শিক্ষার্থী ভিসায় কড়াকড়ি ‍আরোপ নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত যুক্তরাজ্য সরকার

অভিবাসীর সংখ্যা কমাতে এমন পদক্ষেপ দেশটির অনেক বিশ্ববিদ্যালয়কে আর্থিক সংকটে ফেলতে পারে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Nov 2022, 05:25 PM
Updated : 26 Nov 2022, 05:25 PM

দেশে অভিবাসীর সংখ্যা রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় অভিবাসী নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাজ্য সরকার শিক্ষার্থী ভিসার উপর বিধিনিষেধ আরোপের বিষয়টি বিবেচনা করছে বলে জানিয়েছে ডাউনিং স্ট্রিট।

যুক্তরাজ্যের পরিসংখ্যান অধিদপ্তর থেকে গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশটিতে এবছর ‘নেট মাইগ্রেশন’ রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে পাঁচ লাখ ৪ হাজারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ, গত বছরও এই সংখ্যা এক লাখ ৭৩ হাজার ছিল।

এ কারণে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী এবং তাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে যুক্তরাজ্যে আসা অভিবাসীদের সংখ্যা কমাতে চাইছে যুক্তরাজ্য সরকার। তারা মনে করছে, এসব অভিবাসীরা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে তেমন একটা অবদান রাখতে পারছে না।

এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের কার্যালয়ের একজন মুখপাত্র বলেন, প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সমর্থন করেন। ‘যেগুলোর কোনো কোনোটি বিশ্ব সেরা’।

‘‘কিন্তু তিনি মোট অভিবাসীর (নেট মাইগ্রেশন) সংখ্যা কমিয়ে আনতেও বদ্ধ পরিকর। এজন্য অপ্রত্যাশিত এবং নজিরবিহীন পরিস্থিতিতে দায়ী, যে কারণে অভিবাসীর সংখ্যা রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছে গেছে।

‘‘অভিবাসন ব্যবস্থা যাতে ঠিক থাকা তা নিশ্চিত করতে আমরা সব ধরনের বিকল্প বিবেচনা করছি। এবং ওই বিবেচনার মধ্যে শিক্ষার্থীদের উপর নির্ভরশীল হয়ে আসা কামাতে ভিসা নিয়ন্ত্রণ এবং নিম্ন মানের ডিগ্রির বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত।”

যদিও নিম্নমানের ডিগ্রি বলতে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি বলে জানায় বিবিস।

এ বিষয়ে দ্য টাইমস এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিবাসীর সংখ্যা হ্রাসে যুক্তরাজ্য সরকার যেসব ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বিবেচনা করছে তার মধ্যে শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি নিয়ন্ত্রণ এবং শিক্ষার্থীদের উপর নির্ভরশীল হয়ে যুক্তরাজ্যে আসতে চাওয়াদের ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রাভারম্যান গত অক্টোবর ‍মাসে তার আগের মেয়াদে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের পরিবারের যুক্তরাজ্যে আসা নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন।

ওই সময় দ্য সান কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্রাভারম্যান বলেছিলেন, ‘‘স্বল্প দক্ষ অনেক কর্মী এ দেশে আসছেন। অনেক বেশি সংখ্যায় শিক্ষার্থীও এসেছে। সেইসঙ্গে আমরা সত্যিই অনেক বেশি সংখ্যায় নির্ভরশীল মানুষ পেয়েছি। যেসব মানুষ যুক্তরাজ্যে আসছেন তারা খুব একটা কাজ করছেন না বা করলেও স্বল্প দক্ষতার কাজ করছেন। তারা আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে তেমন একটা অবদান রাখতে পারছেন না।”

তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঠিক বিপরীত কথা গত সপ্তাহে বলেছেন যুক্তরাজ্যের অর্থমন্ত্রী জেরেমি হান্ট। তিনি বলেছেন, দেশের অর্থনীতির অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে অভিবাসীদের প্রয়োজন।

তিনি সঙ্গে এও বলেন, ‘‘যদি আপনি অভিবাসীর সংখ্যা হ্রাস করতে চান তবে আপনার একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকতে হবে। যাতে তা দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে।”

