যুদ্ধ যেতে না চাইলে ‘আটকে রাখা হচ্ছে’ রুশ সেনাদের

ইউক্রেইনে যুদ্ধ করতে গিয়ে অনেক রুশ সেনার মোহভঙ্গ হচ্ছে। তারা আর যুদ্ধ করতে চাইছেন না।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Dec 2022, 04:21 PM
Updated : 12 Dec 2022, 04:21 PM

পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ছাড়াই রাশিয়া অনেক সেনাকে ইউক্রেইনে সম্মুখ-সমরে পাঠিয়ে দিচ্ছে, তাদের হাতে যথাযথ অস্ত্রও নেই। সঙ্গে বিরূপ পরিবেশ ও কমান্ডারদের চরম দুর্ব্যবহার। ফলে অনেক রুশ সেনা আর যুদ্ধে অংশ নিতে চাইছে না।

কেউ কেউ বিবেকের তাড়না থেকেও যুদ্ধ করতে চাইছে না। ওইসব সেনাদের বন্দি করে রেখে নির্যাতন করে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছে।

যে অভিযোগ খতিয়ে দেখতে এক বাবা ও ইউক্রেইনে যুদ্ধে যাওয়া তার ছেলের সঙ্গে কথা বলেছেন রাশিয়ায় বিবিসি-র সাংবাদিকরা।

বাবা-ছেলের বক্তব্যে উঠে এসেছে ইউক্রেইনে যুদ্ধ করতে যাওয়া রুশ সেনাদের চরম হেনেস্তার চিত্র।

নিরাপত্তার খাতিরে বাবা-ছেলের ছদ্মনাম ব্যবহার করেছে বিবিসি।

সের্গেইয়ের ছেলেকে যখন ইউক্রেইনে যুদ্ধ করতে যেতে বলা হয় তখন তিনি হাতজোড় করে ছেলেকে যেতে নিষেধ করেছিলেন।

সের্গেই বারবার ছেলেকে বলেছিলেন, ‘‘সেখানে তুমি তোমার স্বজনদের পেয়ে যেতে পার। তাই যেও না।”

‘‘কিন্তু সে বলেছিল সে যাচ্ছে। তার বিশ্বাস ছিল এই যুদ্ধ সঠিক। আমি তাকে বলেছিলাম, তোমাকে বোকা বানানো হচ্ছে। এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে, জীবন আমার সেই কথাকেই সত্য প্রমাণ করেছে।”

সের্গেইয়ের ছেলে স্টাস তখনই ছিলেন সামরিক কর্মকর্তা। তিনি যুদ্ধে যান এবং সেখান থেকে বাবাকে বার্তা পাঠাতে শুরু করেন। সেই বার্তায় তিনি যুদ্ধে না গেলে কামান্ডাররা সেনাদের সঙ্গে কী আচরণ করছে তা জানাতে থাকেন।

সের্গেই বলেন, ‘‘সে আমাকে জানায়, রাশিয়ার সেনাদের কোনও ধরনের সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে না। কোনও গোয়েন্দা তথ্য নেই, প্রস্তুতি নেই। তাদের শুধু সামনে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সামনে কী অপেক্ষা করছে তা কেউ জানে না।”

‘‘যুদ্ধে যেতে অস্বীকৃতি জানানোও তার জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল। যদিও আমি তাকে পরামর্শ দিয়ে বলেছিলাম, ‘তুমি বরং সেটাই কর। এটা আমাদের যুদ্ধ নয়। এটা স্বাধীনতার যুদ্ধ নয়’।”

বাবার পরামর্শে স্টাস লিখিত আকারে যুদ্ধে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তার মতো আরো অনেকে যুদ্ধে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং তাদের বন্দি করা হয়।

ছেলেকে মুক্ত করতে সের্গেই বেশ কয়েকবার ফ্রন্টলাইনে যান। তিনি সেনা কর্মকর্তা, আইনজীবী এবং তদন্ত কর্মকর্তাদের হাতেপায়ে ধরে তাকে সাহায্য করতে অনুরোধ করেন।

শেষ পর্যন্ত তার চেষ্টা সফল হয় এবং স্টাসকে রাশিয়া ফেরত পাঠানো হয়।

স্টাস তার বাবাকে জানান বন্দিশিবির গুলোতে ঠিক কী ঘটত। কীভাবে রাশিয়ার সেনাদের ‘বিভিন্ন দল’ তাকে যুদ্ধে যেতে বাধ্য করার চেষ্ট‍া করত।

