ইসরাইলি যুদ্ধ বিমান ‘নির্বিচারে শিশুদের হত্যা এবং আহত’ করছে বলে জানিয়েছে সেভ দ্য চিলড্রেন।
Published : 24 Oct 2023, 04:01 PM
বিশ্বের অন্যতম জনবহুল অথচ ক্ষুদ্র ভূখণ্ড গাজার বাসিন্দাদের জীবনে নরকের বিভীষিকা শুরু হয়েছে গত ৭ সেপ্টেম্বর থেকে। ওইদিন হামাসের হামলার কয়েক ঘণ্টা পর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলের টানা নির্বিচার বিমান হামলায় গাজার চারদিকে এখন শুধু ধ্বংসস্তুপ, হাসপাতালগুলোতে নিহত ও আহতদের স্বজনের আহাজারি।
সঙ্গে যুক্ত হয়েছে খাবার, পানি, জ্বালানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবার তীব্র সঙ্কট।
যুদ্ধের ভয় আর অনিশ্চয়তার এমন চরম মুহূর্তে সন্তানদের চিন্তায় নতুন কৌশল নিতে বাধ্য হচ্ছেন গাজার বাবা-মায়েরা। যেকোনো সময় সন্তান হারিয়ে যেতে পারে, কিংবা বোমার আঘাতে আহত হয়ে হয়ত কোনো হাসপাতালে পড়ে থাকতে পারে, তখন যাতে খুঁজে পাওয়া যায়, সেজন্য তাদের শরীরে নাম লিখে রাখছেন বাবা-মায়েরা।
জনাকীর্ণ হয়ে ওঠা গাজার হাসপাতালগুলোতে এমন অনেক শিশুর দেখাও মিলছে।
একটি আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার মতে, ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর গত কয়েকদিনে গাজায় অন্তত ২০০০ শিশু নিহত হয়েছে। সেখানকার চিকিৎসকরা আশঙ্কা করছেন, ইসরায়েলের জ্বালানি অবরোধের কারণে হাসপাতালে থাকা শিশু ও আহতরাও মারা যেতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো।
সেভ দ্য চিলড্রেন সোমবার জানিয়েছে, গাজায় এখন কোনো নিরাপদ জায়গা নেই। আর এমন একটি জায়গায় ১০ লাখের বেশি শিশু আটকা পড়ে আছে। সংস্থাটি ওষুধের অপ্রতুলতা আর গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য অবকাঠামোতে বিদ্যুৎ না থাকার ভয়াবহ প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছে।
“গাজায় গত ১৭ দিনে অন্তত ২০০০ শিশু নিহত হয়েছে, এছাড়া পশ্চিম তীরে নিহত হয়েছে আরো ২৭ জন,” সোমবার বলেছে সেভ দ্য চিলড্রেন।
ইসরায়েলি যুদ্ধ বিমান ‘নির্বিচারে শিশুদের হত্যা এবং আহত’ করছে জানিয়ে সংস্থাটি বলেছে, “শিশুদের জীবন রক্ষায় আমরা সব পক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সহায়তার হাত বাড়ানোর অনুরোধ করছি।”
শিশুদের খুঁজে পাওয়ার নতুন চেষ্টা
গাজার আল-আকসা মার্টিয়ার্স হাসপাতালের মর্গে স্টিলের ট্রেতে তিনটি শিশুর মরদেহ রাখা। তাদের পায়ের দিক থেকে প্যান্ট ওপরের দিকে তুলে দেখা হচ্ছিল, কালো কালিতে কোনো নাম লেখা আছে কী না।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক আবদুল রহমান আল মাসরি বলেন, “আমরা বেশ কয়েকটি ঘটনায় দেখেছি, বাবা-মায়েরা সন্তানদের পা কিংবা পেটে তাদের নাম লিখে রাখছে।”
যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হতে পারে এবং হয়ত তখন সন্তানদের শনাক্ত করা যাবে না, এমন শঙ্কায় ভুগছেন অভিভাবকরা।
“এর মানে হচ্ছে, তারা ভাবছে, যে কোনো সময় তারা (হামলায়) আহত হবে নয়ত মারা যাবে।”
এই হাসপাতালের যে কক্ষে মরদেহ গোসল করানো হয়, সেখানে দায়িত্বরত কর্মকর্তা বলেন, “আমরা দেখতে পাচ্ছি অনেক অভিভাবকই তাদের সন্তানদের পায়ে নাম লিখে রাখছেন, যাতে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া কিংবা হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের বিমান হামলার পর খুঁজে পাওয়া যায়। এটি নতুন একটি কৌশল, যা গাজায় সম্প্রতি শুরু হয়েছে।
“এরই মধ্যে অনেক শিশু নিখোঁজ হয়েছে, অনেক শিশু এখানে এসেছে, যাদের মাথার খুলি ভেঙ্গে গেছে…তাদের চেনাই মুশকিল। শুধু এমন লেখা (পায়ে নাম লেখা) থাকলেই সম্ভব।”
