ক্রেমলিনে ড্রোন হামলার ঘটনাটি আসলে কী?

পাল্টাপাল্টি অভিযোগের মধ্যে প্রশ্ন উঠছে অনেক; উত্তর মিলছে না।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 May 2023, 05:32 PM
Updated : 6 May 2023, 05:32 PM

চলমান ইউক্রেইন যুদ্ধের এক বছরেরও বেশি সময় পর চলতি সপ্তাহে সামনে এল রাশিয়ায় ঘটে যাওয়া কিছু চাঞ্চল্যকর দৃশ্য ও ছবি।

ক্রেমলিন সেনেট ভবন হিসেবে পরিচিত রুশ প্রেসিডেন্টের বাসভবনের গম্বুজের দিকে একটি বস্তু উড়ে যেতে দেখা গেছে এবং সেটি বিস্ফোরিত হয়েছে। ছাদের ওপর থেকে কালো ধোঁয়া উড়তে গেছে।

বুধবার ভোররাতের ওই ঘটনায় কেউ হতাহত হননি। আর প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও তখন ক্রেমলিনে ছিলেন না বলে তার দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে।

তবে ওই ঘটনাকে ড্রোন হামলা চালিয়ে পুতিনকে হত্যার চেষ্টা হিসেবে দেখে চটেছে রাশিয়া। ইউক্রেইনকে দায়ী করে এর জবাবে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন রুশ কর্মকর্তা; যদিও ইউক্রেইন এই অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছে।

বলা হচ্ছে, ড্রোন হামলা চালানো হয়েছে। কিন্তু যে ভিডিও ছড়িয়েছে সেটি আসলে যাচাই করা যায়নি। ফলে জল্পনা চলছে, আসলে কী ঘটেছে সেখানে?

বিবিসি লিখেছে, সেটি কি ড্রোন হামলা? দৃশ্যত তাই দেখা গেছে। কিন্তু কে এই আক্রমণ চালিয়েছে? ইউক্রেইন, রাশিয়ার অভ্যন্তরের লোকেরা, নাকি রাশিয়ারই কোনো কারসাজি? নাকি অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর কোনো কৌশল?

এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে বিবিসিরি রুশ সম্পাদক স্টিভ রজেনবার্গ বলছেন, এসবের অনেক কিছুই অস্পষ্ট। ক্রেমলিন বলছে, প্রেসিডেন্ট পুতিনকে হত্যার উদ্দেশ্যে ইউক্রেইন ড্রোন হামলা চালিয়েছে। কিন্তু পুতিনকে হত্যা চেষ্টার বিষয়টি অসম্ভবই মনে হচ্ছে। ক্রেমলিনে পুতিনের একটি ব্যক্তিগত অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। প্রধান বাসভবন সেখান থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে।

এমনকি রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনও এই অভিযোগ নিয়ে বুধবার সন্ধ্যায় সন্দেহ প্রকাশ করেছে বলে উল্লেখ করেছে বিবিসি। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত চ্যানেল ওয়ানের ভিয়েমা নিউজ বুলেটিনে এক বিশ্লেষক বলেন, ড্রোন দিয়ে চালানো এই ধরনের বিস্ফোরণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় না। ফলে স্পষ্টত এই আক্রমণ কেবল লোক দেখানোর জন্য।

Also Read: ‘পুতিনকে মারতে’ ড্রোন হামলা, জেলেনস্কির অস্বীকার

Also Read: ক্রেমলিনে ড্রোন হামলা মস্কোর জন্য কতটা লজ্জার?

ইউক্রেইনও পুতিনকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছে।

দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, “আমরা পুতিন বা মস্কোতে হামলা চালাইনি। আমরা আমাদের ভূখণ্ডে লড়ছি। আমাদের গ্রাম ও শহর রক্ষা করছি। ওই আক্রমণ চালানোর জন্য পর্যাপ্ত অস্ত্রও আমাদের হাতে নেই।”

কিন্তু আসলেই যদি ইউক্রেইন বা কিইভের প্রতি সহানুভূতিশীল রাশিয়ার কোনো গোষ্ঠী এই অপারেশন চালায়, কিংবা যদি তা শুধু লোক দেখানোর জন্যই হয়, তাহলে বিষয়টি কেমন হবে?