সের্গেই বলেন, ‘‘তারা তাকে মারত এবং এমনভাবে বাইরে নিয়ে যেত যে মনে হত এখনই গুলি করে মেরে ফেলবে। তাকে মাটিতে শুইয়ে দশ পর্যন্ত গুণতে বলা হত। সে গুণতে অস্বীকৃতি জানায়। যেজন্য তারা তাদের পিস্তল দিয়ে স্টাসের মাথায় কয়েকবার আঘাত করে। সে বলেছে, আঘাতের কারণে তার মুখমণ্ডল রক্তে ভেসে যেত।

‘‘তারপর তারা তাকে কক্ষের ভেতর নিয়ে যেয়ে বলত, ‘হয় তুমি আমাদের সঙ্গে আস, না হয় তোমাকে আমরা মেরে ফেলব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের কেউ একজন আমার ছেলেকে স্টোররুমে কাজে নিতে বলে।”

গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া যখন ইউক্রেইনে আগ্রাসণ শুরু করে তখন স্টাস একজন দায়িত্বরত সেনা কর্মকর্তা। তখন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছিলেন, শুধুমাত্র পেশাদার যোদ্ধারা ওই যুদ্ধে যাবে।

কিন্তু যুদ্ধ পুতিনের পরিকল্পনামত এগোয়নি। ইউক্রেইনে রুশ বাহিনীকে তাদের পরিকল্পনার চেয়ে অনেক গুণ বেশি প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়। ফলে সেখানে যুদ্ধের জন্য রাশিয়ার সেনা সংকট দেখা দেয়।

যার প্রেক্ষিতে গত সেপ্টেম্বরে পুতিন রাশিয়ার ‘রিজার্ভ ফোর্স’ কে জড়ো হওয়ার ‍নির্দেশ দেন।

নতুন ওই সেনাদের অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার পরপরই অভিযোগ করতে শুরু করেন, তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না দিয়েই সম্মুখ যুদ্ধে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ঠিকঠাক অস্ত্রেও দেয়া হচ্ছে না। ফলে তারা যুদ্ধে যেতে অস্বীকৃতি জানান।

এছাড়া, সেনাদের সঙ্গে কমান্ডারা দুর্ব্যবহার করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। সেনাদের ‘ট্রেঞ্চে’ ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে হচ্ছে। ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছে, প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত। কিন্তু যখন তারা ব্যারাকে ফিরে আসছে তখন তাদের শুধু কমান্ডারদের চিৎকার আর শপথবাক্য শুনতে হচ্ছে।

ইউক্রেইনের বিভিন্ন জায়গা থেকে যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করা সেনাদের সেলার বা বেজমেন্টে বন্দি করে রাখার খবর আসতে থাকে।

রাশিয়া কর্তৃপক্ষ অবশ্য সেনাদের মোহভঙ্গ হয়ে যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করা এবং তাদের বাধ্য করতে আটকে রাখার খবর মিথ্যা বলে দাবি করেছে।

গত মাসে পুতিন বলেছিলেন, ‘‘রাশিয়ার সেনাদের জন্য বন্দিশিবির বা কারাগার বা এরকম কিছুই নেই।

‘‘এগুলো সবই আজেবাজে কাথা এবং মিথ্যা দাবি। সেখানে তাদের যুদ্ধ করতে না চাওয়ার কোনো কারণ নেই।

‘‘সেনারা যদি যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়তে চায় তাতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। একের পর এক গোলাবর্ষণ হচ্ছে বা বোমা পড়ছে এমন পরিবেশে সাধারণত সব মানুষই প্রতিক্রিয়া দেখাবে। এমনকি শারীরিক পর্যায়েও। কিন্তু কিছুদিন পর সব অভ্যাস হয়ে যায়, আমাদের সেনারা দক্ষতার সঙ্গে সেখানে যুদ্ধ করছে।”

তবে পুতিন যাই বলুন না কেনো, যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানানো সেনাদের সংখ্যা বাড়ছে। যাদের মধ্যে সৌভাগ্যবান কেউ কেউ পরিবার সঙ্গে যোগাযোগ করে দেশে ফিরে যেতে পারছেন। এমন আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়েছে বিবিসির।

যারা বিবিসি-কে ইউক্রেইনে যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে বন্দিশিবিরে তাদের কী কী নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে তার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন।