ভারতে তৈরি প্রথম বিমানবাহী রণতরীর যাত্রা শুরু

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কেরালার কোচিতে এ রণতরী উদ্বোধন করে আনুষ্ঠানিকভাবে তা নৌবাহিনীর হাতে তুলে দেন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Sept 2022, 11:06 AM
Updated : 2 Sept 2022, 11:06 AM

বহু প্রতীক্ষার পর যাত্রা শুরু করল ভারতের নিজেদের তৈরি প্রথম বিমানবাহী রণতরী ‘আইএনএস বিক্রান্ত’।

শুক্রবার সকালে দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালার কোচিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এ রণতরী উদ্বোধন করে আনুষ্ঠানিক ভাবে তা নৌবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছেন।

এর আগে বিদেশ থেকে কেনা রণতরী দিয়ে শত্রুপক্ষকে মোকাবেলা করে এসেছে ভারত। কিন্তু নতুন এই ‘আইএনএস বিক্রান্ত’ সম্পূর্ণ ভারতীয় প্রযুক্তিবিদদের হাতে তৈরি হয়েছে।

Also Read: প্রথম দেশীয় বিমানবাহী রণতরী নৌবাহিনীর হাতে তুলে দিচ্ছে ভারত

পরিষেবায় যুক্ত হয়ে এ রণতরী ভারতের নৌবাহিনীর শক্তি আরও বাড়াল। বিশ্বের মাত্র হাতে গোণা কয়েকটি দেশের এমন রণতরী তৈরির সক্ষমতা আছে।

বিশ হাজার কোটি রুপি নির্মিত ‘আইএনএস বিক্রান্ত’ পানিতে ভেসেছে আগেই। শুক্রবার মিলল আনুষ্ঠানিকতা।

সিএনএন জানায়, কেরালার কোচিন শিপইয়ার্ডে ধূমধাম করে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ‘আইএনএস বিক্রান্ত উদ্বোধনের পাশাপাশি নৌবাহিনীর নতুন পতাকাও উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।

অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “এই বিমানবাহী রণতরী জাতিকে নতুন আত্মবিশ্বাসে পরির্পূণ করেছে। লক্ষ্য কঠিন হতে পারে, চ্যালেঞ্জও বড় হতে পারে, কিন্তু ভারত যখন করণীয় ঠিক করে নেয়, তখন কোনও লক্ষ্য ছোঁয়া অসম্ভব নয়।“

“এখন পর্যন্ত উন্নত দেশগুলোই শুধুমাত্র এ ধরনের ক্যারিয়ার তৈরি করত। আজ এ কাতারে যোগ দিয়ে উন্নত দেশের পথে উত্তরণে ভারত আরও এক ধাপ এগিয়েছে” বলেন মোদী।

ভারতের জন্য ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলটি নিরাপত্তায় অগ্রাধিকার পাবে বলেও জানান তিনি।

সিঙ্গাপুরের ‘এস রাজারত্ম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’ এর সিনিয়র ফেলো জন ব্র্যাডফোর্ড এক মন্তব্যে বলেছেন, বিশ্বমানের নৌবাহিনী নিয়ে চলার দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে ভারতের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন ঘটেছে ‘আইএনএস বিক্রান্ত’র মধ্য দিয়ে।”

তিনি বলেন, “ক্ষেপণাস্ত্রের যুগেও যে কোনও রণতরীর টিকে থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং যুক্তরাজ্য তাদের রণতরী তৈরিতে বিনিয়োগ দ্বিগুণ করছে, সে অর্থে বলা যায়, ভারত এই প্রতিযোগিতার কাতারে নিজেদের সামিল করেছে।“

রাশিয়া থেকে কেনা সোভিয়েত যুগের সংস্কার করা রণতরী ‘আইএসএস বিক্রমাদিত্য’র বহরে যোগ দিয়েছে ‘আইএনএস বিক্রান্ত’।

রণতরীটির সক্ষমতা:

এই রণতরী ৩০টি যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন। যার মধ্যে মিগ-২৯কে ফাইটার জেট এবং হেলিকপ্টারের উঠানামার সুবিধা রয়েছে।

আইএনএস বিক্রান্তের দৈর্ঘ্য ২৬২ মিটার। এই তরী ৬২ মিটার চওড়া এবং ৫৯ মিটার উঁচু। জাহাজটির উপরের ভাগে বিমান উড়ানের জন্য যে রানওয়ে আছে, তার দৈর্ঘ্যও ৯০ মিটারের বেশি। এ জাহাজে ১,৭০০-রও বেশি সেনা এবং কর্মকর্তার থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।

