প্রেম, দ্রোহ, শিল্প: লাল রক্তের কত ভাষা!

নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু বলেছিলেন, ‘আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামী এই নেতার বচন থেকেই ‘ব্লাড পেইন্টিং’ তৈরির প্রেরণা পাওয়ার কথা জানান প্রেম কুমার।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Jan 2023, 03:33 AM
Updated : 10 Jan 2023, 03:33 AM

এক দশকের বেশি সময় ধরে রক্ত দিয়ে চিত্রকর্ম তৈরি করে আসছে ভারতের অলাভজনক সংগঠন ‘শহীদ স্মৃতি চেতনা সমিতি’; দেশের বিপ্লবী ও শহীদদের সম্মানে আড়াইশর বেশি শিল্পকর্ম তৈরি করেছে সংগঠনটি।

সমিতির সদস্যরা নিজেদের রক্ত দিয়েই এসব চিত্রকর্ম বানিয়ে বিভিন্ন আশ্রম আর ছোট জাদুঘরে পাঠিয়েছেন; প্রদর্শনীতেও ব্যবহার করেছেন। রক্তের এমন ব্যবহার নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি।

সংগঠনটির প্রধান প্রেম কুমার শুক্লা বিবিসিকে বলেন, “কোনো কিছুর প্রতীক তুলে ধরার সমৃদ্ধ মাধ্যম হলো রক্ত। শিশুদের মধ্যে দেশের প্রতি ভালোবাসা কমে যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করার জন্য আমরা রক্ত দিয়ে ছবি আঁকি।”

দিল্লিভিত্তিক শহীদ স্মৃতি চেতনা সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক রবি চন্দর গুপ্ত । শুরুতে ১০০ পেইন্টিংয়ের জন্য তিনি রক্ত দান করেছিলেন।

এক সাক্ষাতকারে রবি চন্দর বলেছিলেন, “মানুষের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য আমি এই কাজ শুরু করেছিলাম। রক্ত দিয়ে বানানো চিত্রকর্মগুলোতে তাদের আগ্রহ বেশি। কারণ রক্ত মানুষের মধ্যে আবেগের জন্ম দেয়।”

২০১৭ সালে মারা যান রবি চন্দ। তার উত্তরসূরী ৫০ বছর বয়সী সাহসী প্রেম কুমার শুক্লাও একজন স্কুল শিক্ষক ও কবি। তার দাবি, তিনি ১০০ পেইন্টিংয়ের জন্য একাই রক্ত দান করেছেন।

বিবিসি জানিয়েছে, প্রেম কুমারের মত দাতারা স্থানীয় ল্যাবে গিয়ে রক্ত দেন। রক্ত সংগ্রহের পর জমাট বাঁধা এড়াতে মেশানো হয় ‘অ্যান্টি-কোয়াগুল্যান্ট’; এতে রক্ত আঠালো হয়ে যায়। এরপর ৫০ মিলিলিটারের বোতলে ভরে তা শিল্পীদের দেওয়া হয়।

সাধারণত ১০০ মিলিলিটার রক্ত দুই বা তিনটি চিত্রকর্ম তৈরির জন্য যথেষ্ট। প্রেমকুমার তার সংগঠনের পেইন্টিংয়ের জন্য বছরে চারবার রক্ত দিয়ে থাকেন।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু বলেছিলেন, ‘আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামী এই নেতার বচন থেকেই ‘ব্লাড পেইন্টিং’ তৈরির প্রেরণা পাওয়ার কথা জানান প্রেম কুমার।

রক্ত রূপক অর্থও তৈরি করে। মহাত্মা গান্ধীর প্রত্যাশা ছিল, ভারতীয়দের শরীরে এমন রক্ত বইবে যা দুর্নীতি রুখবে এবং সেখানে ঔপনিবেশিক সংঘাতের বিষ থাকবে না।

১৯৪৮ সালে গান্ধীকে হত্যা করা হয়। তার সেই রক্তমাখা জামাটি পরে রাখা হয় দক্ষিণ ভারতের মাদুরাইয়ের একটি জাদুঘরে।

ভারতে রক্ত আনুগত্য ও উৎসর্গেরও প্রতীক। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রতিকৃতি রক্ত দিয়ে এঁকেছিলেন তার অনুগত সমর্থকেরা।

একইসঙ্গে রক্ত প্রতিবাদের ভাষা। ২০১৩ সালে ভারতের গুজরাটের একটি গ্রামের ১০০ নারী রক্ত দিয়ে মোদীকে চিঠি লিখেছিলেন। একটি নতুন রাস্তা তৈরির জন্য তাদের জমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন সেই চিঠিতে।