গাজায় বিমান হামলার পাশাপাশি ইসরায়েল ‘পুরোপুরি অবরোধ’ আরোপ করায় ওষুধ, খাবার, পানি, জ্বালানিসহ জরুরি সব সেবা বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানকার হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকরা কোনো ধরনের ব্যথানাশক ছাড়াই আহতদের অস্ত্রোপচার করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানিয়েছে ডক্টরস উইদাউট বর্ডার।
সরবরাহ কমতে থাকার অর্থ হচ্ছে, অস্ত্রোপচারে “সঠিক মাত্রায় ব্যথানাশক ব্যবহার হচ্ছে না, সঠিক মাত্রায় মরফিন ব্যবহার হচ্ছে না,” বলেন জেরুজালেমে এই গ্রুপের মিশন প্রধান লিও কান।
তিনি বলেন, “…আমাদের এখন মরফিন ছাড়াই অস্ত্রোপচার করতে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত দুটি শিশুর ক্ষেত্রে এটি করতে হয়েছে। আমাদের কাছে আহত যারা আসছে, দুর্ভাগ্যবশত তাদের মধ্যে অনেক শিশু থাকছে।
“আমি আমাদের একজন সার্জনের সাথে কথা বলেছি, যিনি ১০ বছর বয়সী একটি শিশুকে ব্যথানাশক ছাড়াই চিকিৎসা দিয়েছেন। শিশুটির শরীরের ১০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল।”
“বিপুল জনগোষ্ঠীর কাছে জরুরি ওষুধ সরবরাহে বাধা দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই,” বলেন লিও কান।
যে কেউ যে কোনো সময় মারা যেতে পারে, এমন শঙ্কা থেকে গাজার অভিভাবকরা সন্তানদের পায়ে-উরুতে নাম লিখে রাখছেন, এমন খবর তিনিও পেয়েছেন বলে জানান কান।
কান বলেন, তার সহকর্মীরা জানিয়েছেন, বাঁচা-মরা একসাথেই- এমন ভাবনায় অনেক পরিবারের সব সদস্য মিলে একটি কক্ষে দিন কাটাচ্ছে।
গাজায় এখন সবচেয়ে বেশি অভাব জ্বালানির। কারণ হাসপাতাল, পানির পাম্পগুলো চালাতে জ্বালানি ছাড়া উপায় নেই। এরই মধ্যে জ্বালানি সঙ্কট অনুভব করতে পারছেন চিকিৎসকরা।
“পানি লবণাক্ততা মুক্ত করতে প্ল্যান্টগুলোতে জ্বালানি জরুরি দরকার। জ্বালানি পাওয়া না গেলে বিশুদ্ধ পানিও পাওয়া যাবে না,” বলেন লিও কান।
গাজার বাসিন্দারা ইতিমধ্যে অপরিশোধিত পানি পান করতে শুরু করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, এতে ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রতি একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে, সেখানে আল-শিফা হাসপাতালের নবজাতক বিভাগের চিকিৎসক প্রধান ফুয়াদ আল-বুলবুল বলেছেন, জ্বালানি সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে তার চিকিৎসাধীনে থাকা সব শিশু মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়বে।
“বিদ্যুৎ বন্ধ হলে এই ইউনিটে বিপর্যয় ঘটবে; ভেন্টিলেটরে থাকা এখানকার বেশিরভাগ শিশু মারা যাবে। কারণ একজন-দুইজনকে বাঁচাতে পারব, সবাইকে না।”
তার বিভাগে ইনকিউবেটর রয়েছে ৪৫টি এবং এখানে অপরিণত অবস্থায় জন্ম নেওয়া শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হয়।
ডা. আল-বুলবুল জানান, রোববারের মধ্যেই তার হাসপাতালে সারফ্যাকট্যান্ট ও ক্যাফেইন সাইট্রেট ফুরিয়ে গেছে। এ ধরনের জটিলতা নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুদের শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখতে সাধারণত এই দুটি উপাদান ব্যবহার করা হয়।
বেশিরভাগ শিশুর অবস্থাই জটিল এবং তার টিমের সদস্যরাও টানা ১৮ দিন ধরে কাজ করে ভয়ানক ক্লান্ত।
গাজার দক্ষিণাঞ্চলের আল নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, অক্সিজেনের ওপর নির্ভর অপরিণত শিশুরা মারা যাবে, যদি জরুরিভাবে সরবরাহ না পাওয়া যায়।
হাসপাতালটির নবজাতক বিভাগের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের প্রধান ডা. হাতেম ইধাইর জানিয়েছেন, ভেন্টিলেটর, মনিটরের মতো জরুরি যন্ত্রগুলো চালানোর মতো জ্বালানি পাওয়া না গেলে ইউনিটে থাকা ১১ শিশুর একজনকেও বাঁচানো যাবে না।