সিরিয়া: গোলা থেকে বেঁচে গিয়ে এখন ভূমিকম্পে নিহত

এক দশক ধরে সিরিয়ায় চলছে গৃহযুদ্ধ; এখন ভূমিকম্পের দুর্যোগ।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Feb 2023, 07:01 PM
Updated : 7 Feb 2023, 07:01 PM

ভূমিকম্প সিরিয়ার অনেক ভুক্তভোগীর কাছেই যেন দীর্ঘ এক দশক ধরে চলমান দুর্দশারই একটি ধারাবাহিকতা।

সোমবার ভোরের দিকে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় মঙ্গলবার পর্যন্ত ৭ হাজারের বেশি মৃত্যুর খবর জানা গেছে এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছে। গত ৮৪ বছরের মধ্যে এটাই তুরস্কে আঘাত হানা সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প।

সিরিয়ার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বার্তা সংস্থা এসএএনএ জানিয়েছে, সে দেশে বেশিরভাগ হতাহতের ঘটনা ঘটেছে উত্তরপশ্চিম অংশে। বিশেষ করে আলেপ্পো, হামা, লাতাকিয়া ও তারতুস শহরে।

জাতিসংঘের হিসাবে ২০১১ সাল থেকে চলমান গৃহযুদ্ধে ওই অঞ্চলে এরইমধ্যে তিন লাখের বেশি প্রাণহানি হয়েছে এবং বিমান থেকে অব্যাহত বোমা বর্ষণে আগে থেকেই সেখানকার গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।

সোমবার সিরিয়ায় জাতিসংঘের আবাসিক ও মানবাধিকার বিষয়ক সমন্বয়ক এল-মোস্তফা বেনলামলিহ সিএনএনের ক্রিস্টিনা ম্যাফারলেইনকে বলেন, “এটা (ভূমিকম্প) যেন একটি সংকটের মধ্যেই আরেকটি সংকট।”

তিনি বলেন, “যুদ্ধ ও অন্যান্য পরিস্থিতির কারণে ওই অঞ্চলটির অবকাঠামো এমনিতেই বিধ্বস্ত হয়ে আছে। এই শহরগুলো ‘ভূতুড়ে নগরী’ হয়ে আছে ... অনেক মানুষই খুবই ভীত-সন্তস্ত্র। তারা নিজের ঘরে ফিরতে চায় না। আদৌ যদি আমরা সেগুলোকে ঘর বলতে চাই। অনেকক্ষেত্রেই সেগুলো শুধু ধ্বংসাবশেষ মাত্র।”

সিরিয়ার উত্তরপশ্চিমাঞ্চলীয় আল্লেপো অঞ্চলের শহর জিনদিরিসের ফটোসাংবাদিক খলিল আশাওয়ি সিএনএনকে বললেন, সেদেশে যুদ্ধ বিধ্বস্ত অঞ্চলের ছবি তোলার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি দাবি করতে পারেন যে সোমবারের ভূমিকম্পের পর যে ‘ধ্বংসযজ্ঞে’র তিনি সাক্ষী হয়েছেন, এমনটা গত এক দশকে দেখেননি।

আশাওয়ি বলেন, “এখানে যত বছর ধরে আমি যুদ্ধের ছবি তুলেছি, কখনই এমন কিছু দেখিনি। এটা একটা চরম দুর্দশাপূর্ণ পরিস্থিতি। প্যারামেডিক ও ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা সাহায্য করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের জন্যও এটা সাধ্যের বাইরে। তারা কোনোভাবেই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছেন না।”

তিনি জানালেন, তুরস্কের আনতাকিয়ার বাসিন্দা তার বাবা-মাও এখন পর্যন্ত নিখোঁজ। ভূমিকম্পে ওই শহরটিও দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ইউনিসেফের হিসাবে, সিরিয়ার উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের ৪৬ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ১৭ লাখই চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে বাড়িঘর ছেড়ে ওই অঞ্চলের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে বা তাঁবুতে বসবাস করছে। গত বছর সংস্থাটি জানায় যে সেখানে প্রায় ৩৩ লাখ সিরীয় খাদ্য সংকটের মধ্যে রয়েছে।

উত্তরপশ্চিম সিরিয়ার বড় শহর ইদলিবসহ অনেক অংশই এখনও আসাদ সরকারবিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীর দখলে।

ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হওয়ায় আলেপ্পো ও ইদলিব গৃহযুদ্ধের শুরুর দিকে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের জন্য ভৌগলিক ও অর্থনৈতিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু ২০১২ সালের পর থেকে, তুরস্কের সীমান্তবর্তী ইদলিব, যেটা এখন তুর্কি-সমর্থিত বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে, রুশ-সিরীয় সামরিক জোটের নিয়মিত বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।

২০১৯ সালের রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর বিমান সহায়তায় ওই প্রদেশে নতুন করে অভিযান পরিচালনা করে সিরিয়ার সেনাবাহিনী। যার কারণে ১০ লাখের বেশি সিরীয় বাস্তুচ্যুত হয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, ওই সময় ১১ মাসের সেনা অভিযানে এক হাজারের বেশি সাধারণ মানুষ নিহত হয়। ২০২০ সালের মার্চে অস্ত্রবিরতি ঘোষণা হলেও আকাশ থেকে বোমা বর্ষণ থামেনি।

ওই বোমাবর্ষণের ক্ষতির শিকার অনেক পরিবারই সোমবারের ভূমিকম্পে আরও বেশি দুর্দশায় পড়েছে।

ইদলিবের বাসিন্দা, যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা মেডগ্লোবালের পরিচালক, ডা. মোস্তফা এদো বললেন, “আমার সঙ্গে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করা আমার এক সহকর্মী দুই বছর আগে বিমান বাহিনীর গোলা বর্ষণে নিহত হয়। আমি আজ (সোমবার) জানতে পারলাম তার পুরো পরিবার- তার স্ত্রী ও সন্তানেরা - ভূমিকম্পে ভবন ধসে নিহত হয়েছে।”

তিনি সিএনএনকে জানালেন যে শহরের হাসপাতালগুলো রোগীতে ভর্তি এবং সেখানে চিকিৎসার যথেষ্ট উপকরণ নেই, বিশেষ করে হাড়ভাঙার চিকিৎসায় ব্যবহৃত অর্থোপেডিক প্লেটের সংকট রয়েছে। হাসপাতালগুলো যখন-তখন বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। আগে বিদ্যুৎ সরবরাহ পেতে তুরস্কের ওপর নির্ভর করলেও, ভূমিকম্পের পর এখন ভরসা শুধু জেনারেটর, যা চালাতে জ্বালানি তেল দরকার এবং এই তেলের সরবরাহেও সংকট রয়েছে।

ডা. মোস্তফা বলেন, “ভূমিকম্পে বেঁচে যাওয়ারা চরম ঠাণ্ডার মধ্যেই খোলা রাস্তায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে।”

অনেকেরই আশঙ্কা, সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে বসবাসরত জনগণই এই শক্তিশালী ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি দুর্দশায় রয়েছে, যেহেতু সিরিয়ার আসাদ সরকার ওইসব স্থানের স্থানীয় অবকাঠামো দুর্বল করতে তাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখার কৌশল বজায় রেখেছে।

স্বেচ্ছাসেবী উদ্ধারকারী দল সিরিয়া সিভিল ডিফেন্স, যারা সাধারণত ‘সাদা হেলমেট’ নামে পরিচিত, সোমবার ভূমিকম্প বিধ্বস্ত অঞ্চলকে দুর্যোগ কবলিত এলাকা ঘোষণা করেছে এবং উদ্ধার ও ত্রাণ কাজে সাহায্য করার পাশাপাশি ‘দুর্যোগ কবলিত এলাকায় যাতে বোমা ফেলা না হয় তা নিশ্চিতে’ সিরিয়ার শাসক গোষ্ঠী ও রাশিয়ার ওপর চাপ দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

সিরিয়ায় ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির আবাসিক পরিচালক তানিয়া এভানস এক বিবৃতিতে ভূমিকম্পকে বর্ণনা করেছেন এভাবে যে “কয়েক বছরের যুদ্ধে এরইমধ্যে ক্লান্ত ও অসহায় বিপুল সংখ্যক জনগণের জন্য এটা আরেকটা চরম দুর্যোগ।”

সতর্ক করে তিনি জানিয়েছেন, হাজার হাজার মানুষ শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার কম আবহাওয়ায় খোলা আকাশের নিচে আছে।

তিনি বলেন, “উত্তরপশ্চিম সিরিয়ার অনেক মানুষ ২০ বার পর্যন্ত বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং এই ভূমিকম্পের দুর্যোগের আগেই সেখানকার ধুঁকতে থাকা স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থায় এখন ভূমিকম্পের পর অনেকেই আর জরুরি স্বাস্থ্য সেবা নেওয়ার সুযোগটুকুও পাচ্ছে না।”