কানাডায় ২০২২ সালে এক লাখ পাঁচ হাজারেরও বেশি গাড়ি চুরির ঘটনা ঘটে, অর্থাৎ প্রতি ৫ মিনিটে একটি গাড়ি।
Published : 09 Jul 2024, 04:22 PM
কানাডার লোগান লাফার্নিয়া বছর দুয়েক আগে এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন গ্যারেজে তার পিকআপ গাড়িটি নেই। তার ব্র্যান্ড নিউ র্যাম রেবেল গাড়িটি খোয়া গেছে, যেটি দেড় বছর আগে কিনেছিলেন তিনি।
অন্টারিও প্রদেশের মিল্টন শহরের বাসিন্দা লাফার্নিয়ার নিরাপত্তা ক্যামেরার ভিডিওতে দেখেন, গভীর রাতে বাড়ির সামনে রাখা পিকআপে মুখোশ পরা দুই ব্যক্তি উঠে পড়ছেন, তারপর তারা অনায়াসেই সেই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে চলে যান।
কয়েক মাস পর এই একই গাড়ি বিক্রির বিজ্ঞাপন ঘুরছিল অনলাইনে, আটলান্টিক মহাসাগরের অপর পাড়ে প্রায় সাড়ে আট হাজার কিলোমিটার দূরে ঘানায় গাড়িটি বিক্রি হবে। গাড়িটি যে তারই তা একটি ছবি দেখে নিশ্চিত হন লাফার্নিয়ার।
তিনি বিবিসিকে বলেন, “গাড়ির মালিকানা বাতলে দেয় একটি ল্যাপটপ হোল্ডার, যেটি আমরা ছেলের জন্য চালক আসনের পেছনে লাগিয়েছিলাম। আর ওই হোল্ডারের মধ্যে সে (ছেলে) আবর্জনা ফেলে রেখেছিল।”
অনলাইনে কার লিস্টিংয়ে যেসব ছবি দেওয়া ছিল, তাতেও একই দৃশ্য ফুটে উঠেছিল বলে জানান তিনি।
লাফার্নিয়ার বলেন, “এটা যে আমার গাড়ি, তখন এ নিয়ে আমার মনে আর কোনো সন্দেহ ছিল না।”
কেবল লাফার্নিয়ারই এমন পরিস্থিতির শিকার হননি। ২০২২ সালে কানাডায় এক লাখ পাঁচ হাজারেরও বেশি গাড়ি চুরির ঘটনা ঘটে, মানে প্রতি ৫ মিনিটে একটি গাড়ি চুরি হয়। ভুক্তভোগীদের মধ্যে দেশটির কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীও আছেন; তার সরকারি টয়োটা হাইল্যান্ডার এক্সএলই চুরি হয়েছিল দুইবার।
কানাডা সরকারের এক মুখপাত্র বলেছেন, ১৩৭টি দেশের গাড়ি চুরি যাওয়ার যে তালিকা ইন্টারপোল এই গ্রীষ্মের শুরুতে করেছে, তাতে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পড়া ১০ দেশের মধ্যে আছে কানাডা। গাড়ি চুরি যাওয়ার সংখ্যাগত তথ্য গত ফেব্রুয়ারি থেকে ইন্টারপোলকে দিচ্ছে কানাডা।
কর্তৃপক্ষ বলছে, অনেকক্ষেত্রে অপরাধীরা গাড়ি চুরি করার পর সেটি ব্যবহার করে অন্য অপরাধকর্ম সারে। অথবা সেই গাড়ি সেখানকার এমন লোকের কাছে বিক্রি করা হয়, যাকে নিয়ে কারও সন্দেহ নেই। অনেকক্ষেত্রে ফের বেচতে চোরাই গাড়ি বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
ইন্টারপোল বলছে, গত ফেব্রুয়ারি থেকে বিশ্বজুড়ে দেড় হাজারেরও বেশি গাড়ি শনাক্ত করা হয়েছে, যেগুলো কানাডা থেকে চুরি করা হয়েছে। অন্য দেশের বন্দরে প্রতি সপ্তায় এমন প্রায় ২০০ গাড়ি শনাক্ত করা হচ্ছে।
গাড়ি চুরির এই হিড়িককে ‘জাতীয় সংকট’ হিসেবে ঘোষণা করেছে ইন্স্যুরেন্স ব্যুরো অব কানাডা। সংস্থাটি জানিয়েছে, গাড়ি খোয়ানোর ঘটনায় গেল বছর বীমাকারীদের ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে গাড়ি চুরি ঠেকানোর উপায় নিয়ে জনসচেতনতা তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কানাডার পুলিশ।
বিবিসি লিখেছে, কিছু কানাডিয়ান নিজেদের মতো ব্যবস্থা নিচ্ছেন, গাড়িতে ট্র্যাকার বসানো থেকে শুরু করে কমিউনিটির জন্য বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগসহ সবই করছেন।
যারা পারছে, তারা গাড়ি পার্কিং এলাকায় শক্তিশালী বোলার্ড বা দণ্ড বসাচ্ছে, বিশেষ করে ব্যাংক ও দূতাবাসগুলো চুরি ঠেকাতে এমন পদক্ষেপ নিচ্ছে।
টরন্টোর পাশের শহর মিসেসাগার বাসিন্দা নোমান খান ও তার ভাইও গাড়ি খুইয়েছেন। সেই তিক্ততার পর নোমান নিজেই বোলার্ড বসানোর ব্যবসা শুরু করেছেন।