সব মিলিয়ে ১৪টি ডেক রয়েছে এই রণতরীর। আর রয়েছে ২৩০০টি কামরা। চারটি গ্যাস টারবাইন ইঞ্জিন দিয়ে রণতরীটি চলবে। এর সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ২৮ নটিক্যাল মাইল (৫২ কিলোমিটার)।

বার বার জ্বালানি ভরার দরকারও নেই বিক্রান্তে। এক বার জ্বালানি ভরা হলেই সাড়ে সাত হাজার নটিক্যাল মাইল অতিক্রম করতে পারবে এই যুদ্ধজাহাজ।

ভারতের সাবেক সামরিক কর্মকর্তা অজয় শুক্লা বলেন, “আইএনএস বিক্রান্তের মাধ্যমে নিজেদের শক্তিধর হয়ে ওঠার বার্তা দিচ্ছে দেশটি। ভারত মহাসাগরের দূরবর্তী অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে আকাশ শক্তির পরিচয় রাখছে ভারত।”

ওদিকে, মার্কিন নৌবাহিনীর সাবেক অধিনায়ক এবং হাওয়াই প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কার্ল শুস্টার বলেছেন, “ভারত আঞ্চলিক উদ্বেগের সম্ভাব্য নিরাপত্তা সমাধানের ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখার পাশাপাশি সমন্বয়ও সাধন করতে পারে।”

“বহুপাক্ষিক প্রতিক্রিয়ায় ভারতের যুক্ত হওয়ার দরকার নেই বরং দেশটি চাইলে আলাদা স্বাধীন উপস্থিতি প্রতিষ্ঠা করতে পারে। “

নতুন রণতরীর মাধ্যমে ভারত চর্তুপাক্ষিক নিরাপত্তা সংলাপ যা যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতের অনানুষ্ঠানিক জোট ‘কোয়াড’ এর সামরিক মহড়াতেও বড় ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করেন মার্কিন নৌবাহিনীর সাবেক এই অধিনায়ক।

‘আইএনএস বিক্রান্ত’ নির্মাণ পর্ব:

বিক্রান্ত শব্দের অর্থ ‘সাহস’। কিন্তু ভারতের জন্য বিক্রান্ত তৈরি খুব একটা সহজ ছিল না। ভারত এর নকশা নির্মাণে চুক্তি স্বাক্ষর করে ২০০৩ সালে। মূল কাঠামো তৈরি হয় ২০০৯ সালে। আর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালের অগাস্টে।

আইএনএস বিক্রান্ত ২০১৭ সালেই ভারতের নৌবাহিনীতে যুক্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রণতরীটির দ্বিতীয় ধাপের কাজ নানা কারণে পিছিয়ে যায়। সেসবের মধ্যে কোভিড মহামারীও অন্যতম একটি কারণ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত অভিজ্ঞতা থেকে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে জাহাজ নির্মাণে সক্ষমতা বাড়াতে আগামীতে সক্ষম হবে।

মার্কিন নৌবাহিনীর সাবেক অধিনায়ক শুস্টার শুস্টার বলেন, “দেশটির এখন আরও দ্রুত এবং উন্নত নকশা দিয়ে পরবর্তী রণতরী নির্মাণের দক্ষতা রয়েছে। “

ভারত ‘আইএনএস বিক্রান্ত’ এর পুনর্জন্ম ঘটিয়েছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধজাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া পুরোনো সেই রণতরীকেই তারা নতুন করে ফিরিয়ে এনেছে নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি করে।

পরাক্রমী সেই রণতরীটি ভারত কিনেছিল যুক্তরাজ্য থেকে। পঞ্চাশের দশকে ভারত ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জন্য তৈরি করা বিমানবাহী রণতরী ‘হারকিউলিস’ কিনে এর নাম দিয়েছিল ‘আইএনএস বিক্রান্ত’।

রণতরীটি ১৯৬১ সালে ভারতের নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়, যা দেশটির গর্বের প্রতীক ছিল। বহু গুরত্বপূর্ণ সামরিক অভিযানেই সেটি উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে।

প্রায় ৪ দশক কাজ করার পর ১৯৯৭ সালে বিক্রান্তকে অবসরে নেওয়া হয়। ভেঙে ফেলা হয় জাহাজটি। কিন্তু সেটিরই নকশা দেখে পরে দেশীয়ভাবে তৈরি করা হয়েছে ‘আইএনএস বিক্রান্ত’।

২০২১ সালের অগাস্টের শুরুতে সমুদ্রে বিক্রান্তকে পরীক্ষা করা শুরু হয়। কয়েকদফা পরীক্ষা তরীটি সফলভাবেই উৎরেছে বলে জানিয়েছে নৌবাহিনী। তারপরই এটিকে কমিশন করা হল। নতুন এই আইএনএস বিক্রান্ত ভারত এবং আন্তর্জাতিক জলসীমায় চলাচল করবে।