বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দল বিজেপি’র সঙ্গে লড়তে গেলে কংগ্রেস পার্টিতে সংস্কার প্রয়োজন।
Published : 19 Oct 2022, 10:26 PM
গান্ধী পরিবারের ‘অনুগত’ হলেও এ পরিবারের বাইরের একজন প্রবীণ নেতা মল্লিকার্জুন খড়গে। ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস পার্টি পরিচালনার দায়িত্ব উঠেছে তার হাতেই। বিপুল ভোটে একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী শশী থারুরকে হারিয়ে তিনি কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন।
প্রায় আড়াই দশক পর অ-গান্ধী একজন নেতাকে সভাপতি পদে পেয়েছে ভারতের শতবছরের বেশি সময়ের ঐতিহ্যবাহী এই দলটি।
কূটনীতি থেকে রাজনীতিতে আসা ‘ক্যারিশমাটিক’ নেতা শশীকে নিয়ে এবার অনেকেই আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনে মল্লিকার্জুনের কাছে পাত্তাই পাননি তিনি। শশীর চেয়ে প্রায় আট গুণ বেশি ভোট পেয়ে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন মল্লিকার্জুন।
কংগ্রেসের সেন্ট্রাল ইলেকশন অথোরিটি বুধবার দলীয় নেতৃত্ব নির্বাচনের ফল ঘোষণা করে জানিয়েছে, মোট ৯ হাজার ৩৮৫ ভোটের মধ্যে মল্লিকার্জুন খড়গে পেয়েছেন ৭,৮৯৭ ভোট। তার প্রতিদ্বন্দ্বী শশী থারুরের পক্ষে পড়েছে মাত্র ১,০৭২ ভোট।
সোমবার দলীয় এ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হয়। ভারতজুড়ে মোট ৩৬টি কেন্দ্রের ৬৭টি বুথে ভোট হয়। প্রতি ২০০ ভোটারের জন্য একটি করে বুথ ছিল।
বুধবার দিল্লির স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় কংগ্রেসের সদরদপ্তরে ভোট গণনা শুরু হয়ে দুপুর ১টায় শেষ হয়। গণনা শেষে দেখা যায় ‘গান্ধীদের মনোনীত’ প্রার্থী ৯০ শতাংশ ভোট পেয়েছেন।
নতুন ভূমিকায় ৮০ বছর বয়সের এই নেতাকে এখন নবদ্যোমে দ্রুতগতিতে কাজ করে যেতে হবে। কারণ, ভারতের সাধারণ নির্বাচনের আর খুব বেশি দেরী নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টির(বিজেপি)সঙ্গে লড়তে গেলে কংগ্রেস পার্টিতে সংস্কার প্রয়োজন।
দলটি কাঠামোগতভাবে, সাংগঠনিকভাবে এমনকী আদর্শগত নেতৃত্বের দিক থেকেও সবচেয়ে বাজে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচেছ। এ পরিস্থিতিতে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে এই কঠিন সময় পার করাটাই হবে মল্লিকার্জুন খড়গের কাজ।
কে এই মল্লিকার্জুন খড়গে?
ভারতের দক্ষিণের কর্ণাটক রাজ্যের দলিত সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা মল্লিকার্জুন জনজীবনে দীর্ঘদিন ধরে প্রভাব বিস্তার করে আসছেন। ১৯৪২ সালে বিদার জেলায় জন্ম গ্রহণ করলেও তার পরিবার প্রতিবেশী গুলবার্গা জেলায় চলে গেলে সেখানেই বেড়ে উঠেন মল্লিকার্জুন।
আইনে পড়া মল্লিকার্জুন প্রথম জীবনে শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিয়েছেন। লেখাপড়ার সময়ই রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন, ১৯৬৯ সালে যোগ দেন কংগ্রেস পার্টিতে।
ওই সময়ে কর্নাটকে কংগ্রেস পার্টির প্রধান ছিলেন দেবারাজ উরস। তিনি ১৯৭২ সালে উচ্চবর্ণ অধ্যুষিত আসন গুরমিতকাল থেকে নির্বাচনী লড়াইয়ে নামতে মল্লিকার্জুনকে রাজি করান।
তার ওপর দলীয় প্রধানের এই আস্থার প্রতিদান দেন মল্লিকার্জুন। তিনি টানা নয়বার ওই আসন থেকে জয়লাভ করেন। এছাড়া, তিনি চিত্রাপুর থেকেও নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমে জিতেছেন।
রাজনীতি বিশ্লেষক ইন্দুধারা হোন্নাপুরা বিবিসি হিন্দিকে বলেন, একজন দলিত নেতা হিসেবে তার উত্থান ঘটে। কিন্তু তিনি সব সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রতি ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। একজন চৌকস প্রশাসক মল্লিকার্জুন রাজ্যের ভিন্ন ভিন্ন সরকারে মন্ত্রী হিসাবে কাজ করেছেন।
একজন অবসরপ্রাপ্ত আমলা বলেন, ‘‘তিনি সর্বদা কর্মকর্তাদের সঙ্গে নম্র ছিলেন। তবে তার নিজস্ব মতামত ছিল এবং তিনি তার পছন্দ-অপছন্দের বিষয়গুলি খুব পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করতেন।”
২০০৯ সালে গুলবার্গা আসন থেকে প্রথমবারের মত ভারতের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হয়ে দিল্লি যান মল্লিকার্জুন। ২০১৪ সালে দ্বিতীয়বারও তিনি বিজয়ী হন।
কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। ২০২১ সালে তিনি পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন।