নিজের বাড়ির এক ঘটনা তুলে ধরে নোমান বলেন, তার স্ত্রী ও শিশু সন্তান ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় চোরেরা বাড়িতে প্রবেশ করে। তারা বাড়ির সামনে পার্ক করা মার্সিডিজ জিএলই গাড়ির চাবি খুঁজছিল।তাদের মুখোমুখি হওয়ার পর নোমান দৌড় দিয়েছিলেন।
সেই ‘বেদনাদায়ক’ অভিজ্ঞতার পর পারিবারিক দুই পুরনো গাড়ি বাদে অন্যগুলো তারা বেচে দিয়েছেন।নোমান জানিয়েছেন, তিনি এখন ব্যবসা করতে গিয়ে টরন্টোজুড়ে লোকজনের কাছে একই ধরনের গল্প শুনছেন।
“আমাদের একজন গ্রাহক ছিল, যার বাড়ির রাস্তায় চোরের উৎপাত এত বেশি ছিল যে তিনি রাতের জন্য বাড়ির বাইরে নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগ করেছিলেন, কারণ তিনি কিছুতেই নিরাপদ বোধ করছিলেন না।”
কানাডায় গাড়ি চুরির ব্যাপকতাকে ‘বিস্ময়কর’ বর্ণনা করে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরিচালক অ্যালেক্সিস পিকিউয়েরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের তুলনায় অনেক কম জনসংখ্যার দেশে এমন অপরাধের উচ্চ হার ‘বিস্ময়কর’ ব্যাপার।
“যুক্তরাষ্ট্রের মতো অনেক বন্দরনগরীও নেই কানাডাতে,”বলেন তিনি।
কোভিড মহামারীর সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও যুক্তরাজ্যে গাড়ি চুরির উল্লম্ফন দেখা দিয়েছে। কানাডায় প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে গড়ে ২৬২ দশমিক ৫টি গাড়ি চুরি হয়েছে, যা ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের চাইতেও বেশি। হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে গড়ে ২২০টি গাড়ি চুরির ঘটনা ঘটেছে।
কানাডার গাড়ি চুরির হার যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় কাছাকাছি। ২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি এক লাখ মানুষের গড়ে ৩০০ গাড়ি খোয়া যায়।
বিবিসি লিখেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গাড়ি চুরির ঘটনা বৃদ্ধির জন্য মহামারীও দায়ী। সেসময় উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ায় নতুন-পুরনো সব ধরনেরই গাড়িরই চাহিদা বেড়ে যায়।
কানাডিয়ান অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক (সরকারি সম্পর্ক) ইলিয়ট সিলভারস্টেইন বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে নির্দিষ্ট মডেলের গাড়ির জন্য একটি ক্রমবর্ধমান বাজার গড়ে উঠছে, যেখান থেকে চোরাই গাড়ির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ আয়ের পথ খুলেছে সংঘবদ্ধ অপরাধী গোষ্ঠীগুলো।
সিলভারস্টেইন এও মনে করেন, কানাডার বন্দরগুলো যেভাবে পরিচালিত হয়, তাতে অন্যান্য দেশের তুলনায় সেখানে এ ধরনের চুরির ঝুঁকি বেশি থাকে।
“বন্দর ব্যবস্থাপনায় দেশ থেকে কী বের হচ্ছে তার চেয়ে দেশে কী আসছে সেদিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়।"
একবার কোনো গাড়ি শিপিং কনটেইনারে প্যাক হলে তা ধরা কঠিন হয়ে পড়ে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
চুরি হওয়া কিছু গাড়ি উদ্ধারের কথা জানিয়েছে পুলিশ। গত অক্টোবরে টরন্টো পুলিশ সার্ভিস জানিয়েছিল, ১১ মাসের তদন্তে ছয় কোটি কানাডিয়ান ডলার মূল্যের ১০৮০টি গাড়ি উদ্ধার করেছে তারা। আর এ বিষয়ে ৫৫০টিরও বেশি অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।
