সাকার দম্ভের ‘শেষ’

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড আপিলেও বহাল থাকায় সন্তোষ জানিয়েছেন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষের ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 July 2015, 12:31 PM
Updated : 29 July 2015, 06:29 PM

তারা বলছেন, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে ন্যায়বিচার পেয়েছে জাতি। আর এর মধ্য দিয়ে অবসান ঘটেছে প্রভাবশালী পরিবারের এই রাজনীতিকের দাম্ভিকতার।   

হত্যা, গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল সালাউদ্দিন কাদেরকে, তা বহাল রেখে বুধবার আপিলের রায় দিয়েছে আপিল বিভাগ।

এই রায় দেশবাসীর প্রত্যাশিত ছিল বলে মন্তব্য করেছেন একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির।

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আপিলে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকবে এটি অবশ্যই অত্যন্ত প্রত্যাশিত ছিল। এরকম অপরাধে আগে যত মামলা হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় অপরাধী সাকা।”

বাবা পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সাবেক স্পিকার ফখরুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে একাত্তরে মুক্তিকামী বাঙালির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে মন্ত্রী বনে যাওয়া সালাউদ্দিন কাদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের জন্য নানা সময় আলোচনায় আসেন।

যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর তা এক তুড়িতে উড়িয়ে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য। ট্রাইব্যুনাল নিয়ে নানা বিতর্কিত মন্তব্যও করেছিলেন তিনি।

সেদিকে ইঙ্গিত করে শাহরিয়ার কবির বলেন, “একাত্তরে সহিংসতার সব সীমা সে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতেও সে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে।”

এই যুদ্ধাপরাধীর ঔদ্ধত্য ও দম্ভের বিষয়ে বলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজও।

আপিলের রায়ের পর তিনি বলেন, “বিভিন্ন সময় ট্রাইব্যুনালকে গালিগালাজ করেছেন সাকা চৌধুরী। দাম্ভিকতা দিয়ে তিনি নিজেকে ল’মেকার দাবি করতেন। তার দাম্ভিকতার শেষ হয়েছে।”

“এ রায়ের মাধ্যমে এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হলো যে, আইনের ঊর্ধ্বে আসলে কেউ নয়,” বলেন প্রসিকিউটর তুরিন।

‘মামা’ নামে পরিচিত মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল হক বলেন, “সে এত অপরাধ করেছে, তাকে একবার ফাঁসি দিলে তার প্রতিবিধান হবে না। কিন্তু বারবার ফাঁসি তো দেওয়া সম্ভব না।”

সাবেক সেনাপ্রধান মুক্তিযোদ্ধা হারুনুর রশীদ বলেন, “চট্টগ্রামে অনেক বিপ্লবীর জন্ম হয়েছে। মাস্টার দা, বিনোদ বিহারীর এই চট্টগ্রাম এবার কলঙ্কমুক্ত হল।”

‘বিচ্ছু জালাল’ নামে পরিচিত কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জহিরউদ্দিন জালাল বলেন, “যুদ্ধে আমাদের অনেক সহযোদ্ধা প্রাণ দিয়ে গেছেন। আমরা জীবন নিয়ে পৃথিবীতে আছি। এর মাধ্যমে তাদের প্রতি আমাদের অনেক কর্তব্য জন্ম নিয়েছে।

“এর প্রথমটি হচ্ছে, তাদের আত্মাকে শান্ত করা। একাত্তর সালের খুনি-ধর্ষকদের শাস্তি দিলে তাদের আত্মা শান্ত হয়। আমরা সেই কাজটি করছি।”

মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এখন পর্যন্ত ২০টি মামলার রায় হয়েছে। এসব রায়ের অনেকগুলো আপিলে গিয়ে ইতোমধ্যে দুই যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে সরকার।

মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক মো. আবদুল হান্নান খান বলেন, ট্রাইব্যুনালে ২০টি মামলা হয়ে গেলেও উনার (সাকা চৌধুরী) আচার-আচরণের কারণে এ মামলাটির রায় ব্যতিক্রম বৈশিষ্ট্য পেয়েছিল।”

এই যুদ্ধাপরাধীর আচরণ নিয়েও রায়ে ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের বলতে হয়েছে উল্লেখ করে হান্নান বলেন, “একাত্তরে অপরাধ করেছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি নিয়মিত আদালতের সঙ্গে বেয়াদবি করেছেন। উচ্চ আদালতে তার অপরাধের যথাযথ বিচার হয়েছে।”

ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক এম এ হাসান প্রতিক্রিয়ায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এতে প্রমাণিত হয়েছে বাংলাদেশের ন্যায় ও সত্যের অবস্থান রয়েছে। বিচার প্রক্রিয়ায় ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

“এ দেশে যুদ্ধাপরাধ ঘটেনি বলে যুদ্ধাপরাধীরা যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছিল, মিথ্যাচার করেছিল; এ রায়ের মাধ্যমে তাদের মিথ্যা বক্তব্য ও অপরাধেরও ওপর সিলমোহর দেওয়া হয়েছে।”

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চট্টগ্রামের রাউজানে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা, সুলতানপুর ও ঊনসত্তরপাড়ায় হিন্দু বসতিতে গণহত্যা এবং হাটহাজারীর এক আওয়ামী লীগ নেতা ও তার ছেলেকে অপহরণ করে খুনের দায়ে ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সুবিচার পেয়েছি।”

একাত্তরে চট্টগ্রামের ত্রাস সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন এই অধ্যাপক।

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও কথাসাহিত্যিক রশীদ হায়দার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “এ রায় প্রত্যাশিত রায়। জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়েছে।”

সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে ট্রাইব্যুনালের দণ্ড বহাল থাকায় ফাঁসিকাষ্ঠেই যেতে হবে সালাউদ্দিন কাদেরকে।

ফাঁসি বহালের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে এ রায়ে। ঔদ্ধত্যপূর্ণ এ যুদ্ধাপরাধী রং পাল্টে বিভিন্ন সময় ক্ষমতায়ও আরোহণ করেছে। এমন এক ব্যক্তির আজ বিচার হল।

“বিএনপিও অন্তত এর দায় নেবে না,” বলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জোট শরিক দলের এই নেতা।

রায়ে সন্তোষ জানিয়ে তা দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।

“দেশের মানুষের মধ্যে যে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা ছিল তা নিশ্চিত হয়েছে। এখন যত দ্রুত সম্ভব এই রায় বাস্তবায়ন হোক-সেটাই আমরা চাই।”

রায়ে বর্তমান প্রজন্মের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)।

সংগঠনের সভাপতি কবির চৌধুরী তন্ময় এক বিবৃতিতে বলেন, “অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে অসভ্য বর্বর কোনো ব্যক্তি ও মহলের কোনো জায়গা নেই।

উদ্ধত আচরণকারী সাকা চৌধুরীর চূড়ান্ত রায় মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার মাধ্যমে তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে এবং প্রজন্মের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে।”