পলাতক খালিস্তানপন্থি নেতা অমৃতপালকে হরিয়ানায় দেখা গেছে

অমৃতপাল ও তার সহযোগীকে আশ্রয় দেওয়ায় এক নারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 March 2023, 03:18 PM
Updated : 23 March 2023, 03:18 PM

পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যাওয়া খালিস্তানপন্থি নেতা অমৃতপাল সিংকে ভারতের হরিয়ানা রাজ্যে এক নারীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখা গেছে।

একটি সিসিটিভি ক্যামেরায় অমৃতপালের বেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্য ধরা পড়ে বলে জানায় এনডিটিভি।

ফুটেজে দেখা যায়, মাথার উপর একটি ছাতা ধরে নিজের মুখ আড়াল করে রাখা অমৃতপাল একটি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। তার পরনে সাদা শার্ট এবং গাঢ় নীল রঙের জিন্স প্যান্ট।

পুলিশ জানায়, যে নারী অমৃতপাল এবং তার সহযোগী পাপালপ্রীত সিংকে আশ্রয় দিয়েছিলেন তার নাম বালজিৎ কর। তার বাড়ি হরিয়ানার কুরুক্ষেত্র জেলায়। বালজিৎ করকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ওই সিসিটিভি ফুটেজটি গত সোমবারের। তার দুই দিন আগে গত শনিবার ‘ওয়ারিস পঞ্জাব দে’ সংগঠনের এই নেতা পাঞ্জাব রাজ্যের জলন্ধরের কাছের ডেরা থেকে পুলিশের শক্ত ঘেরাটোপ পেরিয়ে পালিয়ে যান। ওইদিনই তাকে ‘ফেরারি’ ঘোষণা করে তল্লাশি অভিযানে মাঠে নামে পুলিশ। তিনি কোথায় আছেন তা এখনো স্পষ্ট নয়।

কুরুক্ষেত্র পুলিশ প্রধান সিং ভোরিয়া বলেন, ‘‘আমরা বালজিৎ করকে গ্রেপ্তার করেছি। তিনি অমৃতপাল এবং তার সহযোগী পাপালপ্রীতকে রোববার তার শাহাবাদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। বালজিৎকে পাঞ্জাব পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।”

শনিবার পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় আমৃতপাল ১২ ঘণ্টার মধ্যে পাঁচটি গাড়ি পরিবর্তন করেছেন। ওই সময় থেকেই তার সঙ্গে রয়েছেন পাপলপ্রীত। অন্য সিসিটিভি ফুটেজেও তাদের একসঙ্গেই দেখা গেছে।

অমৃতপাল খালিস্তান বা শিখদের জন্য একটি আলাদা মাতৃভূমিকে সমর্থন করেন। পাঞ্জাবে তার দ্রুত উত্থান ১৯৮০’র দশকে খালিস্তান বিদ্রোহের স্মৃতিই পুনরুজ্জীবিত করেছে। যে বিদ্রোহ কেড়ে নিয়েছিল হাজারো মানুষের প্রাণ।

অমৃতপাল পালিয়ে যাওয়ার পর পুলিশ ভেবেছিল তিনি হয়তো সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে চলে গেছেন। অমৃতপালের কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের হাত রয়েছে বলেও অনুমান পুলিশের।

এদিকে, পুলিশ আমৃতপালকে ধরার অভিযানে নেমে যে ধরপাকড় শুরু করেছে তার বিরুদ্ধে বিদেশে ভারতের দূতাবাসগুলোতে বিক্ষোভ-হামলা হচ্ছে। প্রতিবাদে সরব হয়েছে বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয় বংশোদ্ভুত শিখরা।

গত রোববার লন্ডনে ভারতীয় হাই কমিশনের সামনে খালিস্তানপন্থী সংগঠনগুলো বিক্ষোভ করেছে। এ ঘটনার রেশ না কাটতেই সানফ্রান্সিসকোতেও ভারতের কনস্যুলেটের সামনে কয়েকটি শিখ সংগঠন বিক্ষোভ দেখায়, যা পরে সহিংসতায় রূপ নেয়।

কে এই অমৃতপাল সিং?   

