Published : 04 Apr 2025, 10:26 AM
গাজার উত্তরাঞ্চলে বাস্তুচ্যুত পরিবারের আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত একটি স্কুলে ইসরায়েলি বিমান হামলায় অন্তত ২৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে এ খবর দিয়েছে বিবিসি।
স্থানীয় একটি হাসপাতালকে উদ্ধৃত করে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গাজা সিটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় তুফাহ জেলার দার আল-আরকাম স্কুলে ওই হামলায় আরো কয়েক ডজন মানুষ আহত হয়েছেন।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলেছে, তারা ওই শহরে ‘হামাসের কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারে থাকা চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের’ ওপর হামলা চালিয়েছে।
এর আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় আরও ৯৭ জন নিহত হওয়ার খবর জানিয়েছিল। ইসরায়েল বলছে, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের বৃহৎ অংশ দখল করতে তাদের স্থল অভিযান বিস্তৃত হচ্ছে।
গাজার হামাস পরিচালিত বেসামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগের মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল বলেছেন, দার আল-আরকাম স্কুলে হামলায় নিহতদের মধ্যে শিশু ও নারীও রয়েছে।
তিনি বলেন, যমজ সন্তানের গর্ভবতী এক নারী, তার স্বামী, তার বোন এবং তার তিন সন্তান নিখোঁজ রয়েছেন।
কাছের আল-আহলি হাসপাতালের ভিডিওতে দেখা গেছে, গুরুতর আহত অবস্থায় শিশুদের গাড়ি ও ট্রাকে করে সেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গাজা শহরের যে স্থানে হামলা চালানো হয়েছে, সেটিকে হামাস যোদ্ধারা ‘ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিক ও সেনাদের বিরুদ্ধে হামলার পরিকল্পনা করতে’ ব্যবহার করছিল।
বিবৃতিতে দাবি করা হয়, বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগ জানিয়েছে, গাজা সিটির পূর্বাঞ্চলীয় শেজাইয়া জেলার বেশ কয়েকটি বাড়িতে রাতভর হামলায় অন্তত ১২ জন নিহত হয়েছেন।
তারা একটি ভিডিও পোস্ট করেছে, যাতে দেখা গেছে, একটি ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসাবশেষ থেকে দুই শিশুর মরদেহ টেনে বের করছে উদ্ধারকারীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রত্যক্ষদর্শী বিবিসি আরবির গাজা লাইফলাইন প্রগ্রামকে বলেন, তিনি যখন ঘুমিয়ে ছিলেন, তখন হঠাৎ প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠেন। পরে আবিষ্কার করেন, প্রতিবেশী আইয়াদ পরিবারের বাড়িতেই সেটা ঘটেছে।
আইডিএফের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে বৃহস্পতিবার সকালে তারা শেজাইয়া এবং পার্শ্ববর্তী চারটি এলাকার বাসিন্দাদের অবিলম্বে পশ্চিম গাজা সিটিতে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। আইডিএফ তখন সতর্ক করে বলেছিল, ‘সন্ত্রাসী অবকাঠামো ধ্বংসে’ তারা প্রবল শক্তি নিয়ে কাজ করছে।
চলতি সপ্তাহে আইডিএফ গাজার উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি এলাকা, দক্ষিণাঞ্চলীয় রাফাহ শহর এবং পার্শ্ববর্তী খান ইউনিসের কিছু অংশে একই ধরনের নির্দেশ জারি করে, যার ফলে প্রায় এক লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়।
জানুয়ারিতে হামাসের সঙ্গে সম্মত হওয়া যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তির চুক্তির প্রথম পর্যায় শেষে এবং চুক্তির দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা স্থগিত হওয়ার পরে ইসরায়েল ১৮ মার্চ ফের গাজায় বিমান থেকে বোমা হামলা এবং স্থল আক্রমণ শুরু করে।
আইডিএফের প্রধান মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডেফ্রিন বৃহস্পতিবার এক ব্রিফিংয়ে বলেন, সাম্প্রতিক দিনগুলোতে তাদের অভিযান ‘অন্য পর্যায়ে অগ্রসর হয়েছে’।
