জীবাশ্ম জ্বালানি বিস্তার রোধ চুক্তি কী, কেন এই দাবি?

মিশরে জলবায়ু সম্মেলনে এই প্রস্তাব তুলেছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশ টুভ্যালু।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Nov 2022, 06:24 PM
Updated : 12 Nov 2022, 06:24 PM

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছিল গত বছরের জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬। ক্ষতি কাটাতে শিল্পোন্নত দেশগুলোর অর্থায়নেরও কোনো প্রতিশ্রুতি সেসময় আদায় করা যায়নি। তবে এবার কপ-২৭ সম্মেলনে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে চুক্তি করার দাবি উঠেছে।

মিশরে চলা জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে এই প্রস্তাব তুলেছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশ টুভ্যালু। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এমন দেশের একটি টুভ্যালু।

টুভ্যালুর প্রধানমন্ত্রী কাউসিয়া নাতানো তার সঙ্গী নেতাদের উদ্দেশে বৃহস্পতিবার জলবায়ু সম্মেলনে বলেন, “আমরা সবাই জানি জলবায়ু সংকটের প্রধান কারণ হল জীবাশ্ম জ্বালানি। আর পরিবেশ খুব উষ্ণ হয়ে উঠছে।

“তাপমাত্রার বৃদ্ধি গতিকে মন্থর করা ও ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রাকে বিপরীত অবস্থায় ফেরানোর জন্য খুব কম সময়ই হাতে আছে। তাই দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়াটা অপরিহার্য।”

Also Read: জলবায়ু পরিবর্তন আসলে কী

Also Read: জলবায়ু সঙ্কট এড়াতে ২০২২ সালে কী করেছেন বিশ্ব মোড়লরা?

Also Read: কপ-২৭: জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই ‘বেঁচে থাকার যুদ্ধ’

কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের বিস্তার রোধ চুক্তির ধারণাটির উদ্যোক্তা কানাডার পরিবেশবাদী কর্মী জেপোরা বর্মন।

জলবায়ু নিয়ে চালানো ক্যাম্পেইন, ভ্যাটিকানের মতো ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং কিছু বিজ্ঞানীদের মধ্যে এই ধারণাটি বেশি প্রচলিত ছিল। কিন্তু জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে টুভ্যালুর প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে জীবাশ্ম জ্বালানি বিস্তার রোধ চুক্তির বিষয়টি আরও জোরালো হয়েছে।

প্রস্তাবিত এই চুক্তিতে কে, এতে কী আছে, তা তুলে ধরেছে যুক্তরাজ্যের দৈনিক গার্ডিয়ান।

জীবাশ্ম জ্বালানি বিস্তার রোধ চুক্তি কী?

এটি একটি প্রস্তাবিত চুক্তি, যেখানে স্পষ্টভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার না বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। এর লক্ষ্য মূলত কয়লা, তেল ও গ্যাসের ব্যবহারের পরিবর্তে ‘ক্লিন এনার্জি’ বা পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে ফেরা।

কেন প্রয়োজন?

জীবাশ্ম জ্বালানি বিস্তার রোধ চুক্তির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে এর প্রধান উদ্যোক্তা জেপোরা বর্মন বলেছেন, ৩০ বছর ধরে আমরা কার্বন নির্গমন হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা তৈরি করে আসছি, কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্প ক্রমাগত উৎপাদন সম্প্রসারণ করেই চলেছে।

“আমরা জীবাশ্ম জ্বালানির সরবরাহ না কমিয়ে জীবাশ্ম জ্বালানির চাহিদা কমানোর চেষ্টা করছি। বিষয়টি কাঁচির অর্ধেক অংশ দিয়ে কেটে ফেলার মতো।”

“বিশ্বের সরকারগুলো কোথায় কী উৎপাদন করতে পারবে সে ব্যাপারে কোনো চুক্তি নেই। আর একটি চুক্তি ছাড়া আমরা কার্বন নির্গমনের সূচক রেখা অবদমিত করতে পারব না,” বলেন তিনি।

জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনের সমস্যা কী?

সমস্যাটি হল- বিভিন্ন কোম্পানি ও সরকারি মজুদগুলোতে অনেক বেশি কয়লা ও তেল-গ্যাস রয়েছে এবং উৎপাদনের আরও পরিকল্পনা রয়েছে। প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হলেও এগুলো পোড়ানো যাবে না।

আরেকটি বিষয় হল, বর্তমানে কোম্পানিগুলোর হিসাবে থাকা সমস্ত জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ালে নিশ্চিতভাবে জলবায়ু বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। গুরুত্বপূর্ণ অনেক গবেষণাই এই অনুমানকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারকারী বিশ্বের বৃহত্তম কোম্পানিগুলো ‘কার্বন বোমা’ অর্থাৎ অসংখ্য তেল-গ্যাস প্রকল্পের পরিকল্পনা করছে। এটি এটিই বিশ্বব্যাপী বয়ে আনবে বিপর্যয়।

কোনো দেশ এই চুক্তিতে আসবে কেন?

যদি কোনো দেশ কয়লা ও তেল-গ্যাস থেকে লাভ করতেই থাকে, তবে অন্য দেশ নিজেদের জীবাশ্ম জ্বালানির উৎপাদন কমাতে চাইবে না।

কিন্তু একটি আন্তর্জাতিক চুক্তির ফলে একসঙ্গে সুষ্ঠুভাবে এই জ্বালানির ব্যবহার কমানোর অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে এগোতে পারে দেশগুলো।

এরকমই চুক্তি এর আগে সফলভাবে পারমাণবিক অস্ত্রাগার ও ল্যান্ডমাইন বিস্তার রোধ করেছে।

চুক্তি কাজ করবে কীভাবে?

জীবাশ্ম জ্বালানির জন্য দেশগুলোকে বৈশ্বিক নিবন্ধীকরণের আওতায় পরিকল্পনা রয়েছে। এর ফলে জীবাশ্ম জ্বালানির মজুদ সম্পর্কে ব্যাপক মানসম্মত, সরকার-পরীক্ষিত ও সবার জন্য লভ্য তথ্য সন্নিবেশিত থাকবে। এতে একটি দেশে জীবাশ্ম জ্বালানির রিজার্ভ কী পরিমাণ আছে, অন্য দেশ তা জানতে পারবে। ফলে জ্বালানি হ্রাসের আলোচনা উভয়ে এগিয়ে যেতে পারবে।

এই ‘গ্লোবাল রেজিস্ট্রির’র ফলে দেশগুলোর জবাবদিহিতা থাকবে। বর্তমানে জীবাশ্ম জ্বালানির মজুদের বিষয়ে খুব কমই সরকারি তথ্য রয়েছে।

পক্ষে কারা?

সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এই জীবাশ্ম জ্বালানির বিস্তার রোধ চুক্তির বিষয়টি তুলেছিল ভানুয়াতু। আর কপ-২৭ সম্মেলনে প্রস্তাব তুলেছে টুভ্যালু।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে সমর্থন দিয়েছে। ভ্যাটিকান এবং ১৫০ কোটি মানুষের প্রতিনিধত্বকারী সেখানকার ধর্মীয় নেতারাও একে সমর্থন দিয়েছেন।

এ ছাড়া ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, লন্ডন, প্যারিস ও লস অ্যাঞ্জেলেসসহ ৭০টি শহর এবং ১ হাজার ৭০০ এনজিও একে সমর্থন দিয়েছে।