বিবিসি লিখেছে, সেটি হলেও রাশিয়ার জন্য তা হবে চরম বিব্রতকর। রুশ প্রেসিডেন্টের বাসভবন বিশ্বের সবচেয়ে সুরক্ষিত ভবনগুলোর একটি। সেখানে মস্কোর সমস্ত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সত্ত্বেও বিস্ফোরক সমৃদ্ধ দুটি ড্রোন অনুপ্রবেশ করেছে। এই ধরনের আক্রমণ প্রতিরোধে জ্যামিং সিস্টেমে ক্রেমলিনকে এমন বিপজ্জনক ড্রোন নির্দিষ্ট দূরত্বে রাখতে হবে।

এর আগে আরেকটি বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে বিবিসি জানায়, ক্রেমলিনের দাবি যদি সত্যি হয়, আর পুতিনকে হত্যাই যদি এর আসল উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, ক্রেমলিনের জন্য তা হবে চরম বিব্রতকর।

পুতিন বিশ্বের সবচেয়ে সুরক্ষিত নেতাদের একজন। মস্কোতে তার অনুষ্ঠান ঘিরে কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। আকাশ ও সড়কপথ বন্ধ রেখে ব্যাপক তল্লাশি চালানো হয়। প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা যানের দীর্ঘ সারিও দেখা যায়।

কিন্তু রুশ প্রেসিডেন্টের বাসভবনের মতো জায়গায় ড্রোন হামলার ঘটনায় এখন যে প্রশ্ন উঠছে তা হল, প্রেসিডেন্ট পুতিন আসলে কতটা সুরক্ষিত? আরও প্রশ্ন উঠছে, রুশ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এতটা নড়বড়ে?

এছাড়া সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়সহ মস্কোর গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলো ঘিরে বিমান-বিধ্বংসী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করতে দেখা গেছে। চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে ইউক্রেইন বা এর মিত্ররা গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যগুলোতে হামলা চালাতে পারে, সেই আশঙ্কা থেকে ওই ব্যবস্থা নিয়েছে ক্রেমলিন।

এখন রুশ প্রেসিডেন্টের বাসভবনে হামলার ঘটনা যদি সত্যি হয়, তার মানে দাঁড়াবে সেই বিমান-বিধ্বংসী ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে।

আরেকটি প্রশ্ন হল, ক্রেমলিনে এমন হামলা কি অঘটনযোগ্য বা অসম্ভব? এই প্রশ্নে আশির দশকের একটি ঘটনা সামনে আসে।

১৯৮৭ সালে জার্মান কিশোর ম্যাথিয়াস রাস্ট সোভিয়েত আকাশ প্রতিরক্ষা ভেদ করে রেড স্কয়ারে তার সেসনা বিমান অবতরণ করিয়েছিলেন। ফলে ইতিহাস বলছে, কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।

বলা হচ্ছে, রাশিয়ার টিভি চ্যানেলে প্রধান নিউজ বুলেটিনে ওই ঘটনাকে কীভাবে প্রচার করা হয়েছে। চলতি সপ্তাহের এটি শীর্ষ ঘটনা। কিন্তু বিবিসির স্টিভ রজেনবার্গ বলছেন, চ্যানেল ওয়ানের ভেমিয়া ও রাশিয়া ওয়ানের ভেস্তি নিউজ বুলেটিনে বিস্ফোরণ ও ধোঁয়ার সেই ভিডিও প্রচার করা হয়নি।

পরিবর্তে তারা ক্রেমলিন ও রেড স্কয়ারের রেকর্ডেড ভিডিও ব্যবহার করেছে। সম্ভবত এর কারণ, প্রতিরক্ষাহীন ক্রেমলিনে আক্রমণের সেই দৃশ্য এতটাই অস্বস্তিকর যে মস্কোর জন্য তা প্রচার করা কঠিন। রুশ সংবাদপত্রগুলো আক্রমণের পরদিন সেই খবর ছেপেছে, তবে তাও খুব বিস্তারিত আকারে নয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই ঘটনাকে ‘মিথ্যা’ দাবি করছেন অনেকে। কেউ সন্দেহ প্রকাশ করছেন, ইউক্রেইনের যুদ্ধের পরিস্থিতি ও উত্তেজনা আরও উস্কে দেওয়ার জন্য রুশ কর্তৃপক্ষ বা গোয়েন্দারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেইনে পুরোদস্তুর আক্রমণ শুরুর পর থেকে ক্রেমলিন দেখিয়েছে, কোনো অজুহাত ছাড়াই তারা সংঘাত বাড়াতে প্রস্তুত।

তাহলে সম্ভাব্য বিব্রতকর এই ঘটনা কেন তারা সাজাবে, যেটিকে অনেকে ক্রেমলিনের দুর্বলতা হিসেবে ব্যাখ্যা করবে?

এছাড়া টিভি নিউজ বুলেটিনগুলোর কথা ধরা যাক; তারা বিস্ফোরণের সেই দৃশ্য প্রচার এড়িয়ে চলেছে।

এসব প্রশ্নে অন্যান্য তত্ত্বও আছে। ক্রেমলিনের উপর প্রভাব বিস্তারে সেখানে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলাফল কী হতে পারে, সেই প্রশ্নও রয়েছে।

স্টিভ রজেনবার্গ বলছেন, “আমার কাছে এর নিশ্চিত কোনো উত্তর নেই, কেবল অনেক প্রশ্নই আছে।”