অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যে সরকারি কর্মচারীদের বেতন দ্বিগুণ করতে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করেছে এশিয়ার দেশটি।
Published : 15 Apr 2025, 08:23 AM
নিজেদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন মাপতে বছরের পর বছর ধরে ‘অপ্রচলিত’ দুই মানদণ্ড ব্যবহার করছে ভুটান।
দুটি মাপকাঠির একটি হল ‘সুখ; আরেকটি ‘স্থায়িত্ব’।
কিন্তু ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক চাপ ও মেধাশক্তির ক্রমাগত ক্ষয়ের মধ্যে হিমালয়ের স্থলবেষ্টিত ছোট দেশটি অর্থনৈতিক অগ্রগতির আরেকটি ‘মাপকাঠি’সামনে এনেছে, যা ভুটানকে আর্থিক উদ্ভাবনে বিশ্বব্যাপী একটি ‘অগ্রণী’ ভূমিকায় ঠেলে দিচ্ছে।
তাদের সেই নতুন মাপকাঠির নাম ‘বিটকয়েন’।
ভৌগোলিকভাবে ভুটানের অবস্থান ভারত ও চীনের মাঝে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তারা লাখ লাখ ডলারের ‘বিটকয়েন মাইনিং’ করেছে।
বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এ ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে দেশটি এমন বাজি ধরেছে, যে সাহস কোনো দেশ এখনও দেখাতে পারেনি।
কিন্তু ভুটান কেন বিটকয়েনের পেছনে এত বিনিয়োগ করছে; কিংবা দেশটির কাছে বর্তমানে কী পরিমাণ বিটকয়েন রয়েছে?
আবার ডিজিটাল এ মুদ্রার দরে যে অপ্রত্যাশিত ওঠানামা চলে, তাতে ভুটানের এ পদক্ষেপ ঝুঁকিপূর্ণ কিনা, সে প্রশ্নও উঠেছে।
বিটকয়েন কী, কীভাবে ‘মাইনিং’ করতে হয়?
বিটকয়েন হল প্রথম বিকেন্দ্রীকরণ হওয়া ‘পিয়ার টু পিয়ার’ ক্রিপ্টোকারেন্সি, যা তৈরি হয় ২০০৮ সালে। এটা কোনো দেশের সরকার নিয়ন্ত্রণ করে না।
মানুষ এই মুদ্রা কেনাবেচা করতে পারে। এই মুদ্রার লেনদেনের সব তথ্য রেকর্ড থাকে ব্লকচেইনের লেজার বুকে।
বিটকয়েনের একটি মূল্য আছে। কারণ ব্লকচেইনে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে বিটকয়েন থাকে। সেটা বর্তমানে প্রায় দুই কোটি ১০ লাখের মত।
এসব বিটকয়েনের অধিকাংশই ‘মাইনিং’ করা হয়ে গেছে। বাকি আছে মাত্র ১০ লাখের মত।
বিটকয়েন মাইনিং এমন একটা প্রক্রিয়া, যার মধ্য দিয়ে ব্লকচেইনে আনুষ্ঠানিকভাবে বিটকয়েন যুক্ত হয়।
বিটকয়েন মাইনিং করতে হলে যে জটিল ‘ধাঁধার’ সমাধান করতে হয়, তাতে সুপারকম্পিউটার প্রয়োজন পড়ে। এ ধরনের কম্পিউটারে জ্বালানি খরচ অনেক বেশি।
ভুটান কতটা মাইনিং করছে?
ভুটানে সুপারকম্পিউটারের জ্বালানি আসে জলবিদ্যুৎ থেকে।
গত মার্চ মাসে সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে দেশটির প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে বলেন, “এটি একটি সহজ উপায়, যার মাধ্যমে অনেকেই কোটি কোটি ডলার আয় করেছেন। আমি মনে করি, বিভিন্ন দেশের সরকারেরও সেটা করা উচিত।”
তোবগে বলেন, “গ্রীষ্মের মাসগুলোয় পানির প্রবাহ বাড়বে এবং জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে।”
বিটকয়েনে অর্থনৈতিক মুক্তি কীভাবে?
