ব্রিটিশ রাজার কাজ আসলে কী?

রাজা যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রপ্রধান হলেও তার বেশিরভাগ ক্ষমতাই আসলে প্রতীকী।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 May 2023, 04:48 PM
Updated : 5 May 2023, 04:48 PM

এক সময় দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হলেও ইংল্যান্ড হোক, গ্রেট ব্রিটেন হোক কিংবা যুক্তরাজ্য হোক, এখন রাজার পদটি কেবলই আলঙ্কারিক। রাজা যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রপ্রধান হলেও তার বেশিরভাগ ক্ষমতাই আসলে প্রতীকী, আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ।

রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পরপরই যুক্তরাজ্যের রাজা হয়েছেন তৃতীয় চার্লস। আগামী ৬ মে লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে ৪০তম ব্রিটিশ রাজা হিসেবে তার রাজ্যাভিষেক হতে যাচ্ছে। সেদিনই আনুষ্ঠানিকভাবে রাজমুকুট উঠবে তার শিরে।

যুক্তরাজ্যের রাজা হিসেবে তৃতীয় চার্লস কী করবেন কিংবা রাজা আসলে কী করে থাকেন, আনুষ্ঠানিক অভিষেকের আগে তা তুলে ধরেছে বিবিসি।

রাজা কী করেন?

ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে প্রতিদিন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাজার কাছে একটি লাল চামড়ায় মোড়া বাক্সে দৈনন্দিন কাজের ফিরিস্তি ও নথিপত্র আসে, যার মধ্যে থাকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সভার সারসংক্ষেপ, অথবা তার স্বাক্ষরের জন্য পাঠানো নথি।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী সাধারণত প্রতি সপ্তাহের বুধবার বাকিংহ্যাম প্রাসাদে রাজার সঙ্গে দেখা করতে যান এবং সরকারের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তাকে জানান।

এই বৈঠকগুলো পুরোপুরি ব্যক্তিগত এবং এসব বৈঠকের কোনো আনুষ্ঠানিক রেকর্ড রাখা হয় না।

এছাড়া পার্লামেন্টের জন্য কিছু আনুষ্ঠানিক ভূমিকা পালন করতে হয় রাজাকে।

  • সরকার নিয়োগ করা: যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী রাজনৈতিক দলের দলনেতাকে সাধারণত বাকিহ্যাম প্রাসাদে ডাকা হয় এবং তাদেরকে সরকার গঠন করতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাছাড়া একটি সাধারণ নির্বাচনের আগে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি সরকার ভাঙার কাজটিও করতে হয় রাজাকে।

  • স্টেট ওপেনিং ও রাজার ভাষণ: রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাজা ‘স্টেট ওপেনিং সেরেমনি’র মাধ্যমে পার্লামেন্টারি বছর শুরু করেন। ওই অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণে তিনি সরকারের পরিকল্পনা তুলে ধরেন। হাউজ অব লর্ডসের সিংহাসন থেকে এই ভাষণ দেন তিনি।

  • রাজার সম্মতি: যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে একটি বিধি পাস করার পর তা আইনে পরিণত হতে হলে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজার অনুমোদন পেতে হবে। শেষবার এ ধরনের বিধি রাজার অনুমোদন না পাওয়ার ঘটনাটি ঘটেছিল ১৭০৮ সালে।

এছাড়া লন্ডনের সেনোটাফে প্রতি বছর নভেম্বরে বার্ষিক স্মরণ অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দেন রাজা।

এসবের বাইরে সফররত রাষ্ট্রপ্রধানদের আতিথেয়তার কাজটিও রাজার উপর ন্যস্ত। তিনি নিয়মিত যুক্তরাজ্যে নিয়োজিত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাই কমিশনারদের সাক্ষাৎ দিয়ে থাকেন।

নিজের প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে রাজা চার্লস জার্মানি সফর করেন এবং সেখানে প্রথম ব্রিটিশ রাজা হিসেবে জার্মানির পার্লামেন্টে বক্তৃতা করেন।

যুক্তরাজ্যের রাজার আরেকটি বড় দায়িত্ব হচ্ছে কমনওয়েলথের নেতৃত্ব দেওয়া। এক সময়ের ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে শাসিত বিশ্বের ৫৬টি স্বাধীন দেশের জোট হচ্ছে কমনওয়েলথ, যা পৃথিবীর ২৫০ কোটি মানুষের আবাসস্থল। পদাধিকার বলে এই কমনওয়েলথের প্রধান হচ্ছেন যুক্তরাজ্যের রাজা বা রানি।

