'যৌথ প্রযোজনা অবশ্যই ইতিবাচক'

রোজার ঈদের ‘অগ্নি-২’ এর পর কুরবানি ঈদে মুক্তি পেলো নুসরাত-অঙ্কুশের ‘আশিকি’।  যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। সম্প্রতি গ্লিটজ মুখোমুখি হয়েছিলো একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী অভিনেত্রী আরিফা পারভিন মৌসুমীর।  তিনি বলছেন, যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র অবশ্যই ঢাকাই সিনেমার জন্য ইতিবাচক। সেই সঙ্গে কথা বললেন, ইন্ডাস্ট্রির তরুণ প্রজন্মের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে।

তানজিল আহমেদ জনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Sept 2015, 07:27 AM
Updated : 28 Sept 2015, 09:23 AM

গ্লিটজ : ইন্ডাস্ট্রিতে যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নিয়ে বেশ শোরগোল চলছে, বিতর্কেরও কমতি নেই। এরই মধ্যে আপনি অভিনয় করলেন ‘আশিকি’র একটি অতিথি চরিত্রে। একেতো যৌথ প্রযোজনার ছবি তার ওপর অতিথি চরিত্র...

মৌসুমী : প্রশ্নটা বোধহয় বুঝতে পেরেছি ! আসলে এটা আমি নেতিবাচক হিসেবে দেখি না। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো, চরিত্রটির গুরুত্ব। চরিত্রটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ।  আমরা যারা প্রতিষ্ঠিত শিল্পী, তারা যদি নতুনদের সঙ্গে অভিনয় না করি, তাহলে কেমন হবে? ‘আশিকি’ ছবির শিল্পী তালিকায় আমার নাম ছিলো। আমি যদি ছবিটা না করতাম তবে ছবিটার শুটিং পিছিয়ে যেত আরও। ছবিটাকে আমার কাছে খুব ভাল প্রজেক্ট বলে মনে হয়েছে। তাই এই ছবিটা করা।

ব্যাপারটা তো এমন ছিলো না, গল্পটা কারো একার ওপর ভিত্তি করে নির্মিত। আমরা তো কাউকে মোহাচ্ছন্ন করছি না এমন প্রচারণায়। ছবিতে প্রতিটি চরিত্র ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।

গ্লিটজ :  নুসরাত ফারিয়ার অভিষেক হয়েছে। নতুন এই নায়িকাকে কেমন দেখছেন?

মৌসুমী :  ফারিয়া দারুণ একটি সুযোগ পেয়েছে, ভাল একটি জায়গা থেকে ফিল্মে কাজ করতে এসেছে।  ভাল অভিনয় জানে, নাচ জানে। সেই সঙ্গে মেয়েটি ভাল হিন্দি জানে,  ইংরেজি জানে। নিজের দক্ষতাতেই সে বলিউডের একটি ছবিতে সুযোগ করে নিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে, তাকে আমাদের আরও বেশি সাহায্য করা উচিত।

গ্লিটজ : নবাগত অভিনেত্রীর প্রসঙ্গে একটি কথা এসে যায়। অনেক অভিজ্ঞ অভিনেতা-অভিনেত্রী, পরিচালকরা বলছেন, নবাগতরা সহবত জানে না। সিনেমার সেটে এসেও গোল বাধাচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন তারা। আপনার কি মনে হচ্ছে? সমস্যা আসলে কোথায়?

মৌসুমী : অভিযোগ একেবারেই মিথ্যা নয়। এদের আসলে সেভাবে প্রশিক্ষিত করে তোলা হচ্ছে না। হয়তো দু- একটি ছবি হিট হয়ে গেল, চারপাশে তাকে নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়ে গেল। কিন্তু এরপর কি তার কোনো ছবি ফ্লপ করতে পারে না? এমনও তো হতে পারে। নানা রকম স্টান্টবাজি করে নিজের অবস্থান কতদিন ধরে রাখবে ওরা? ইন্ডাস্ট্রিতে এসে শুধু অভিনয় না, শিখতে হয় আরও অনেক বিষয়ে। কিভাবে মার্কেট ম্যানেজ করতে হয়, এ বিষয়ে তারা কিছু জানে না, ওদেরকে কেউ শিখিয়েও দেয় না। মিডিয়ার সঙ্গেও অনেকে ভাল সম্পর্ক রাখতে জানে না। কি করে কথা বলতে হবে, কোথায় কতটা মার্জিত থাকতে হবে, তা তারা জানে না।

স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা হঠাৎ মিডিয়াতে এসে ভাবতে শুরু করে, “সারাদেশে আমার অনেক ভক্ত আছে, ফ্যান-ফলোয়ার আছে। আমাকে এত ভালবাসে তারা। আমি তো জনপ্রিয় হয়ে গেলাম।” এই ভাবনা একবার মাথায় ঢুকে গেলে মাথা কি আর ঠিক থাকে?”

