বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবেলায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন বাড়াচ্ছে চীন। এর ফলে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমণ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন পরিবেশবাদীরা।
Published : 28 Aug 2022, 09:33 AM
তীব্র খরা আর রেকর্ড তাপ প্রবাহের কারণে সৃষ্ট বিদ্যুৎ সংকটে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বিপর্যস্ত হয়ে আছে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সিচুয়ান প্রদেশ।
দীপ্তি হারিয়েছে ৮ কোটি মানুষের এ জনপদের আকাশচুম্বী অট্টালিকাগুলো। বন্ধ হয়ে গেছে কল কারখানা, অন্ধকার হয়ে আছে সাবওয়ে। ঘরবাড়ি আর অফিসগুলোও ডুবে থাকছে আঁধারে।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রগুলো সবসময় বন্ধ রাখতে হচ্ছে। বিদ্যুতের অভাবে খামারগুলোতে অতিরিক্ত গরমে মারা গেছে হাজারো হাঁস-মুরগি আর মাছ।
এর প্রভাব পড়েছে পাশের মেগা শহর চংকিং এবং ইয়াংজি নদীর ধার ঘেঁষা পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোসহ বাণিজ্য কেন্দ্র সাংহাই পর্যন্ত। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে গত সপ্তাহে সেখানকার বড় অট্টলিকাগুলোয় কোনো বাতি জ্বলেনি।
সিএনএন এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আর স্থিতিশীলতার জন্য গর্বিত এই দেশটি এমন বিদ্যুৎ ঘাটতিতে পড়ায় বড় ধাক্কা খেয়েছেন সেখানকার মানুষ।
গত কয়েক দশক ধরে উন্নত জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত বাসিন্দাদের অনেকেরই স্মৃতিতে এখন ভাসছে সুদূর অতীতের কথা। দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসা চকচকে নগরিক জীবনের আগের দিনগুলো।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আর নিরাপত্তা এখন হুমকির মুখে।
চীনের এই তাপ প্রবাহকে গত ছয় দশকের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র বলা হচ্ছে। ৭০ দিন ধরে দেশটির বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে প্রচণ্ড তাপদাহে কয়েশ আবহাওয়া স্টেশনের তাপমাত্রার রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
শক্তিশালী অর্থনীতি আর বিশাল জনসংখ্যার এ দেশটিতে বিদ্যুতের কোনো বড় ধরনের বিপর্যয় হলে তা ব্যাপক ক্ষতি আর ভোগান্তি নিয়ে আসবে।
বেইজিংয়ে গ্রিনপিসের জলবায়ু উপদেষ্টা লি শুও বলেছেন, “তথাকথিত এই চরম আবহাওয়া আমাদের জীবনযাত্রা আর বিদ্যুৎ সরবরাহের ওপর আরও প্রভাব ফেলবে।
“সম্ভবত আমাদের ভাবা দরকার এই চরম অবস্থাটি আমাদের জীবনে নতুন স্বাভাবিকতা হয়ে উঠবে কি না।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিচুয়ানের এই বিদ্যুৎ বিপর্যয় জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় চীনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা যে, প্রয়োজনের চেয়ে কম শক্তিশালী তার একটি উদাহরণ।
কেউ কেউ মনে করছেন, চীনের বিদ্যুৎ খাত সংস্কারের সঠিক পথেই রয়েছে। তবে বাকিদের উদ্বেগ, এর ফলে জ্বালানি সরবরাহ নিরাপদ রাখতে আরও বেশি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পথে এগুতে হবে।
যা ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বোচ্চ কার্বন হ্রাস এবং ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা শূন্যের ঘরে নামিয়ে আনতে চীনের দেওয়া প্রতিশ্রুতিকে খর্ব করবে।
কিভাবে ঘাটতি হল বিদ্যুতে?
চীনের দীর্ঘতম নদী ইয়াংজির উপরের অংশে অবস্থান করা সিচুয়ান প্রদেশ জলজ সম্পদের জন্য বিখ্যাত এবং জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওপর এর বড় ধরনের নির্ভরশীলতা রয়েছে।
কিন্তু প্রচণ্ড তাপমাত্রা আর দীর্ঘস্থায়ী খরায় সিচুয়ানের জলাধারগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে, সংকটে পড়েছে এসবের ওপর নির্ভরশীল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো। এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোই সিচুয়ানের ৮০ শতাংশ বিদ্যুতের যোগান দেয়।
প্রদেশটির বিদ্যুৎ গ্রিড অনুযায়ী, এই মাসে জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ৫০ শতাংশ কমে গেছে। অন্যদিকে অবিরাম তাপপ্রবাহে গরমে অতিষ্ঠ নরগরবাসী।
এছাড়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের চাহিদা এবং ব্যবহার বেড়েছে। ফলে বিদ্যুতের চাহিদাও বেড়েছে, উল্টোদিকে উৎপাদন কমে গেছে।
ফিনল্যান্ডের হেলসিংকির সেন্টার ফর রিসার্চ অন অ্যানার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের (সিআরইএ) প্রধান বিশ্লেষক লরি মাইলিভার্তা বলেন, চীনের বিদ্যুৎ চাহিদা অতীতে অবিশ্বাস্যরকম কম ছিল।
“কারণ, বিদ্যুতের চাহিদার বেশিরভাগই ছিল শিল্পাঞ্চলগুলোতে। এখন হরহামেশাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে এবং চাহিদা বাড়ছেই।
একই সময়ে বৃষ্টিপাতের বিষয়টি খুবই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ভারি বৃষ্টি এবং খরার কারণে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর জন্য উৎস হিসেবে বৃষ্টির পানি আরও কম নির্ভরযোগ্য হয়ে পড়েছে।
