মিয়ানমারে জান্তাপন্থি গায়িকা খুন, আতঙ্কে অন্য তারকারা

মিয়ানমারের সামরিক জান্তার পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালানো এই গায়িকাকে জান্তাবিরোধী বন্দুকধারীরা গুলি করেছে বলে অভিযোগ।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 June 2023, 08:43 AM
Updated : 8 June 2023, 08:43 AM

মিয়ানমারের সুপরিচিত সঙ্গীতশিল্পী লিলি নাইং কেয়াও মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার এক সপ্তাহ পর ইয়াংগনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ।

সামরিক জান্তার পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালানো এই গায়িকাকে জান্তাবিরোধী বন্দুকধারীরা গুলি করেছে বলে অভিযোগ।

লিলির এ মৃত্যু কেবল জান্তা সমর্থকদেরই নয়, সামরিক বাহিনীপন্থি গণমাধ্যমে কাজ করা অনেক তারকাকেও স্তম্ভিত করে দিয়েছে বলে বিবিসি জানিয়েছে।

যে সামরিক জান্তা ২০২১ সালে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে মিয়ানমারকে গৃহযুদ্ধের পথে নিয়ে গেছে, সেই জান্তার শীর্ষ কর্মকর্তাদের বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন লিলি (৫৮) ।

তাকে গুলি করার অভিযোগে দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ দুই ব্যক্তি সামরিক বাহিনীবিরোধী একটি শহুরে গেরিলা দলের সদস্য বলে জানিয়েছে জান্তা কর্তৃপক্ষ।

তাদের গ্রেপ্তারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সন্দেহভাজন একজনের পরিবারের দুই সদস্যকে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। প্রতিশোধ নিতেই পাল্টা এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে বলে ধারণা।

লিলির আগেও জান্তাপন্থি একাধিক উচ্চ-পর্যায়ের সমর্থক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। লিলির ওপর হামলার চারদিন আগে ইয়াংগনের একটি চায়ের দোকানে সুপরিচিতি জাতীয়তাবাদী ও জান্তা সমর্থক টিন্ট লুইনকে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়।

লুইনের ওপর গত গ্রীষ্মেও হামলা হয়েছিল, সেবার বেঁচে যাওয়ার পর অনেকদিন আত্মগোপনে ছিলেন তিনি।

আর ৩০ মে সন্ধ্যার দিকে ইয়াংগনের ইয়াংকিনে নিজের বাড়ির বাইরে গাড়ি পার্ক করা সময় লিলির ওপর হামলা হয়।

গাড়ির ভেতর তার কাত হয়ে পড়ে থাকার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর প্রাথমিক সব খবরেই তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানানো হয়েছিল।

প্রকৃতপক্ষে গুরুতর আহত অবস্থায় গাড়ির ভেতরে উল্টে পড়েছিলেন তিনি। ওই অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে কোমায় ছিলেন তিনি।

৬ জুন ভোররাতে তার মৃত্যু হয়েছে বলে তার পরিবার বিবিসিকে নিশ্চিত করেছে। 

সরকারি বিবৃতিতে এ ঘটনাকে ‘নিষ্পাপ নারীর ওপর অমানবিক গুলিবর্ষণ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। জান্তাপন্থি ১৭টি সংগঠন এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। কট্টর জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধদের সংগঠন ‘মা বা থা’ নিরাপত্তা জোরদারের দাবি জানিয়েছে ।

লিলির ওপর গুলি চালানোর ঘটনায় যে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদেরকে ইয়াংগনভিত্তিক সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘স্পেশাল টাস্ক ফোর্স’ এর সদস্য বলা হচ্ছে। এদের মধ্যে একজন কং জার নি হেইন, তাকে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে শনাক্ত করা হয়। অন্য সন্দেহভাজনের নাম কেয়া থুরা। 

তাদেরকে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা হয়েছে। সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তারা তাদের অপরাধ স্বীকার করেছে।

সুপরিচিত ছাত্রনেতা ডি নিয়েন লিনও লিলি হত্যায় জড়িত বলে দাবি করছে সামরিক জান্তা।

দুইজনকে গ্রেপ্তারের পর ওইদিন রাতে নি হেইনের মা ও তার এক জ্ঞাতি ভাই আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। হেইনের ছোট ভাই-বোনেরা পালাতে সক্ষম হন, নিরাপত্তা বাহিনী তাদেরকে ‘বন্দুকধারীদের হাত থেকে বাঁচায়’ বলে জানিয়েছে সামরিক বাহিনীপন্থি একটি চ্যানেল।

এই প্রতিবেদনের সত্যতা যাচাই করতে পারেনি বিবিসি; পরিবারটির ওপর কারা হামলা চালিয়েছে, তাও জানা যায়নি। কেউ হামলার দায় স্বীকারও করেনি।

