“মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর চেয়ে তারা বরং আমাদের মেরে ফেলুক।”
Published : 25 Aug 2022, 06:29 PM
চার বছর ধরে ইয়াসমিন একটি অনিশ্চয়তায় ভরা জীবন পার করছে এবং এখনও জানে না কোথায় রয়েছে সে।
বাংলাদেশের একটি শরণার্থী শিবিরে ইয়াসমিনের জন্ম হলেও সে তার পৈতৃক বসতভিটা মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারছে না। বর্তমানে ভারতের রাজধানী দিল্লির একটি নোংরা ঘরই তার ঠিকানা।
মিয়ানমারের সংখ্যালঘু লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মতো ইয়াসমিনের মা-বাবাও ২০১৭ সালে সামরিক বাহিনীর অভিযান থেকে বাঁচতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসেন। জাতিসংঘ রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওই অভিযোনকে ‘জাতিগত নিধনের ধ্রুপদী উদাহরণ’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রও একে ‘জেনোসাইড’ হিসাবে বর্ণনা করেছে।
জীবন বাঁচাতে দেশত্যাগ করা ওইসব রোহিঙ্গাদের অনেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মতো প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে গিয়ে সেখানে আশ্রয় নেন, যেখানে তারা শরণার্থীর জীবন পার করছেন।
রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আসার ঢল শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট। পরবর্তীতে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়।
জাতিসংঘের মতে বিশ্বের বৃহত্তম উদ্বাস্তু জনসংখ্যা রোহিঙ্গা মুসলমানরা। মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর নিপীড়ন থেকে বাঁচতে দেশ ছেড়ে পালানোর পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও তারা অবহেলিতই রয়ে গেছে।
ইয়াসমিনের বাবা রেহমান নিজ মাতৃভূমি মিয়ানমারে ব্যবসা করতেন। দেশটির সামরিক জান্তা নৃশংস আক্রমণ শুরু করলে অন্য সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গার মতো তিনিও দেশ ছেড়ে পালান।
কয়েকদিন হাঁটতে হাঁটতে রেহমান ও তার স্ত্রী মাহমুদা বাংলাদেশের কক্সবাজারের একটি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন। সেখানে এই দম্পতি ছোট জায়গায় অন্যদের সঙ্গে নানা সমস্যার মধ্যে দিয়ে থাকতে শুরু করেন। সেখানে তাদের নিয়মিত খাবার জুটতো না। দাতব্য সংস্থা থেকে যা পেতেন তা খেয়ে-পরেই তাদের জীবন চালাতে হচ্ছিল।
বাংলাদেশে আসার এক বছর পর তাদের মেয়ে ইয়াসমিনের জন্ম হয়।
বিবিসি জানিয়েছে, বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। কয়েক হাজার শরণার্থীকে ভাসানচর নামে একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে স্থানান্তর করা হয়েছে, যাকে শরণার্থীরা ‘দ্বীপ কারাগার’ বলছেন।
রেহমান ভেবেছিলেন বাংলাদেশ ছেড়ে গেলে তার সন্তানের ভবিষ্যত ভালো হবে। তাই ২০২০ সালে ইয়াসমিনের বয়স যখন দুবছর, তখন তারা প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে যান।
বিভিন্ন শরণার্থী সংস্থা বিভিন্ন রকম তথ্য দিলেও ভারতে মোটামুটি ১০ হাজার থেকে ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। ২০১২ সাল থেকেও অনেক রোহিঙ্গা সেদেশে আশ্রয় নিয়ে আছেন।
বিচ্ছিন্ন কিছু নৃশংসতার ঘটনা ঘটলেও বছরের পর বছর ধরে ভারতে রোহিঙ্গারা মোটামুটি শান্তিপূর্ণ জীবন-যাপনই করে আসছিল। তাদের নিয়ে খুব বেশি বিতর্ক সেখানে ছিল না।
কিন্তু এ মাসের শুরুতে ভারতের একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী টুইটারে এক বার্তায় দিল্লিতে বসবাস করা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আবাসনের সুযোগ-সুবিধা ও পুলিশি সুরক্ষা দেওয়ার ঘোষণা দিলে সেদেশে রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি নিয়ে নতুন করে খবর প্রকাশ পেতে শুরু হয়।
ওই মন্ত্রীর টুইটার পোস্টের কয়েক ঘণ্টা পর ভারতের ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওইসব সুবিধা দেওয়ার কথা অস্বীকার করে।
বরং রোহিঙ্গাদের ‘অবৈধ বিদেশি’ উল্লেখ করে তাদের নির্বাসন বা আটক কেন্দ্রে পাঠানো উচিত বলে মন্তব্য করে।
ভারত সরকারের এই সুর পরিবর্তন রেহমানের মতো পরিবারগুলোকে হতাশ করে তুলেছে।
বিবিসিকে রেহমান বলেন, “আমার সন্তানের ভবিষ্যত অন্ধকার বলে মনে হচ্ছে। এমন কী ভারত সরকারও আমাদের চায় না ...।”
আক্ষেপ করে রেহমান আরো বলেন “মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর চেয়ে তারা বরং আমাদের মেরে ফেলুক।”
বিবিসি লিখেছে, কোনো দেশই মিয়ানমারের লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে রাখতে চায় না। গত সপ্তাহে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেটকে বলেছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবশ্যই বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে ফিরে যেতে হবে।