গ্লিটজ : এই যে অল্প সময়ে জনপ্রিয় হওয়ার হিড়িক লেগে গেলো, সমাধান কিভাবে হতে পারে?

মৌসুমী : খুব কঠিন কাজ না কিন্তু! আমরা সিনিয়ররা এগিয়ে এলে এসব সমস্যার সমাধান হতে পারে। আমরা যতটা লড়াই বা কষ্ট করে নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রেখেছিলাম এখন কিন্তু তার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। প্রযোজক ও নির্মাতাদের উচিৎ নতুনদের আরো ভালভাবে প্রশিক্ষিত করে তোলা। আমি যাদের হাত ধরে চলচ্চিত্রে এসেছিলাম তাদের কথা মতোই কিন্তু চলেছি। তারা যেভাবে বলেছে, তার বিরোধিতা আমি কখনও করিনি। আমি কিছুই জানতাম না, তারাই কিন্তু আমাদের হাতে ধরে শিখিয়েছে। আমি যত বড় মৌসুমীই হই না কেন, তাদের অবদানের কথা কিন্তু আমাকে স্বীকার করতে হবে। আজকাল অনেক হাউজই তো দেখি, সিনেমা মুক্তির পর উধাও। প্রযোজক সংস্থাগুলোকেই শেখাতে হবে সহবত আর নিয়মকানুন।

জাজ মাল্টিমিডিয়া তাদের নতুন ছেলেমেয়েদের কিন্তু সেভাবেই প্রশিক্ষিত করে তুলছে। প্রতিষ্ঠানটি  তাদের নায়ক নায়িকাদের সঠিকভাবে উপস্থাপন করার মানসিকতা ও সাহস দুটোই রাখে। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এভাবে নায়ক-নায়িকাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তবে এই সমস্যাটি আর থাকবে না। নানা দিক থেকে আলো-বাতাস এসে তাদের মাথা নষ্ট করতে পারবে না। তারপরই ওরা টিকে যাবে।

গ্লিটজ : প্রসঙ্গতই এসে যায়, সালমান শাহের কথা, একই সঙ্গে অভিষেক আপনাদের। ইন্ডাস্ট্রি এখনও সালমানের শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কেউ কেউ আবার বলছেন, সালমান বেঁচে থাকলে এত সম্মান পেতেন না। আপনার কি মনে হয়?

মৌসুমী : দেখুন, সালমান আসলে এত প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন, তিনি খুব অল্প সময়েই তার অভিনয়ের জাদুতে দর্শকের মনে জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন। সালমানের সব ছবিই যে হিট হয়েছিল, এমন কিন্তু না। মাত্র কটা ছবি করেছিলো সালমান। সালমান আসলে তার ভক্তদের মনে এমনভাবে স্থান করে নিয়েছে, যে তার মৃত্যুুর পরও তাকে নিয়ে এত মাতামাতি। আমরা যারা তাকে ভালোবাসি, তাকে সারা জীবন বড় করেই দেখতে চাই। এখন নানা কথা বলা হচ্ছে। ওসব নিয়ে আমি ভাবি না। একটা দুঃখ, সালমান যদি বেঁচে থাকতো আরো অনেক কিছু পেতাম হয়তো আমরা।  আমরা তাকে খুব অল্প সময়ে হারিয়ে ফেলেছি।

গ্লিটজ : ফিরছি যৌথ প্রযোজনার ইস্যুতে। চারপাশে এই আলোচনা, সমালোচনার মধ্যে আপনার কি মনে হচ্ছে যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র আমাদের ইন্ডাস্ট্রির জন্য ইতিবাচক?

মৌসুমী: যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্রকে অবশ্যই ইতিবাচক হিসেবে দেখি আমি। ভারত ও বাংলাদেশের জনপ্রিয় তারকাদের যৌথ প্রযোজনার ছবির মাধ্যমেই দু দেশের দর্শক দেখতে পাচ্ছে। ভারত ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে যা কিছু আন্তর্জাতিকভাবে সাড়া পেয়েছে, তার অনেকগুলোই কিন্তু যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত। যদি যথাযথভাবে যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মিত হতে থাকে, তবে কিন্তু আমাদের চলচ্চিত্রের জন্যই তা মঙ্গলজনক।

গ্লিটজ: সম্প্রতি গ্লিটজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে শাকিব খান বলছিলেন, যৌথ প্রযোজনার সিনেমাগুলো নীতিমালা অনুসরণ করছে না একেবারেই। যৌথ প্রযোজনার ছবির নামে ভারতীয়রা নাকি আমাদের বাজার দখলের চেষ্টা করছে। আপনারও কি তাই মনে হয়?

