ইউক্রেইনের বিদ্যুৎ অবকাঠামো ধ্বংসের চেষ্টায় কী ব্যর্থ পুতিন?

প্রচণ্ড শীতের মধ্যে ইউক্রেইনকে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে কিইভকে মাথানত করতে বাধ্য করাই রাশিয়ার উদ্দেশ ছিল।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 March 2023, 03:19 PM
Updated : 11 March 2023, 03:19 PM

ইউক্রেইনে গত বৃহস্পতিবারের আগ পর্যন্ত টানা তিন সপ্তাহ ধরে কোনো লোডশেডিং ছিল। বরং ওই সময়ে দেশটিতে চাহিদার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উ‍ৎপাদন হয়েছে। কারণ, ওই তিন সপ্তাহ রাশিয়া দেশটির কোনো বিদ্যুৎ অবকাঠামোতে হামলা চালায়নি।

গতবছর অক্টোবরের দিকে ইউক্রেইনের সেনাবাহিনীর প্রতিরোধ যুদ্ধে ‍হানাদার রুশ বাহিনী যখন অনেকটাই কোণঠাসা ঠিক সে সময়ে যুদ্ধে নতুন এক কৌশল অবলম্বন করেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

রুশ বাহিনী ইউক্রেইনের একের পর এক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অবকাঠামোতে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চলাতে শুরু করে। গত নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে যে হামলা ভয়াবহ রূপ নেয়।

ফলে তীব্র ঠাণ্ডায় মাইনাসের কাছাকাছি তাপমাত্রায় ইউক্রেইনের অনেক অঞ্চল দিনের পর দিন অন্ধকারে ডুবে থাকে। হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে স্থানীয়দের ঘর গরম রাখার ব্যবস্থা ছাড়াই দিন কাটাতে হয়। এমনকি, বিদ্যুৎ না থাকায় তারা পানির চরম সংকেটেও পড়েন।

কঠিন সে সময়ের অবসান হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি বলেছেন, ‘‘শীতকাল খুবই কঠিন ছিল। তবে কঠিন সে সময় শেষ হয়েছে। ইউক্রেইন এখনো গরম এবং ‍আমাদের দেশ এখনো অটুট আছে।”

তবে বৃহস্পতিবার থেকে পরিস্থিতি আবার পাল্টে গেছে। কারণ, ওইদিন প্রথম প্রহরের দিকে রাশিয়া ৮১টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে এবং ইউক্রেইনের চারটি অঞ্চল বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

রাশিয়া কী তবে ওই তিন সপ্তাহ ধরে অস্ত্র যোগাড় করছিল। তাই তারা ওই সময়ে ইউক্রেইনের বিদ্যুৎ অবকাঠামোতে কোনো আঘাত হানেনি?

শুক্রবারও ইউক্রেইনের দ্বিতীয় বৃহৎ নগরী খারকিভের প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ বিদ্যুৎ বিচ্ছ্ন্নি ছিলেন।

সেখানকার বাসিন্দা ওলেক্সি বলেন, ‘‘এখনো অনেক ঠাণ্ডা। আমাদের খাবার আছে, কিন্তু সেগুলোর কিছু অংশই শুধু রান্না করা আছে।”

ওলেক্সির মোবাইলে তখন মাত্র ১৪ শতাংশ চার্জ আছে। যেহেতু বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই তাই তিনি মোবাইলে চার্জ দিতে স্থানীয় একটি ‘ইনভিনসিবিলিটি সেন্টারে’ যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি লম্বা লাইন দেখতে পান। যারা তার মত একই কারণে সেখানে গেছেন।

বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকা অবস্থায় ‘ইনভিনসিবিলিটি সেন্টারগুলো সাধারণ ইউক্রেইনীয়দের জন্য লাইফ লাইন হয়ে উঠেছিল’।

বৃহস্পতিবার রাজধানী কিইভেও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। একটি হাসপাতাল, যেখানে প্রায় সাতশ মানুষের চিকিৎসা চলছে, সেটিকেও বেশ কয়েকঘণ্টা ঘর গরম করার ব্যবস্থা এবং গরম পানি ছাড়াই চলতে হয়েছে।

রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইউক্রেইনের অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং দেশটির একজন পরমাণু নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ সতর্ক করে বলেছিলেন, পরিস্থিতি গুরুতর হওয়ার দ্বারপ্রান্তে।

তবে সে অবস্থা হয়তো কেটে গেছে বলে আশা করছেন অনেকে।

তেমনই একজন তাতিয়ানা বয়কো। তিনি বলেন, ‘‘এটা এখন নিশ্চিন্তেই বলা যায় যে, ইউক্রেইন বিদ্যুৎ নিয়ে যুদ্ধে জিতে গেছে।

‘‘আসুন প্রার্থনা করি। তবে আমার মনে হয়, সবথেকে খারাপ পরিস্থিতি আমরা পেরিয়ে এসেছি।”

ইউক্রেইনের সবগুলো তাপ ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলার শিকার হয়েছে বলে জানায় বিবিসি।

ইউরোপের সর্ববৃহৎ পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ইউক্রেইনের জাপোরিঝজিয়া পরমাণু বিদ্যুৎ ক্ষেত্র। যেটি কিইভের হাতছাড়া হয়ে গেছে। সেটির দখল নিয়েছে রাশিয়া।