“রাফাহ এলাকাকে ঘিরে ফেলতে ও বিভক্ত করার লক্ষ্যে দক্ষিণ গাজায় আমরা অভিযান সম্প্রসারণ করেছি। গাজার উত্তরাঞ্চলে আমাদের সেনারা সন্ত্রাসী লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে, এলাকা পরিষ্কার করছে এবং সন্ত্রাসী অবকাঠামো ধ্বংস করছে।”
তিনি বলেন, গত দুই সপ্তাহে ইসরায়েলি বাহিনী গাজাজুড়ে ৬০০টিরও বেশি 'সন্ত্রাসী লক্ষ্যবস্তুতে' হামলা চালিয়েছে এবং ২৫০ জনের বেশি সন্ত্রাসীকে নির্মূল করেছে।
তুফাহতে হামলার আগে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, একই সময়ে অন্তত ১ হাজার ১৬৩ জন নিহত হয়েছে। জাতিসংঘের একটি সংস্থা জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে ৩০০ জনের বেশি শিশু রয়েছে।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বুধবার সন্ধ্যায় বলেন, ইসরায়েলি বাহিনী আরেকটি সামরিক করিডোর প্রতিষ্ঠা করছে, যা খান ইউনিসের কাছ থেকে রাফাহকে বিচ্ছিন্ন করবে।
তার যুক্তি, সামরিক চাপে হামাস তাদের হাতে থাকা বাকি ৫৯ জন জিম্মিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হবে, যাদের মধ্যে ২৪ জন জীবিত রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে হামাস বলেছে, নতুন যুদ্ধবিরতির জন্য ইসরায়েলের সর্বশেষ প্রস্তাবে তারা জড়াবে না। তারা কেবল ৫০ দিনের যুদ্ধবিরতির জন্য অন্য দুই মধ্যস্থতাকারী কাতার ও মিশরের প্রস্তাবকে মানছে।
বিবিসি লিখেছে, এই পরিকল্পনার সম্পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করা হয়নি। তবে বোঝা যাচ্ছে যে- আঞ্চলিক প্রস্তাবে ফিলিস্তিনি বন্দিদের বিনিময়ে পাঁচজন জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হবে; গাজার যেসব অংশে সম্প্রতি ফের ইসরায়েলি বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে তা প্রত্যাহার এবং মানবিক সহায়তার বিষয় থাকবে। যুদ্ধ শেষ করার বিষয়েও আলোচনা হবে।
ইসরায়েল চাইছে, নতুন যুদ্ধবিরতির শুরুতে আরও বেশি সংখ্যক জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হোক।
অন্য এক ঘটনা নিয়ে বৃহস্পতিবার আইডিএফ বলেছে, গত ২৩ মার্চ রাফাহের কাছে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে ১৫ ফিলিস্তিনি জরুরি কর্মীর প্রাণহানির ঘটনা তদন্ত করছে জেনারেল স্টাফের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মেকানিজম। নিহতদের সমাধিকে ‘গণকবর’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা ।
আইডিএফের এক মুখপাত্র বলেন, “আমরা সব তথ্য এমনভাবে পেতে চাই- যা সঠিক এবং প্রয়োজন হলে আমরা লোকজনকে জবাবদিহিও করতে পারি।”
জরুরি আহ্বানে সাড়া দেওয়ার সময় কীভাবে পাঁচটি অ্যাম্বুলেন্স, একটি ফায়ার ইঞ্জিন এবং জাতিসংঘের একটি গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছিল তা বিবিসির কাছে তুলে ধরেছেন হামলায় বেঁচে যাওয়া এক ফিলিস্তিনি প্যারামেডিক।
সামরিক বাহিনী বলেছে, হেডলাইট বা জরুরি সংকেত ছাড়াই যানবাহনগুলো তাদের সৈন্যদের দিকে ‘সন্দেহজনকভাবে অগ্রসর হচ্ছিল’। নিহতদের মধ্যে হামাসের এক সদস্য ও ‘আরও আট সন্ত্রাসী’ রয়েছে বলে দাবি করেছে তারা।
তবে বেঁচে যাওয়া মুনতাহার আবেদ জোর দিয়ে বলেছেন, গাড়িগুলো সরাসরি গোলাগুলির কবলে পড়ার আগ পর্যন্ত ‘সব লাইট জ্বলছিল’।
অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে ঢাল হিসেবে হামাস ব্যবহার করে থাকতে পারে বলে সামরিক বাহিনী যে দাবি করছে, তা প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, জরুরি সেবার সব কর্মীই বেসামরিক নাগরিক।
হামাস ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালালে ১২০০ জন নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়। তার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী অভিযান শুরু করে, যাতে ৫০ হাজার ৫২০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।