সামরিক পরিবারে জন্ম হওয়া লিলিকে প্রায়ই জান্তার শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে চলাফেরা করতে ও সরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছবিতে দেখা যেত। তার একটি গান মিয়ানমারে নববর্ষ উদ্‌যাপনের পানি উৎসবের অনানুষ্ঠানিক থিম সং হয়ে উঠেছিল।

অনেকে বলছেন, সামরিক বাহিনীকে বিক্ষোভকারীদের তথ্য দেওয়ার কারণে লিলি হামলার শিকার হয়েছেন।

তিনি তার এলাকায় থালাবাসন বাজিয়ে বিক্ষোভ দেখানো আন্দোলনকারীদের ভিডিও করে পরে সেসব ফুটেজ সামরিক বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছেন বলে জনশ্রুতি আছে। তার ওই ফুটেজের ভিত্তিতেই অনেক বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিভিন্ন বিপ্লবী বাহিনীতে জড়িত তরুণদের খবরাখবরও তিনি সামরিক বাহিনীকে দিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

২০২১ সালে অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টিকে (এনএলডি) উৎখাত করা সামরিক অভ্যুত্থানের কয়েকমাস পর লিলির সঙ্গে মিয়ানমারে যাওয়া সিএনএন ও সাউথইস্ট এশিয়া গ্লোব কথা বলেছিল।

ওই গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদকদের তিনি বলেছিলেন, তাকে গুপ্তচর বলা হচ্ছে, তার বাড়ির কাছে ল্যাম্পপোস্টে তাকে বিশ্বাসঘাতক অভিহিত করে পোস্টার সাঁটানো হয়েছে, তার বাড়িতে ভাংচুর চালানো হয়েছে।

“আমি সামরিক বাহিনীকে সমর্থন করি এবং অভ্যুত্থানের পক্ষে আছি। কিন্তু আমার এলাকার অধিকাংশ লোক এনএলডির সমর্থক আর তারা বলছে, তারা আমাকে হত্যা করবে। এই লোকগুলো জাতিকে ধ্বংস করতে চায়,” বলেছিলেন এই গায়িকা।

কারা কারা অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিল, লিলি সামরিক বাহিনীপন্থি টেলিগ্রাম চ্যানেলে তা বলে তাদেরকে গ্রেপ্তার করাতে পারে এই ভয়ে জনপ্রিয় অনেক শিল্পীই তাকে এড়িয়ে চলতেন বলে ভুক্তভোগীদের ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছে।

গণতন্ত্রপন্থিদের সমর্থক, জনপ্রিয় এক গীতিকার অং নাইং সান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিলির সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়েছিলেন।

গাড়ির ভেতর গুলিবিদ্ধ লিলির পড়ে থাকার ছবিতে লাইক ও এ নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করায় গত সপ্তাহে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

“মৃত্যু দুঃখজনক। কিন্তু ব্যক্তিগত ক্ষতি ও ঘৃণার কারণে আমি এই ঘটনায় সন্তুষ্ট,” গুলিবিদ্ধ লিলির ছবি নিয়ে ফেইসবুকে পোস্টে এমনটাই বলেছিলেন সান।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অচেতন লিলির ছবি সম্বলিত পোস্টে প্রতিক্রিয়া দেখানো, মন্তব্য করা বা শেয়ার করার পর তার মতো আরও অন্তত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বেশিরভাগের বিরুদ্ধেই ভুয়া খবর ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ উসকে দেওয়ার ধারা ৫০৫ (এ)-তে অভিযোগ আনা হয়েছে।

লিলি হত্যাকাণ্ড মিয়ানমারের সরকারপন্থি অন্য তারকাদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। অনেকেই বলছেন, তারা আর সামরিক বাহিনীর পক্ষে তাদের অবস্থানের কথা জোর গলায় বলবেন না, কেননা তাদের মনে হচ্ছে, তাদের সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই এবং বন্দুকধারীরা যে কোনো সময় তাদের দরজায় চলে আসতে পারে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে সতর্ক হতে এবং সাবধানে চলাফেরা করতে তারা একে অপরকে পরামর্শ দিচ্ছেন বলেও জানিয়েছে তাদের ঘনিষ্ঠজনরা।

এদিকে সরকার সমালোচক তারকাদের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন অব্যাহত আছে।

লাগাতার বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে জান্তাকে উপহাস করার পর গত মাসে র‌্যাপার বিউ হারকে ‘শান্তি বিঘ্নিত করা’ ও ‘অপপ্রচার চালানোর’ দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

তার বাবা, বিখ্যাত গীতিকার নাইং মাইয়ানমারের একটি গান ১৯৮৮ সালে গণতন্ত্রপন্থিদের আন্দোলন সঙ্গীত হয়ে উঠেছিল; ২০২১ সালে অভ্যুত্থানের পর হওয়া বিক্ষোভেও গানটি গাওয়া হয়েছিল।