এছাড়া বিশ্বের ১৪টি দেশ ও অঞ্চলের রাষ্ট্রপ্রধানও রাজা তৃতীয় চার্লস, যে দেশ ও অঞ্চলগুলো ‘কমওয়েলথ রেমস’ হিসেবে পরিচিত।

রাজার স্ত্রী, কুইন কনসোর্ট ক্যামিলা রাজাকে এসব কাজ ও আনুষ্ঠানিকতা পালনে সাহায্য করে থাকেন এবং বর্তমানে ৯০টি দাতব্য প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করার অংশ হিসেবে তিনি বিভিন্ন পাবলিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে থাকেন। এসব কার্যক্রমের অনেকগুলোই মূলত ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার মানুষদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণের লক্ষ্যে পরিচালিত।

রাজ পরিবারে কারা কারা?

  • যুবরাজ: প্রিন্স উইলিয়াম হচ্ছেন রাজা তৃতীয় চার্লস ও তার সাবেক প্রয়াত স্ত্রী প্রিন্সেস ডায়ানার বড় ছেলে। রানির মৃত্যুর পর চার্লস রাজা এবং তার উত্তরাধিকারী হিসেবে উইলিয়াম প্রিন্স অব ওয়েলস এবং ডিউক অব কর্নওয়াল পদবিতে উন্নীত হন। এছাড়া ডিউক অব কেমব্রিজ পদবিও বহন করছেন তিনি। তার স্ত্রী ক্যাথরিনের পদবি হচ্ছে প্রিন্সেস অব ওয়েলস এবং ডাচেস অব কর্নওয়াল অ্যান্ড কেমব্রিজ। উইলিয়াম-কেইট দম্পতির তিন সন্তান- প্রিন্স জর্জ, প্রিন্সেস শার্লট ও প্রিন্স লুই।

  • দ্য প্রিন্সেস রয়াল (প্রিন্সেস অ্যান): প্রিন্সেস অ্যান হচ্ছেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের দ্বিতীয় সন্তান ও একমাত্র মেয়ে। তিনি রাজা চার্লসের বোন। তার স্বামী ভাইস অ্যাডমিরাল টিমোথি লরেন্স। সাবেক স্বামী ক্যাপ্টেন মার্ক ফিলিপসের সঙ্গে তার দুই সন্তান রয়েছে - পিটার ফিলিপস ও জারা টিনডাল।

  • দ্য ডিউক অব এডিনবরা (প্রিন্স এডওয়ার্ড): প্রিন্স এডওয়ার্ড রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সবচেয়ে ছোট ছেলে। তার স্ত্রী ডাচেস অব এডিনবরা সোফি রিস-জোনস। এই দম্পতিরও দুই সন্তান লেডি লুইস উইন্ডসর ও দ্য আর্ল অব ওয়েসেক্স জেমস মাউন্টব্যাটেন-উইন্ডসর।

  • দ্য ডিউক অব ইয়র্ক (প্রিন্স অ্যান্ড্রু): রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের তৃতীয় সন্তান ও দ্বিতীয় ছেলে প্রিন্স অ্যান্ড্রু। সাবেক স্ত্রী ডাচেস অব ইয়র্ক সারাহ ফারগুসেনের সঙ্গে তার দুই সন্তান রয়েছে  প্রিন্সেস বিয়াট্রিচ ও প্রিন্সেস ইউজিন। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এক নারী ভার্জিনিয়া জেফরিকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠায় ২০১৯ সালে তিনি ‘সক্রিয় রাজকার্য’ থেকে সরে দাড়ান।

  • দ্য ডিউক অব সাসেক্স (প্রিন্স হ্যারি): রাজা চার্লস ও তার প্রয়াত স্ত্রী প্রিন্সেস ডায়ানার ছোট ছেলে প্রিন্স হ্যারি। প্রিন্স উইলিয়ামের ছোট ভাই হ্যারি বিয়ে করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক মেগান মার্কেলকে, যিনি এখন ডাচেস অব সাসেক্স। হ্যারি-মেগান দম্পতির দুই সন্তান প্রিন্স আর্চি ও প্রিন্সেস লিলিবেট। ২০২০ সালে এই দম্পতি ঘোষণা দেন যে তারা রাজসিক পদ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

কীভাবে উত্তরাধিকার ঠিক হয়?