গত বছর অভিনেতা ও অ্যাক্টিভিস্ট দীপ সিধু মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত বিতর্কিত ও স্বঘোষিত ধর্মপ্রচারক অমৃতপাল তুলনামূলক অচেনাই ছিলেন।

সিধু দেশটিতে বছরখানেকেরও বেশি সময় ধরে চলা কৃষক আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছিলেন, শিখদের অধিকার রক্ষায় গড়ে তুলেছিলেন ‘ওয়ারিস পঞ্জাব দে’ নামের একটি সংগঠন।

এই সংগঠনটি নরেন্দ্র মোদীর কৃষি সংস্কার আইনের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবের কৃষক ও অ্যাক্টিভিস্টদের সংগঠিত করা শুরু করে; এই কৃষক ও অ্যাক্টিভিস্টদের অধিকাংশই ছিল শিখ।

দেশজুড়ে কৃষকদের তীব্র আন্দোলনের মধ্যে মোদী ২০২১ সালের নভেম্বরে তার কৃষি সংস্কার আইন নিয়ে পিছু হটলেও ‘ওয়ারিস পঞ্জাব দে’- কার্যক্রম বন্ধ হয়নি, তারা শিখ ধর্ম ও পাঞ্জাবের সংস্কৃতি রক্ষায় প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রাখে।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় সিধু মারা গেলে সংগঠনের নেতৃত্ব চলে যায় অমৃতপাল সিংহের হাতে। একের পর এক কর্মসূচিতে তার গরম গরম বক্তৃতা তাকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলে, গড়ে ওঠে বিশাল ভক্তকূলও।

মোদী নেতৃত্বাধীন ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদী অপতৎপরতার’ বিরুদ্ধে শিখদের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা ও নানান সামাজিক ইস্যুতে তার মন্তব্য পাঞ্জাবের অনেক শিখকে তাঁতিয়ে তোলে।

অমৃতপালের সঙ্গে তুলনা চলছে জার্নাইল সিং ভিনদ্রানওয়ালের সঙ্গে, যিনি ছিলেন খালিস্তান আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা। ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে শিখদের পবিত্র মন্দির অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে অভিযান চালিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী ভিনদ্রানওয়ালকে হত্যা করেছিল।

সেনাবাহিনীর ওই অভিযান পুরো শিখ সম্প্রদায়কে এতটাই ক্রুদ্ধ করেছিল যে এমনকী ইন্দিরা গান্ধীকেও তার শিখ দেহরক্ষীর হাতে মরতে হয়।

গত মাসে অমৃতপালও এক বক্তব্যে ভিনদ্রানয়ালের ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেন।

ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ খালিস্তান আন্দোলনের বিরুদ্ধে বলার পর অমৃতপাল তাকে হুমকি দিয়ে বলেন, অমিত শাহেরও ইন্দিরা গান্ধীর পরিণতি বরণ করা লাগতে পারে।

অমৃতপালের বাবা তারসিম সিং চলতি সপ্তাহে সাংবাদিকদের বলেছেন, তার ছেলেকে ধরতে যে অভিযান চলছে তা ‘ষড়যন্ত্র’, আর তার ছেলে মূলত মাদকাসক্তির বিরুদ্ধেই লড়ছে।  

খালিস্তান আন্দোলন কী?

পঞ্চদশ শতকে গুরু নানক পাঞ্জাবে শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বজুড়ে এখনও এর প্রায় আড়াই কোটি অনুসারী আছে।

ভারতে শিখরা সংখ্যালঘু; দেশটির জনসংখ্যার অনুপাতে এই সংখ্যা ২ শতাংশেরও কম। কিন্তু পাঞ্জাবে আবার তার সংখ্যাগরিষ্ঠ।

আধুনিক খালিস্তান আন্দোলনের উৎস পাওয়া যায় ১৯৪৭ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে ভারতের স্বাধীনতা লাভের সময়কালে। সেসময় অনেক শিখই পাঞ্জাবকে ঘিরে শিখ ধর্মের অনুসারীদের জন্য একটি দেশ দাবি করেছিলেন।