প্রবীণ এ রাজনীতিবিদ ভারতের পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে বিরোধী দলের নেতা হিসাবে কাজ করেছেন। তিনি রেলওয়ে, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একজন তত্ত্বাবধানকারী হিসেবে ফেডারেল সরকারের কেবিনেটমন্ত্রী হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
তবে বর্তমানে যে দায়িত্বভার তিনি পেয়েছেন সেটি সম্ভবত তার ক্যারিয়ারের সব থেকে কঠিন চ্যালেঞ্জ।
২০১৪ সাল থেকে নরেন্দ্র মোদী ও দলীয় সভাপতি অমিত শাহের নেতৃত্বে ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজেপি’র উত্থান ঘটতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেস পার্টিরও অধপতন হয়েছে।
২০১৯ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস পার্টি মাত্র ৫৩ আসনে জয় পায়, যেখানে বিজেপি পায় ৩০৩ আসন। কংগ্রেস একসময় তাদের শাসন পরিচালনায় থাকা বেশিরভাগ রাজ্যেও হেরে যায়। আর এখন দলটির হাতে আছে মাত্র দুটি রাজ্য।
এ পরিস্থিতিতে ভারতে আর ১৮ মাস পরেই হবে নতুন জাতীয় নির্বাচন। যার প্রস্তুতির জন্য মল্লিকার্জুন খড়গেকে এখনই মাঠে লড়াইয়ে নামতে হবে।
প্রবীণ এই নেতা অবশ্য এরই মধ্যে দলে সাংগঠনিক সংস্কার বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। বলেছেন, দলের সব স্তরে ৫০ বছরের কম বয়সীদের জন্য ৫০ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
তিনি কী বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবেন?
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিজেপি’কে মোকাবেল করতে হলে মল্লিকার্জুনকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জে আগে জয়ী হতে হবে। একেবারে শুরুতেই তাকে প্রমাণ করতে হবে তিনি শুধুমাত্র গান্ধী পরিবারের ‘আজ্ঞাবাহক’ নন। বরং বাস্তবে দলের ওপর তার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
সোমবারের ভোটের দিন মল্লিকার্জুন ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’কে বলেছিলেন, তিনি হয়ত প্রতিটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় নেহেরু-গান্ধী পরিবারের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারেন না, তবে তিনি তাদের ‘দিকনির্দেশনা’ এবং ‘পরামর্শ’ চাইবেন। যেহেতু গান্ধী পরিবারের সদস্যদের দল পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা আছে।
মল্লিকার্জুনের এর পরের চ্যালেঞ্জটি হবে দলের ভেতরের বিভেদ মোকাবেলা করা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা হয় পার্টি ছেড়েছেন কিংবা এটি যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে তা নিয়ে নিজেদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
রাজনৈতিক ভাষ্যকার কে বেনেডিক্ট অবশ্য মনে করেন, মল্লিকার্জুন ‘বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা কমাতে এবং বিভিন্ন উপদলের মধ্যে উত্তেজনা হ্রাস করতে যথেষ্ট দক্ষ’। তিনি বলেন, ‘‘মল্লিকার্জুন এমন কেউ নন যিনি অন্যদের সাথে লড়াই করবেন।”
তবে কারও কারও মনে তার সক্ষমতা নিয়ে দ্বিধা রয়ে গেছে। তারা ভাবছেন, দক্ষিণ ভারতের একজন রাজনীতিবিদ উত্তর প্রদেশ ও বিহারের মতো উত্তরের রাজ্যগুলোতে খুব বেশি আবেদন রাখতে পারবেন কি না।
ওই দুটি রাজ্য একসাথে ১২০ জন এমপি নির্বাচন করে এবং রাজ্যদুটোতে কংগ্রেসের অবস্থা খুবই নড়বড়ে।
এমনই একজন সাংবাদিক পূর্ণিমা যোশী। তিনি মনে করেন, দেশজুড়ে ‘দলকে নতুন করে এগিয়ে দেওয়ার মত সক্রিয়তা’ মল্লিকার্জুনের মধ্যে নেই।
‘‘তিনি একজন ভদ্র মানুষ এবং তৃণমূল থেকে উঠে আসা রাজনীতিক। কেউ তাকে হালকা ভাবতে পারবেন না ঠিকই। কিন্তু কংগ্রেস পার্টির ভেতর যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে মল্লিকার্জুনের পক্ষে তা পুনর্গঠন করা সম্ভব হবে না। বিশেষ করে মোদী-অমিত শাহ জুটিকে চ্যালেঞ্জ জানাত তিনি সক্ষম হবেন বলে মনে হয় না।
‘‘কংগ্রেসের এমন একজনের প্রয়োজন যে তাদের ভাষায় কথা বলতে পারে, এমন একজন যিনি কৌশলী, যিনি বিজেপি’কে তাদের নিজেদের খেলায় মাত দিতে পারবেন।”
তবে মল্লিকার্জুন হয়ত বিজেপি’র বিরুদ্ধে ‘আদর্শগত দিক দিয়ে লড়াই করতে পারবেন’ বলে মনে করেন পূর্ণিমা। ‘‘মানুষ একবার দুটি দিকের মধ্যে তুলনা করলে তারা মল্লিকার্জুনের পক্ষে ইতিবাচকভাবে সাড়া দিতে পারে। আর সেটাই এখন দেখার বিষয়,” বলেন তিনি।