রাজার মৃত্যুর পর বা কোনো কারণে রাজা সিংহাসনচ্যুত হলে তার উত্তরাধিকার কীভাবে নির্বাচিত হবেন বা কে সিংহাসনে আরোহন করবেন, তার ধারাবাহিকতা খুবই স্পষ্টভাবে নির্দেশিত রয়েছে যুক্তরাজ্যের রাজ পরিবারে।

সিংহাসনের প্রথম উত্তরাধিকার হিসেবে রাজমুকুটের দাবিদার হচ্ছেন রাজার সবচেয়ে বড় সন্তান। যেমন বর্তমানে প্রিন্স উইলিয়াম।

২০১৩ সালে এই রাজকীয় উত্তরাধিকারের নীতিতে সংশোধনী আনা হয় এটা নিশ্চিত করতে, যাতে শুধু ছেলে হওয়ার কারণে বড় বোনের আগে কেউ সিংহাসনের দাবি করতে না পারে। অর্থাৎ রাজা বা রানির বড় সন্তান যদি মেয়ে হয়, তাহলে সেই হবে সিংহাসন ও রাজমুকুটের প্রথম উত্তরাধিকার।

সিংহাসনের উত্তরাধিকারের পরের অবস্থানটি প্রিন্স অব ওয়েলস উইলিয়ামের বড় ছেলে প্রিন্স জর্জের। এরপর রয়েছে তার মেয়ে প্রিন্সেস শার্লট ও ছোট ছেলে প্রিন্স লুই।

উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতায় উইলিয়ামের ছোট ভাই প্রিন্স হ্যারির অবস্থান পঞ্চম। 

রাজা থাকেন কোথায়?

রাজা চার্লস ও তার স্ত্রী ক্যামিলা লন্ডনের বাকিংহ্যাম রাজপ্রাসাদে থাকেন, যেখানে আগে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ থাকতেন। এর আগে তারা লন্ডনের ক্ল্যারেন্স হাউজ ও গ্লস্টারশায়ারের হাইগ্রোভে বসবাস করতেন।

এছাড়া যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্থানে রাজভবনের মধ্যে আছে নরফোকের স্যান্ড্রিংহ্যামের উইন্ডসর প্রাসাদ, এডিনবরার দ্য প্যালেস অব হলিরুডহাউজ ও অ্যাবারডিনশায়ারের বালমোরাল প্রাসাদ।

২০২২ সালের অগাস্ট থেকে প্রিন্স ও প্রিন্সেস অব ওয়েলস তাদের কেনিংসটন প্রসাদ ছেড়ে এখন পশ্চিম লন্ডনে উইন্ডসর এস্টেটের অ্যাডেলেইড কটেজে বসবাস করছেন।

রাজ পরিবার কতটা জনপ্রিয়?

রাজা চার্লসের রাজ্যাভিষেক সামনে রেখে সম্প্রতি বিবিসির প্যানারোমা জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইউগভকে দিয়ে একটি জনমত জরিপ পরিচালনা করেছে।

জরিপের ফল বলছে, দেশের ৫৮ শতাংশ জনগোষ্ঠী এখনও রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখার পক্ষে মত দিচ্ছে, এর বিপরীতে নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান ব্যবস্থা চালুর পক্ষে মত দিয়েছে ২৬ শতাংশ ব্রিটিশ।

তবে এই গড় ফলাফলের গভীরের বিশ্লেষণটি আবার অনেকটাই বৈচিত্র্যময়। বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠীর কাছে রাজতন্ত্রের আবেদন কমছে।

জরিপে অংশ নেওয়াদের মধ্যে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী ৭৮ শতাংশই রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখার পক্ষে। অন্যদিকে ১৮ থেকে ২৪ বছরের জনগোষ্ঠীর মাত্র ৩২ শতাংশ এই মত প্রকাশ করেছে। এই তরুণ জনগোষ্ঠীর ৩৮ শতাংশ নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান দেখতে চায়, আর ৩০ শতাংশ এ বিষয়ে অনিশ্চিত।

সবমিলিয়ে এই জরিপে অংশ নেওয়া তুলনামূলক তরুণ জনগোষ্ঠীর ৭৮ শতাংশই রাজ পরিবার নিয়ে আগ্রহী নয়।

Also Read: দ্বিতীয় এলিজাবেথ: যার আলোয় উজ্জ্বল হয়েছে ব্রিটিশ সিংহাসন

Also Read: আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটেনের রাজা হলেন তৃতীয় চার্লস

Also Read: অভিষেক অনুষ্ঠান আসন্ন, কতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারবেন রাজা চার্লস

Also Read: ব্রিটিশ রাজতন্ত্র ‘দুই প্রজন্মের মধ্যে শেষ হয়ে যেতে পারে’