গত বছর অক্টোবর থেকে রাশিয়া ইউক্রেইনের বিদ্যুৎ অবকাঠামোতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে।

তবে শীত যত বেড়েছে, ইউক্রেইনের সেনাবাহিনী পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে আকাশেই ধ্বংস করে দিতে তত দক্ষ হয়ে উঠেছে। ফলে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা দিন দিন অকার্যকর হয়ে পড়তে থাকে।

যদিও রাশিয়া এখন কৌশল বদলেছে এবং তারা এখন কিছুটা ভিন্ন ও আরো দ্রুতগতির ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে। ফলে এই সপ্তাহে ইউক্রেইন রাশিয়ার মাত্র ৩৪টি ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়েছে বলে জানায় বিবিসি।

২০২২ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরুর আগে ইউক্রেইনে চারটি পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপদন ক্ষেত্রে ১৫টি পরমাণু চুল্লি সক্রিয় ছিল।

সেগুলোর মধ্যে জাপোরিঝজিয়ার ছয়টি চুল্লি এখন রাশিয়ার দখলে।

বাকি তিনটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র সাউথ ইউক্রেইন, রিউন ও পশ্চিমের খমেলনিৎস্কিতে। ওই তিনটি পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে বর্তমানে ইউক্রেইনের চাহিদার প্রায় অর্ধেক বিদ্যুতের যোগান আসছে।

রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সংস্কার ও মেরামত করা হয়েছে।

এই খাতে কর্মরত একজন বিবিসিকে বলেন, সূর্যের আলো দিন দিন উজ্জ্বল হচ্ছে, উষ্ণতাও বাড়ছে।

‘‘রাশিয়ার সেনাবাহিনীর জন্য আমাদের দেশকে আতঙ্কিত করে তোলাও দিন দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে।”

শীতকাল জুড়ে ইউক্রেইনের পূর্বমধ্যাঞ্চলের নগরী নিপ্রোকে অনেক ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত সহ্য করতে হয়েছে। এ সপ্তাহেও তার ভিন্নতা ছিল না।

কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহে কোনো বিঘ্ন ঘটেনি।

সেখানকার বাসিন্দা ছোট্ট দুই শিশুর মা ইন্না শ্তানকো বলেন, ‘‘আমাদের নগরী পাল্টে গেছে। শেষ পর্যন্ত সড়কে বাতি জ্বলেছে এবং এই নগরীর সড়কগুলোতে হাঁটতে এখন আর আমরা ভয় পাই না।

‘‘রান্নাবান্না এবং গরম পানিতে গোসল এখন আমাদের দৈনন্দিন রুটিনের অংশ হয়ে গেছে। আমাদের মানসিক অবস্থারও উন্নতি হয়েছে। কারণ, আমাদের পরিবার এবং অন্যান্য মায়েরাও এখন সহজেই দিনের পরিকল্পনা করতে পারছেন।”

আরেক নগরী খেরসনের অবস্থারও উন্নতি হয়েছে। গত নভেম্বরে খেরসন ছেড়ে চলে যায় রুশ বাহিনী।

যদিও যুদ্ধ শুরু পর অনেক মানুষ ইউক্রেইন ছেড়ে চলে গেছেন। তারা এখনো দেশে ফিরতে শুরু করেনি। ফলে সেখানে বিদ্যুতের চাহিদা কমে গেছে।

এছাড়াও, সেখানকার বিদ্যুৎ অবকাঠামো মেরামতের সঙ্গে জড়িতরাও দক্ষ হয়ে উঠেছেন। ফলে বড় ধরনের আঘাতের পরও তারা খুব দ্রুত বিদ্যুৎ অবকাঠামো মেরামত করে বিদ্যুৎ সরবরাহ ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হচ্ছেন।

কিইভের এনার্জি ইনডাস্ট্রি রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক অলেক্সান্ডার খারচেনকো বলেন, ‘‘এটা এখন একটি প্রতিযোগিতার মত হয়ে গেছে: তারা কত দ্রুত আমাদের ক্ষতি সাধন করতে পারে এবং কত দ্রুত আমরা সেটা মেরামত করতে পারি। এবং এই প্রতিযোগিতার আমরাই জিতেছি।”

ঝাইতোমিয়রের বাসিন্দা ইউজিন খেরাসিমচাকের বিশ্বাস এটা অনেকটা এমন, ‘‘ইউক্রেইনের অনেক মানুষই মনে করেন, রাশিয়ার সঙ্গে ১০০ বছর কাটানোর চাইতে একটি শীতল ও অন্ধকার শীতকাল কাটানো বরং অনেক ভালো। তাই আমরা মনে হয়, এটা আমরা ঠিক ম্যানেজ করে নিতে পারবো।”

খারচেনকো বলেন, আবহাওয়ার অবস্থা ভালো হওয়া থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক দাতাদের সহায়তা এবং বিদ্যুৎ খাতে পেশাদার কর্মী, ইউক্রেইনীদের পক্ষে এখন সব কিছুই আছে।

যদিও ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনো বেশ খানিকটা সতর্ক এই পরিচালক।

তবে বলেন, ‘‘আমি বলছি না যে, বিদ্যুৎ নিয়ে এই যুদ্ধে আমরা জিতে গেছি। তবে আমি এটা বলতে পারি, এই শীতকালে বিদ্যুৎ যুদ্ধে আমরাই জিতেছি।”