চীনা বিদ্যুৎ বিশ্লেষক ডেভিড ফিশম্যানের মতে, বর্ষাকালে ব্যাপক বিদ্যুৎ রপ্তানি করে থাকে সিচুয়ান। মোট উৎপাদনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ তারা পূর্ব চীনের প্রদেশগুলোতে বিতরণ করে।
“কিন্তু সিচুয়ানের বাকি গ্রিডগুলোর সঙ্গে অন্য প্রদেশগুলোর সত্যিকার অর্থে কোনো সংযোগ নেই। সিচুয়ানের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে তারা কখনও আগ্রহ দেখায়নি।”
‘তৃষ্ণা মিটছে বিষে’
বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবেলায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন বাড়াচ্ছে চীন। এর ফলে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমণ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন পরিবেশবাদীরা।
সিচুয়ান গুয়াংআন পাওয়ার জেনারেশন এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র। টানা ২১ দিন ধরে পুর্ণ সক্ষমতা নিয়ে চলছে এই কেন্দ্রটি।
তারা বলছে, চলতি অগাস্ট মাসের বিদ্যুৎ উৎপাদন এক বছর আগের চেয়ে ৩১৩ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চাহিদা পূরণে প্রদেশটিতে আরও বেশি কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। সিচুয়ান কয়লা শিল্প গ্রুপের সবচেয়ে বড় খনি থেকে অগাস্টের মাঝামাঝি তাপীয় কয়লা উৎপাদন দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। গত সপ্তাহে প্রথম জাতীয় কয়লা রিজার্ভ খুলেছে সিচুয়ান।
ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিফর্ম কমিশনের মতে, দেশব্যাপী গত বছরের একই সময়ের তুলনায় অগাস্টের প্রথম দুই সপ্তাহে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে দৈনিক কয়লার ব্যবহার ১৫ শতাংশ বেড়েছে।
গত সপ্তাহে, চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী হ্যান ঝেং বলেছিলেন, সরকার স্থিতিশীল বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে কয়লা কেন্দ্রগুলোর জন্য সহায়তা বাড়াবে।
গ্রিনপিসের উপদেষ্টা লি বলছেন, কয়লা ব্যবহার বাড়ানো সম্ভবত একটি অস্থায়ী সমাধান, তবে জলবিদ্যুতের সংকটে কয়লা ব্যবহারে ইচ্ছুক গোষ্ঠীগুলো কয়লাভিত্তিক আরও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণে উৎসাহিত হবে।
“ভবিষ্যতে চরম আবহাওয়ার কারণে বিদ্যুতের ঘাটতি চীনকে আরও কয়লাচালিত বিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদনের তাগিদ দেওয়ার ক্ষেত্রে চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে।”
গ্লোবাল এনার্জি মনিটরের চীনা গবেষক ইউ আইকুন জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য কয়লার দিকে ঝুঁকে যাওয়াকে ‘বিষ দিয়ে তৃষ্ণা মেটানোর’ সঙ্গে তুলনা করেছেন।
তিনি বলেন, “কয়লার শক্তির প্রতি চীনের মোহ রয়েছে। বিদ্যুতের সমস্যা দেখা দিলে কয়লার উপর নির্ভর করার খুব শক্তিশালী মনোবাসনা রয়েছে।
“যখনই কোনো বিদ্যুৎ সমস্যা তৈরি হয়, তারা সবসময় কয়লার শক্তি থেকে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে...যা জলবায়ুতে চীনের যে লক্ষ্য রয়েছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত।”
‘বিশাল চ্যালেঞ্জ’
প্রতিবেদনে বলা হয়, জ্বালানি সংকটে চীনের নেওয়া পদক্ষেপ গোটা বিশ্বের ওপরই প্রভাব ফেলবে।
১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশটি বিশ্বের বৃহত্তম কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনকারী দেশ। বিশ্বব্যাপী যে পরিমাণ কার্বন নির্গমন হয়, তার ২৭ শতাংশের জন্য একাই দায়ী চীন।
কিন্তু কিছু বিশ্লেষক বলছেন, কয়লা সক্ষমতা বাড়ানো কেবল জরুরি জ্বালানি ঘাটতি মেটানোর অংশ।
সিআরইএ’র মাইলিভার্তার জানান, গত বছর বিদ্যুতের ঘাটতির পর চীন সরকার মূল্য বাড়িয়ে ক্লিন এনার্জির লাভ বাড়ানোর জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে।
“চীনের নেওয়া ব্যবস্থায় বড় চ্যালেঞ্জ হল গ্রিড খুব কঠোরভাবে পরিচালিত হচ্ছে। প্রদেশগুলো একে অপরে বিদ্যুৎ শেয়ার করছে না। নিজেদের সর্বোচ্চ সক্ষমতা দিয়ে নিজ অঞ্চলের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে।
“যদিও, চীনের বিদ্যুত গ্রিডকে আরও দক্ষতার সঙ্গে এবং নমনীয়ভাবে পরিচালনা করা গেলে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা যেতে পারে।”
নতুন কয়লা শক্তি ছাড়াও চীন নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে। বিশ্বের মোট বায়ু ও সৌর জ্বালানির ৩৫-৪০ শতাংশই চীনের।
জ্বালানি উপদেষ্টা ফিশম্যান বলেন, “নতুন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই; এগুলো দ্রুত সম্প্রসারিত নবায়নযোগ্য জ্বালানি সেক্টরের ব্যাকআপ হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল...যদি তা সিচুয়ানের চলমান খরার মতো সমস্যায় পড়ে।”
তিনি জানান, চীনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার পরিকল্পনাকারীরা তাদের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সচেতন এবং সামগ্রিকভাবে এই খাতকে ‘সঠিক পথে’ নিয়ে যাচ্ছে।
আরও খবর