মৌসুমী: যৌথ প্রযোজনার মানে এই না যে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা কম সুযোগ পাবে, আর ভারতের ছেলেমেয়েরা বেশি সুযোগ পাবে। দুই দেশের শিল্পীদেরই সমানভাবে সুযোগ দেওয়া উচিৎ। প্রযোজকদেরই ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। না হলে কিন্তু বিতর্কটা থেকেই যাবে।

একটা সময় ছিলো, যখন আমাদের চলচ্চিত্রের বাজারের তুলনায় টালিগঞ্জের বাজার একেবারেই খারাপ ছিলো। তারা তখন আমাদের দেশে এসে বসে থাকতো, আর ভাবতো ঢাকাই সিনেমার মতো তাদের ইন্ডাস্ট্রি কেন উন্নত হচ্ছে না। তারা চেষ্টা করেছে। হিন্দি ছবির দাপটে তাদের বাজার তখন কোণঠাসা, তখন তারা আবারো চোখ রাখছে  ঢাকার বাজারে। তারা মনে করছে, ঢাকার পড়তি বাজারে তাদের চলচ্চিত্র, তারকাদের চাহিদা রয়েছে। এখন আমাদের খুব লক্ষ্য রাখতে হবে যেন তারা আমাদের পড়তি বাজারের ফায়দা লুটতে না পারে। ওরা যেন ব্যবসার লভ্যাংশর বেশি অংশটা নিয়ে চলে না যায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে খুব।

গ্লিটজ: বাংলাদেশের প্রযোজক কিন্তু জোর গলায় বলছেন, ভারতের বাজার দখল করাই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য....

মৌসুমী: ভাল কথা, ভাল উদ্যোগ। ভারতের বাজার দখল করাই যদি প্রথম টার্গেট, তবে আমি মনে করি তা ঠিক হচ্ছে না। আগে আমাদের নতুন ছেলেমেয়েদের আরও ভালভাবে পরিচিত করে তুলতে হবে সেখানে। তাদেরকে বিশ্বাস করাতে হবে, আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যেও অনেক যোগ্যতা আছে। আন্তর্জাতিক বাজার দখল করতে কিন্তু বেশি সময় লাগবে না আমাদের। এখন সুষ্ঠু পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে চললেই হল।

গ্লিটজ: ইন্ডাস্ট্রি একনায়কনির্ভর হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আপনারও কি এমনই মনে হয়?

মৌসুমী : এটা পরিচালকদের ব্যর্থতা, তারা নতুন নায়ক তৈরি করতে পারেনি। দর্শক কিন্তু নতুন কিছুই চাইবে। দর্শক সব সময় তাদের পছন্দের তারকাকেই নিজেদের আইডল হিসেবে দেখতে ভালবাসে।  যখন দেখলো ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন কেউ নাই, তখন তারা শাকিব খান নির্ভর হতে শুরু করল।

আমাদের পরিচালকরা কেমন করে জানি একটা নোংরা রাজনীতিতে জড়িয়ে গেছে। সেটা না হয়ে তারা যদি স্বাধীনচেতা হতো, তবে অবশ্যই আরও ভাল কিছু হত।

গ্লিটজ : যৌথ প্রযোজনার ছবি নিয়ে পরিচালকদের অনেকেই কিন্তু ক্ষুব্ধ....

মৌসুমী : যৌথ প্রযোজনার ছবিগুলোকে এ কারণেই আমি ইতিবাচক হিসেবে দেখি।  একটা ধাক্কা দিয়েছে তাদের। এখন তাদের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেছে। এক সময় তো এরাই ছিল সর্বেসর্বা, ইন্ডাস্ট্রির রাজা। এখন বাজারে তাদের লড়তে হচ্ছে যৌথ প্রযোজনার সিনেমার সঙ্গে। হলে টিকে থাকতে লড়তে হচ্ছে।  তারা বুঝতে পারছে তাদের আরও শিখতে হবে, জানতে হবে।প্রতিযোগিতা কিন্তু কঠিন হয়ে গেছে ভীষণ।

গ্লিটজ : যৌথ প্রযোজনার ছবিতে ভারতীয় নায়কদেরই প্রাধান্য বেশি বলে একটা তর্ক আছে...

মৌসুমী : ব্যাপারটি দর্শকদের উপর নির্ভর করে। ভারতীয় প্রযোজকরা মনে করছেন, বাংলাদেশি নায়িকার বিপরীতে ভারতীয় নায়ক নিলে সিনেমাটি নিয়ে ব্যবসা করতে তাদের সুবিধা হবে।  এ নিয়ে আরও অনেক কথা বলা যায়, তবে অন দ্য রেকর্ড আমি এসব বলতে চাই না।