আগামী বছরগুলোর জন্য ‍অভিবাসীদের প্রয়োজন হবে বলেও মনে করেন অর্থমন্ত্রী। বলেন, ‘‘অভিবাসীরা অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হবেন।”

অভিবাসী কমাতে যুক্তরাজ্য সরকারের শিক্ষার্থী ভিসায় কড়াকড়ি আরোপের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বলেছে,

উচ্চ বেতন দিয়ে ভর্তি হওয়া আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা যদি কমে যায় তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তহবিল সংকটে পড়তে পারে।

একই কথা বলেছেন যুক্তরাজ্য সরকারের মাইগ্রেশন বিষয়ক একজন উপদেষ্টাও।

সুনাক সরকারের ‘মাইগ্রেশন অ্যাডভাইজরি কমিটি’র প্রধান অধ্যাপক ব্রিয়ান বেল সতর্ক করে দিয়ে বলেন, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে গেলে যুক্তরাজ্যের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়কে দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে।

বিবিসি রেডিও ফোরকে তিনি আরো বলেন, যদি তারা তথাকথিত ‘নিম্ন মানের’ ডিগ্রির বিষয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে তবে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় দেউলিয়া হয়ে পড়তে পারে। বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র অঞ্চলগুলিতে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে খাদের প্রান্তে ঠেলে দেয়া হবে।

বলেন, ‘‘বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়কে বেশিরভাগ কোর্সের বেলাতেই ব্রিটিশ শিক্ষার্থীদের পাঠদান করে লোকসান গুণতে হয়। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠদান ফি আরো বাড়িয়ে তারা ওই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়।

‘‘এখন আপনি যদি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী আসার পথ বন্ধ করে দেন তবে আমি ঠিক জানি না, ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে ঠিকে থাকবে।”

লন্ডন, কেমব্রিজ এবং অক্সফোর্ডের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তারপরও হয়তো ঠিকঠাক মত চলবে। কিন্তু ‘নিউক্যাসেলের কী হবে, নর্থ-ইস্ট, নর্থ-ওয়েস্ট বা স্কটল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কী হবে’ প্রশ্ন তোলেন তিনি।

তিনি সতর্ক করে দিয়ে আরো বলেন, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী নিয়ন্ত্রণের নীতি গ্রহণ করলে বরং ‘ব্রিটিশ শিক্ষার্থীদের ফি বেড়ে যাবে’।

‘‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে অর্থ আদায় করতো তা পূরণ করতে তাদের দেশীয় শিক্ষার্থী কাছ থেকে ফি নেওয়া বাড়াতে হবে।”

যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব স্টুডেন্টস (এনইউএস) থেকেও বিষয়টি ‘হাস্যকর’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে বলে জানায় বিবিসি।

এনইউএস-র পক্ষ থেকে বলা হয়, যদি সরকার আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের যুক্তরাজ্যে পড়তে আসা কঠিন করে ফেলে তবে তাতে দেশে দক্ষ জনশক্তির অভাব দেখা দেবে।

স্কটল্যান্ডে ডেপুটি ফার্স্ট মিনিস্টার জন সুইনি একে ‘বোকামী’ বলে বর্ণনা করেছেন।

স্কটল্যান্ডের শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এমন সিদ্ধান্ত হলে ‘স্কটল্যান্ডের বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে’।

যুক্তরাজ্যের সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লাখ চার হাজারের বেশি মানুষ যুক্তরাজ্যে বসবাসের জন্য গেছেন। যেখানে আগের বছর জুন পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল এক লাখ ৭৩ হাজারের মত।

দেশটির জাতীয় পরিসংখ্যান অধিদপ্তর থেকে এর কারণ হিসেবে বলা হয়, কিছু নজিরবিহীন পরিস্থিতি যেমন ইউক্রেইনীয় এবং হংকংয়ের অধিবাসীদের জন্য নতুন ভিসা স্কিম এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের দেশগুলো থেকে অনেক বেশি শিক্ষার্থী যুক্তরাজ্যে যাওয়া অন্তর্ভুক্ত।

এ বছর ভারত থেকে রেকর্ড সংখ্যা শিক্ষার্থী যুক্তরাজ্যে গেছেন বলে জানায় এনডিটিভি। তারা এবার চীনের শিক্ষার্থীদের পেছনে ফেলে দিয়েছে।