ভারত শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা পেল; দেশ হল দুটি, তাও ধর্মের ভিত্তিতেই। মুসলমানরা পেল নবগঠিত পাকিস্তান, আর হিন্দু আর শিখতের বরাতে জুটল স্বাধীন ভারত।

ওই দেশভাগকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট দাঙ্গা আনুমানিক ১০ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল; ৯০ লাখ মুসলমান এবং ৫০ লাখ হিন্দু ও শিখকে উদ্বাস্তুতে পরিণত করেছিল।

দু-টুকরো হওয়া পাঞ্জাব সেসময় রক্তাক্ত সব সহিংসতার সাক্ষী হয়েছিল। ওই সময় থেকেই শিখরা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াই শুরু করে, যার সূত্র ধরেই খালিস্তান আন্দোলন দৃঢ় ভিত্তি পায়।

এরপর এই আন্দোলনের অনুসারীদের সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সেনাদের অনেকবার সংঘর্ষ হয়েছে, অনেক রক্ত ঝরেছে।

“পাঞ্জাবে ধর্ম ও আঞ্চলিকতা এক হয়ে যায়। খালিস্তান আন্দোলনের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল আঞ্চলিক বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ধারাবাহিক হস্তক্ষেপও,” বলেছেন পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আশুতোষ কুমার। 

কিন্তু ১৯৮৪ সালে স্বর্ণ মন্দিরে ভারতীয় সেনার হানা সব কিছুকে ছাড়িয়ে যায়; ওই দিনটির স্মৃতি ভারত ও ভারতের বাইরে শিখদের এখনও তাঁতিয়ে দেয়।

ওই দশকেই পাঞ্জাবের অনেক শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীই বেসামরিক হত্যা, নির্বিচারে বোমা হামলা, সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর হামলাসহ একের পর এক মানবাধিকার লংঘন করেছে বলে জানাচ্ছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

অবশ্য কেবল তারাই নয়, বিদ্রোহ দমনের নামে ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষীরাও ‘লাখ লাখ শিখের’ ওপর চালিয়েছে অবর্ণনীয় নির্যাতন, করেছে অসংখ্য মানবাধিকার লংঘন, বলছে মানবাধিকার সংগঠনটি।

তবে খালিস্তানের সমর্থকরা এখন পাঞ্জাবে ‘অত্যন্ত নগণ্য’ এবং খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয় বলেই মনে করছেন আশুতোষ কুমার।

“পাঞ্জাবের শিখরা জানে, যদি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ফিরে আসে তাহলে তাদেরকেই সবচেয়ে বেশি ভুগতে হবে,” বলেছেন তিনি।

ভারতের বেআইনি কর্মকাণ্ড (প্রতিরোধ) আইনে খালিস্তান আন্দোলনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত অসংখ্য সংগঠনকে ঢোকানো হয় ‘সন্ত্রাসী সংগঠনের’ তালিকায়।

কিন্তু বিদেশে খালিস্তানের সমর্থকরা অবাধে চলাচল করতে পারছে। কানাডা, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ায় শিখদের অনেকের কাছে এই আন্দোলন সমর্থনও পাচ্ছে।

অমৃতপালের সমর্থকরা এরই মধ্যে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ভারতীয় কনস্যুলেটে তাণ্ডব চালিয়েছে, ভারতের জাতীয় পতাকা নামিয়ে, সেখানে খালিস্তানের প্রতীক বসিয়ে দিয়েছে। বিক্ষোভ হয়েছে কানাডাতেও।

“সম্ভবত বাইরে এর পক্ষে সমর্থন বেশি, কারণ প্রবাসীরা তাদের শেকড় খুঁজছে। দশকের পর দশক ধরে কেন্দ্রীয় সরকার পাঞ্জাবের শিখদের দমিয়ে রেখেছে। তাই প্রবাসীরাদের মধ্যে খালিস্তানকে সমর্থনের মাধ্যমে তারা পাঞ্জাবে তাদের ভাইদের সমর্থন দিচ্ছে, এমন ভাবনাও খেলতে পারে,” বলেছেন আশুতোষ।