ভুটানের অর্থনৈতিক সংকটের একটি বড় ধরনের ‘উপসর্গ’ হল, দেশটির তরুণ ও শিক্ষিত জনশক্তির বিদেশে পাড়ি জমানো। এ প্রবণতা দেশটির অর্থনৈতিক সংগ্রামকে আরও জটিল করে তুলছে।
শুধু ২০২২ সালেই দেশটির ১০ শতাংশের বেশি দক্ষ ও শিক্ষিত জনশক্তি বিদেশে পাড়ি জমায়।
এ ক্ষেত্রে তাদের সবচেয়ে পছন্দের গন্তব্য হল অস্ট্রেলিয়া। দেশটিতে ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ভুটানি অভিবাসীর সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ।
তোবগে বলেন, “আমাদের এখানে কর্ম আছে। কিন্তু এখানকার চেয়ে তারা অন্যান্য দেশে বেশি উপার্জন করতে পারেন।”
মূলত এই মেধা পাচারের কারণে ভুটানের সিভিল সার্ভিস দুর্বল হয়ে পড়ে। ২০১৯ সাল থেকে সিভিল কর্মচারীদের পদত্যাগের সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়ে যায়।
মূলত এমন এক বাস্তবতায় ভুটানের অর্থনৈতিক ‘উৎস’ হিসেবে আবির্ভূত হয় বিটকয়েন।
আল-জাজিরা বলছে, সরকারি চাকরিজীবীদের পারিশ্রমিক দ্বিগুণ করতে ২০২৩ সালে ১০ কোটি ডলারের ক্রিপ্টোকারেন্সি বিক্রি করে ভুটান সরকার।
নিজেদের হাতে কতটা ক্রিপ্টোকারেন্সি আছে, তা ভুটান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কখনো প্রকাশ করেনি।
ব্লকচেইন ইন্টেলিজেন্স ফার্ম- আরকামের তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ এপ্রিল ভুটান সরকারের কাছে ৬০ কোটি ডলারের বিটকয়েন ছিল, যা দেশটির মোট জিডিপির প্রায় ৩০ শতাংশ।
আরকামের দাবি, ভুটান সরকারের হাতে ইথারিয়ামসহ আরও কিছু ক্রিপ্টোকারেন্সি আছে, তবে পরিমাণে খুবই কম।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিটকয়েন মাইনিং কি টেকসই কোনো সমাধান?
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভুটান তার অর্থনীতির বিকাশে যেসব সুযোগ রেখেছে, বিটকয়েন মাইনিং সেগুলোর একটি, যা তাদের ‘সুখ’ আর ‘স্থায়ী’ মূল্যবোধের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।
নয়াদিল্লিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের’ গবেষক অদিত্য শিবামূর্তি বলেন, “ভুটানে সীমিত কিছু বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হয়। কারণ দেশটিতে ৬০ শতাংশ বনভূমি রাখার বাধ্যবাধকতা আছে। সুখ আর টেকসই অর্থনীতির মানদণ্ডও মানতে হয় তাদের।”
একই ধরনের কথা শোনা যায় প্রধানমন্ত্রী তোবগের মুখেও। তিনি বলেন, “বিদেশি বিনিয়োগের ব্যাপারে আমরা খুবই সতর্ক। পরিবেশ কিংবা আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষতি করে, এমন শিল্পকারখানার ব্যাপারে আমরা খুবই সাবধানি।”
ভারতে জলবিদ্যুৎ রপ্তানি করে ভুটান। বর্তমানে বিটকয়েনও তাদের বিকল্প ‘রপ্তানির বাজার’ হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
ভুটান সরকারের বাণিজ্যিক ও বিনিয়োগের দেখভাল করে ‘দ্রুক হোল্ডিংস অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টস’।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উজ্জ্বল দীপ দাহাল বলেন, “বিটকয়েনে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গ্রিন এনার্জিটা কাজে লাগানো আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।”