মন্ট্রিল বন্দরে মাঝ ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ৪০০ শিপিং কনটেইনারে তল্লাশি চালিয়ে চুরি হওয়া প্রায় ৬০০টি গাড়ি উদ্ধার করেছে সীমান্ত ও পুলিশ কর্মকর্তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্দর দিয়ে যে পরিমাণ পণ্য যাওয়া-আসা করে, তাতে এ ধরনের অভিযান চালানো কঠিন। ২০২৩ সালে কেবল মন্ট্রিল বন্দর দিয়ে ১৭ কোটি কনটেইনার যাওয়া-আসা করেছে।
বিবিসি লিখেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কনটেইনার তল্লাশির এখতিয়ার বন্দর কর্মীদের নেই। সীমান্ত কর্মকর্তারা কেবল কাস্টমস নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে ওয়ারেন্ট ছাড়া কনটেইনার খুলে দেখতে পারেন।
অন্যদিকে সীমিত জনবল দিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে কানাডা বর্ডার সার্ভিস এজেন্সিকে (সিবিএসএ) । গত এপ্রিলে সরকারের কাছে দেওয়া প্রতিবেদনে সংস্থাটি জনবল সংকটের কথা তুলে ধরেছে।
চোরাচালান ঠেকাতে বাধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মেয়াদোত্তীর্ণ প্রযুক্তিও।
কানাডার যেসব স্থানে গাড়ি চুরির ঘটনা বেশি তারে একটি অন্টারিও নগরীর ব্রাম্পটন। সেখানকার মেয়র প্যাট্রিক ব্রাউন সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির পোর্ট নেওয়ার্ক কনটেইনার টার্মিনাল পরিদর্শন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার তল্লাশি প্রক্রিয়ার পার্থক্য কী, সেটাই তিনি দেখতে চেয়েছেন।
তিনি কানাডার সংবাদপত্র ন্যাশনাল পোস্টকে বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্র (বন্দর) কর্তৃপক্ষ 'স্ক্যানার' পেয়েছে। তারা নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করে। তারা স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে।
“এই কাজগুলো আমরা কানাডায় করি না।”
কানাডা সরকার গত মে মাসে ঘোষণা দিয়েছে, সিবিএস‘র শিপিং কনটেইনার তল্লাশির সক্ষমতা বাড়াতে তারা কয়েক মিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার বরাদ্দ দেবে। নিজেদের কমিউনিটির গাড়ি চুরি ঠেকাতে পুলিশকেও অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া হবে।
অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক সিলভারস্টেইন মনে করেন, গাড়ি খোয়া যাওয়া নিয়ে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার জন্য উৎপাদকরাও কম দায়ী না।
“সবাই গাড়ি উদ্ধারের চেষ্টার কথা বলছে। কিন্তু আমার বুঝে আসে না যে, চুরি ঠেকাতে গাড়িগুলোকে কেন সেভাবে তৈরি করা হচ্ছে না।”
এদিকে লোগান লাফার্নিয়ারের মতো গাড়ির মালিকদের এখনো গাড়ি কীভাবে নিরাপদে রাখবেন তা নিয়ে ভাবনায় থাকতে হচ্ছে। র্যাম রেবেল পিকআপ চুরি হওয়ার পর তিনি কিনেছেন টয়োটা টুন্ড্রা, যাকে ‘স্বপ্নের গাড়ি’ বলে বর্ণনা করেছেন লাফার্নিয়ার।
চোর যাতে সহজে গাড়ি স্টার্ট দিতে না পারে, সেজন্য তিনি ইঞ্জিন ইমোবিলাইজার লাগিয়েছেন। চুরি হলে যাতে অবস্থান শনাক্ত করতে পারেন, সেজন্য ট্যাগ ট্র্যাকারও লাগিয়েছেন। স্টিয়ারিং হুইলের জন্য ক্লাব বা বিশেষ তালারও ব্যবস্থা করেছেন।
তবু চোরদের তৎপরতা থামেনি। লাফার্নিয়ারের টুন্ড্রা গাড়ি চুরি করতে পার্কিং এলাকায় এসেছিল দুজন। এবার অবশ্য চোররা কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে, তারা গাড়ির ভেতরে ঢোকার জন্য পেছনের জানালা ভাঙ্গছিল।
শব্দে ঘুম ভেঙে যায় লাফার্নিয়ারের, তিনি জরুরি সেবা ৯১১ এ ফোন দেন। পুলিশ আসতে ৪ মিনিটের মতো লেগে যায়, ততোক্ষণে চম্পট দেয় চোরেরা। এরপর সেই গাড়িতে নতুন কাচ লাগিয়ে তারপর সেটি বিক্রি করে দিয়েছেন লাফার্নিয়ার। গাড়ির নিরাপত্তার প্রশ্নে এইসব অনাকাঙ্ক্ষিত পরীক্ষা কেবল ‘হতাশায়’ ডুবিয়েছে তাকে।