২০১৯ সালে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) পাসের পর থেকেই ভারতজুড়ে শুরু হয়েছিল বিক্ষোভ। সে সময় ভারত সরকার আইনটি চালু করেনি।
Published : 12 Mar 2024, 12:05 AM
পাস হওয়ার চার বছর পর লোকসভা নির্বাচনের আগে দিয়ে ভারতে চালু হয়ে গেল বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ)।
জল্পনা ছিল আগে থেকেই। সোমবার সে জল্পনাই সত্যি করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার সিএএ কার্যকরের বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে।
২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদী সরকারের পাস করা এ আইনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তানের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ থেকে হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ ও পার্সি সম্প্রদায়ের যেসব মানুষ ধর্মীয় নিপীড়নের মুখে টিকতে না পেরে ভারতে চলে গেছেন, সেইসব শরণার্থীকে ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।
তবে এ আইনে মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্তদের কথা উল্লেখ না থাকায় আইনটি বৈষম্যমূলক বলে সমালোচিত হয়েছে। তাছাড়া, তামিল উদ্বাস্তুদের বাদ দেওয়া নিয়েও আইনটি দক্ষিণ ভারতে বিতর্কিত হয়েছে।
২০১৯ সালে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) পাসের পর থেকেই ভারতজুড়ে শুরু হয়েছিল বিক্ষোভ। এমনকি দাঙ্গাও বাধে রাজধানী দিল্লিতে। ২০২০ সালেও সিএএ বিরোধী বিক্ষোভ চলতে থাকে।
ফলে ভারত সরকার তখন আইনটি চালু করেনি। সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখপাত্র একটি টেক্সট মেসেজে বলেছেন, “মোদী সরকার নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বাস্তাবায়নের ঘোষণা দিচেছ।
“এ আইন ২০১৯ সালে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোর অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর আওতায় নিপীড়িতদের ভারতীয় নাগরিকত্ব লাভের পথ সুগম হবে।”
আইনটি কার্যকর করার কথা এক বিবৃতিতে নিশ্চিত করে জানিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ও। আইনটি নিয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারণা থাকায় এবং কোভিড মহামারীর কারণে এটি চালু হতে দেরি হয়েছে বলে জানানো হয় বিবৃতিতে।
এও বলা হয় যে, “এই আইনটি কেবল তাদের জন্য, যারা বছরের পর বছর ধরে নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছেন এবং ভারত ছাড়া যাদের বিশ্বে আর কোথাও আশ্রয় নেই।”
আইনটি চালু হওয়ায় এখন মঙ্গলবার থেকেই এ আইনে উল্লিখিত দেশগুলো থেকে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শরণার্থীরা নাগরিকত্ব পেতে অনলাইনে আবেদন করতে পারবেন।
মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর পাশাপাশি মুসলিম গোষ্ঠীগুলো বলছে, আইনটি ভারতের ২০ কোটি মুসলিমের জন্য বৈষম্যমূলক হতে পারে। আবার কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন যে, সীমান্ত রাজ্যগুলোতে সরকার কোনও নথি না থাকা মুসলিমদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে পারে।
তবে সরকার বলছে, আইনটি মুসলিম-বিরোধী নয় এবং মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে নিপীড়নের শিকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে সহায়তা করার জন্যই এ আইন প্রয়োজন। এই আইন মানে নাগরিকত্ব মঞ্জুর করা। কারও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া নয়। আইনটির বিরুদ্ধে আগে যে বিক্ষোভ হয়ে এসেছে তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
এ আইন অনুযায়ী, ভিসা বা পাসপোর্টের মতো নথি না থাকলেও ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য উল্লিখিত দেশগুলোর শরণার্থীরা আবেদন করতে পারবেন।
ভারতে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে বলা হয়েছিল, নাগরিকত্ব পেতে টানা এক বছর দেশটিতে থাকতে হবে। এছাড়াও গত ১৪ বছরের মধ্যে ১১ বছর ভারতে থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু সংশোধনী আইনে সেই ১১ বছরের সময়কাল কমিয়ে পাঁচ বছর করা হয়।
২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেই মোদী সরকার ঘোষণা করে যে, ভারতে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করা হবে। সেই মতোই সংশোধনী বিল আনে কেন্দ্র সরকার। পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভা এবং উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় পাস হয়ে যায় সেই বিল। ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বিলে সই করেন।
উত্তর-পূর্ব ভারত থেকেই মূলত আপত্তি উঠেছিল সিএএ নিয়ে। অনেকেরই আশঙ্কা ছিল, সিএএ কার্যকর হলে শরণার্থীদের ভিড় বাড়বে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে। ফলে ভাষাগত এবং সংস্কৃতিগত সমস্যা প্রকোট হতে পারে। নিজেদের ভাষা এবং সংস্কৃতি রক্ষার স্বার্থেই অনেকে সিএএ বিরোধী আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন।
সিএএ-র ৬এ ধারার সাংবিধানিক বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। সিএএ বাতিল আন্দোলনে সোচ্চার থেকেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বরাবরই সিএএ নিয়ে বিরোধিতা করে আসছেন। তার কথায়, নাগরিকত্ব দেওয়াই যদি কেন্দ্র সরকারের মূল লক্ষ্য হয়, তবে নতুন আইনের কী প্রয়োজন? আইনে মুসলিমদের বাদ দেওয়া নিয়েও আপত্তি তার।
বিরোধীদের দাবি, সিএএ ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক নীতি বিরোধী। এ আইনের মাধ্যমে ধর্মের ভিত্তিতে ‘বৈষম্য’ সৃষ্টি করা হচ্ছে। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমারের মতো দেশগুলো কেন বাদ পড়েছে সেটিও প্রশ্নসাপেক্ষ।
তবে মোদী সরকার বিরোধীদের সব অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলছে, এ আইন কার্যকরের ফলে কোনোভাবেই ভারতের কোনও নাগরিকের উপর এর প্রভাব পড়বে না।