ওই নারীরা জানান, তারা পোস্টকার্ডে মোদীকে তাদের কথা তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী উত্তর দেননি। উত্তরপ্রদেশের এক কিশোরী রক্ত দিয়ে চিঠি লিখে তার মাকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যার বিচার চেয়েছিল সরকারের কাছে।

মজুরি বৃদ্ধি, হাসপাতাল ও স্কুল নির্মাণ এবং কঠোর আইন বাতিলের দাবিতেও রক্ত দিয়ে আবেদন লিখেছেন ভারতের বিক্ষোভ-আন্দোলকারীরা।

কেউ আবার রক্ত দিয়ে প্রেমপত্রও লেখেন। রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে নিয়মিতই অভিযোগ করা হয়, ‘তারা জনগণের রক্ত চুষে খায়’। মূলত রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি আর লাল ফিতার দৌরাত্ম বোঝাতে রূপক অর্থে রক্তের প্রসঙ্গ টানা হয়।

১৯৮৪ সালে ভারতের ভোপালে গ্যাস দুর্ঘটনায় ভুক্তভোগীরা ২০০৮ সালে দিল্লি অভিমুখে ৮০০ কিলোমিটার পদযাত্রা করেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে তারা রক্তে লেখা চিঠিতে নিজেদের স্বাস্থ্য ও আর্থিক দূরাবস্থার চিত্র তুলে ধরেন।

১৯৮০ সালে তেল সমৃদ্ধ আসামে বিক্ষোভ চলাকালে ২২ বছর বয়সী এক তরুণ রাজধানী গুয়াহাটিতে স্লোগান হিসেবে রক্ত দিয়ে লিখেছিলেন- ‘আমরা রক্ত দেব, তবু তেল দেব না’।

পশ্চিমবঙ্গে একটি পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরির অর্থায়নের জন্য ১৯৮৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্কসবাদী) দলের সমর্থকদের রক্ত বিক্রি করার পরামর্শ দিয়েছিল।ওই পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণে অর্থায়ন নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বিতর্ক তৈরি হলে এ আহ্বান জানায় দলটি।

ঘোষণা অনুযায়ী, কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থকরা রক্ত সংগ্রহ শুরু করেন এবং সংরক্ষণাগারে পর্যাপ্ত জায়গা সংকুলান না হওয়ায় প্রচুর পরিমাণ রক্ত নষ্ট হয়। পরে জাপান থেকে ঋণ নিয়ে ওই পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ করা হয়।

প্রায় একইসময়ে কলকাতায় অর্থায়নের অভাবে ধুঁকতে থাকা মেডিকেল প্রতিষ্ঠানের জন্য একদল দাতা রক্ত বিক্রি শুরু করেন। তার দশ বছর পর রক্ত বিক্রি অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল।

রাজনৈতিক দলগুলো জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে রক্তদান ক্যাম্পের আয়োজন করে। সমর্থকরা নিজেদের লাভ বা রাজনৈতিক ফায়দার জন্য রক্ত দেন।

হেমাটোলজিস বইয়ের লেখক কোপম্যান ও দ্বৈপায়ন ব্যানার্জিকে একটি ব্লাড ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত এক পেশাজীবী বলেছেন, রাজনৈতিক দলের রক্তদান কর্মসূচি ক্যাম্পগুলো ‘ভয়ঙ্কর’ । কারণ নেতাকে খুশি করা ছাড়া সেখানে অনুপ্রেরণামূলক কিছুই নেই।

আধুনিক ভারতে মাসিক নিয়ে ট্যাবু ভাঙতেও নারীরা রক্তকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

২০০৪ সালে নিজের রক্ত দিয়ে চেন্নাইয়ে প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম জয়ললিতার ৫৭টি প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন শিহান হুসেইনি নামে এক কারাতে শিক্ষক। তার কারাতে স্কুলের জন্য জমি প্রয়োজন ছিল, আর সেজন্য মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ খুঁজছিলেন তিনি।

হেমাটোলজিস বইয়ের লেখকদ্বয়কে শিহান হুসেইন বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী তাকে তার বাসায় নিয়ে যান এবং চমির জন্য টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

“মূলত রক্ত দিয়ে তৈরি চিত্রকর্ম ছিল প্রচার, যোগাযাগ আর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাবিত করার হাতিয়ার।”