তবে জাতিসংঘ বলেছে, মিয়ানমারে চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতিতে তাদের সেখানে ফেরত পাঠানো অনিরাপদ হবে।
রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করে দেশ থেকে বিতাড়িত করার অভিযোগ ওঠা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীই গত বছর পহেলা ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চি সরকারকে হটিয়ে দেশটির ক্ষমতা দখল করে।
জান্তা বাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতন থেকে বাঁচতে প্রতি বছর শত শত রোহিঙ্গা মালয়েশিয়া ও ফিলিপিন্সে যেতে সাগরের বিপজ্জনক পথে যাত্রা করে।
বিবিসি জানায়, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে, যাদের অর্ধেকই শিশু।
রেহমানের মতো কোতিজা বেগমও ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসেন। তিনদিন কোনো খাবার ছাড়াই তারা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটেছিলেন।
তিন সন্তান নিয়ে কোতিজা কক্সবাজারের একটি শরণার্থী ক্যাম্পের ছোট একটি কক্ষে বসবাস করেন। মাথার উপর প্লাস্টিক শিটের চালা। তাই বৃষ্টি হলেই পরিবারটিকে পড়তে হয় ব্যাপক দুর্ভোগে।
মাতৃভূমি ছেড়ে পালিয়ে আসার ভয়ঙ্কর সেই স্মৃতি এখনও কোতিজার মনে তাজা।
তিনি বলেন, “সেনারা আমাদের বাড়িতে ঢুকে অত্যাচার শুরু করে। তারা গুলি করতে শুরু করলে দৌড়ে পালিয়ে আমরা জীবন রক্ষা করি। বাচ্চাদের নদীতে ফেলা দেওয়া হয়েছে। সামনে যাকেই পেয়েছে তাকেই তারা হত্যা করেছে।”
শরণার্থী ক্যাম্পে অন্যদের মতো কোতিজাকে বিভিন্ন এনজিও ও দাতব্য সংস্থার রেশনের ওপর নির্ভর করতে হয়। ডাল-ভাতের মতো প্রয়োজনীয় খাবার প্রায়ই তাদের কপালে জোটে না।
কোতিজার ভাষ্য, “আমি তাদের (বাচ্চাদের) খাবার দিতে পারি না, ভালো পোশাক দিতে পারি না এবং যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থাও করতে পারি না।”
সন্তানদের লেখার জন্য কলম কিনতে মাঝে-মধ্যে রেশনও বিক্রি করেন বলে জানান কোতিজা।
জাতিসংঘের সাম্প্রতিক একটি পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সাহায্যের জন্য আন্তর্জাতিক তহবিলের ঘাটতি এই বিশাল জনসংখ্যার জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। শরণার্থীদের পুষ্টিকর খাবার, পর্যাপ্ত আশ্রয়, স্যানিটেশন এবং কাজের সুযোগ পেতে সংগ্রাম করতে হচ্ছে।
কোতিজা বেগমের কাছে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
সেখান একটি প্রজন্মের হারিয়ে যাওয়ার মত উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, যারা মানসম্মত শিক্ষা পাচ্ছে না।
কোতিজা বলেন, “এখানে বাচ্চা-কাচ্চারা প্রতিদিন স্কুলে যায়, কিন্তু তাদের কোনো উন্নতি নেই। তারা ভালো শিক্ষা পাচ্ছে বলে আমার মনে হয় না।”
বিবিসি জানিয়েছে, কক্সবাজারের ক্যাম্পে বসবাসরত শিশুদের মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম শেখানো হয়। যা বাংলাদেশের কোনো স্কুলে পড়ানো হয় না।
যদিও শিক্ষা কর্মসূচির সঙ্গে যুক্তরা বলছেন, মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম শেখানোর অর্থ একদিন তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করা। অন্যরা মনে করেন, এটি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশিদের থেকে আলাদা রাখার উপায়।
শরণার্থী কোতিজা বেগমের ভাষ্য, “তারা শিক্ষিত হলে সুন্দর জীবন পাবে। তারা নিজেদের জন্য আয় করতে পারবে এবং ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারবে।”
দিল্লিতে চার বছরের মেয়েকে কোলে নিয়ে একই কথা বিবিসিকে বলেছেন রেহমান।
বলেন, “আমি তাকে (মেয়েকে) সঠিক শিক্ষা এবং উন্নত জীবন দেওয়ার স্বপ্ন দেখি, কিন্তু আমি তা দিতে পারছি না।”
মিয়ানমার জান্তার দমন-পীড়নে দেশ ছেড়ে পালানোর পাঁচ বছর পরও রোহিঙ্গারা ন্যায় বিচারের প্রত্যাশা করেন। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মিয়ানমারের জান্তার বিরুদ্ধে হওয়া একটি মামলার শুনানি শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে।
তবে সব কিছুর উপরে তারা যে স্বপ্ন দেখেন সেটা হলো একদিন বাড়িতে ফিরে যাওয়া।
কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের এই দেশে ফেরার বিষয়টি নিরাপদ না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত রেহমানের মতো উদ্বাস্তুরা বিশ্বের কাছে আরও সহায়তা ও সহানুভূতি দেখানোর অনুরোধ জানিয়েছেন।
রেহমান বলেন, “আমি এখানে চুরি করতে আসিনি, জীবন বাঁচাতে এসেছি।”
আরও খবর
রোহিঙ্গা সঙ্কটের ৫ বছর: আটকে প্রত্যাবাসন, চিন্তা বাড়াচ্ছে জন্মহার
বছরে যোগ হচ্ছে ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা শিশু: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে সর্বসম্মত প্রস্তাব