’, ‘নীল দরিয়া’, ‘দেশ-বিদেশ’, ‘ভাইবন্ধু’, ‘ব্যবধান’, ‘লক্ষ্মীবধু’, ‘লাভ ইন আমেরিকা’ নামে বেশ কটি যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এছাড়াও ‘সত্য-মিথ্যা’, ‘কুচবরণ কন্যা’, ‘বেদেনীর প্রেম’, ‘রাজার মেয়ে’, ‘মায়ের আশীর্বাদ’, ‘প্রিয় শত্রু’, ‘বলবান’, ‘বিরোধ, ‘দুনিয়া’ উল্লেখযোগ্য।
১৯৯৭ সালে শাবানা তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এসএস প্রডাকশনের ব্যানারে ভারতের ধানুকা ব্রাদার্সের সঙ্গে যৌথভাবে নির্মাণ করেন 'স্বামী কেন আসামী'। জসিম-শাবানা, চাঙ্কি পান্ডে ও ঋতুপর্ণা অভিনীত এ সিনেমাটি ব্যবসায়িক সাফল্য পেলে এ দুটি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে ‘মেয়েরাও মানুষ’ ও ‘স্বামী ছিনতাই’ নামে দুটি সিনেমা। একই সময় ঢাকাই অভিনেত্রী নূতন ওপাড় বাংলার প্রসেনজিৎ-এর সঙ্গে মিলে নির্মাণ করেন ‘আমি সেই মেয়ে’। ১৯৯৮ সালে মুক্তি পায় ভারতের বাসু চ্যাটার্জি পরিচালিত ‘হঠাৎ বৃষ্টি’। ফেরদৌস-প্রিয়াংকা জুটির সেই সিনেমাটি দারুণ ব্যবসা করলে যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হয় ‘চুড়িওয়ালা’, ‘শেষ বংশধর’, ‘বর্ষাবাদল’, ‘মনের মাঝে তুমি’, ‘জবাবদিহি’, ‘প্রেম করেছি বেশ করেছি’, ‘টক ঝাল মিষ্টি’, ‘চুপি চুপি’সহ বেশ কটি সিনেমা।
রিয়াজ-পূর্নিমা জুটিকে নিয়ে পরিচালক মতিউর রহমান পানুর ‘মনের মাঝে তুমি’ ভীষণ ব্যবসাসফল হয়। এর পরই আশির্বাদ চলচ্চিত্র তৃতীয়বারের মতো যৌথ প্রযোজনায় নির্মাণ করে ‘মনের মানুষ’। প্রসেনজিৎ ও পাওলি দাম অভিনীত সিনেমাটিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন চঞ্চল চৌধুরী। এরপর দেওয়ান নাজমুল ‘সীমারেখা’ নামে যৌথ প্রযোজনায় একটি সিনেমা নির্মাণ করলেও তা মুখ থুবড়ে পড়ে।
ভারতীয় প্রযোজনা সংস্থা এসকে মুভিজের কর্ণধার অশোক ধানুকা কদিন আগে যৌথ প্রযোজনার সিনেমা ‘অঙ্গার’-এর মহরত অনুষ্ঠানে এসে বলে গেলেন, “নব্বইয়ের পর আমাদের টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিতে ধস নেমেছিলো। ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাপক অঙ্কের টাকা লগ্নি করেও আমরা সফল হচ্ছিলাম না। ঢাকার অবস্থাও তখন খুব ভাল না। শাবানা গেলো তখন কলকাতায়। আমরা যৌথভাবে ‘স্বামী কেন আসামি’ ছবিটি নির্মাণ করলাম। ছবিটি দারুণ ব্যবসা করলো। এখন কিন্তু দুদেশের ইন্ডাস্ট্রির অবস্থাই খারাপ। এদেশে কোটি টাকা লগ্নির ছবি চলছে না। আমরাও ব্যার্থ। আমরা এখন যৌথভাবে সিনেমা নির্মাণ করতে শুরু করেছি। সংখ্যা আরও বাড়লে, তাতে কিন্তু দুদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের জন্যই তা মঙ্গল বয়ে আনবে।”
মন্দার বাজারে সিনেমাটি ধুন্দুমার ব্যবসা করে। ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’ সিনেমাটি নীতিমালা মেনে নির্মিত হয়নি, এমন অভিযোগ করে এর সেন্সর সনদ বাতিলের দাবিতে মুখর হয়ে ওঠে সবাই। এক পযর্ায়ে পরিচালক অনন্য মামুনের পরিচালক সমিতির সদস্য পদই খারিজ করে দেয় পরিচালক সমিতি।
ভারতের এসকে মুভিজের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায় একের পর এক চলচ্চিত্র নির্মাণ করে চলেছে জাজ মাল্টিমিডিয়া। মাহিয়া মাহির বিপরীতে টালিগঞ্জের অভিনেতা অঙ্কুশ হাজরাকে নিয়ে ‘রোমিও বনাম জুলিয়েট’ সিনেমাটি বাংলাদেশে মোটামুটি ব্যবসা করলেও মুখ থুবড়ে পড়ে টালিগঞ্জে। এরপর মাহির ‘অগ্নি’ সিনেমার সিকুয়াল ‘অগ্নি-২’ নির্মাণ করা হয় ভারতের সঙ্গে মিলে। আর সবশেষ ঈদ-উল-আযহায় মুক্তি পেয়েছে নুসরাত ফারিয়া-অঙ্কুশ হাজরা অভিনীত 'আশিকি' সিনেমাটি।