বাড়ছে বিশ্বের তাপমাত্রা, সেই সঙ্গে মানুষের থাকার জায়গা আর খাবারের যোগান বাড়াতে গিয়ে বন উজাড় চলছে, চরমে পৌঁছাচ্ছে ভূমির ব্যবহার; সব মিলিয়ে পৃথিবীর অনেক এলাকায় কীটপতঙ্গের বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলছে বলে উঠে এসেছে এক গবেষণায়।
Published : 25 Apr 2022, 09:27 AM
বুধবার নেচার জার্নালে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে প্রথমবারের মত জলবায়ু সংকট এবং আধুনিক কৃষিকাজের মধ্যে স্পষ্ট ও উদ্বেগজনক এক যোগসূত্র প্রকাশ পেয়েছে।
ওই গবেষণার বরাতে সিএনএস জানিয়েছে, যেসব জায়গায় এই সংকট অনেক বেশি, সেখানে কীটপতঙ্গের পরিমাণ ৫০ শতাংশের মত কমে গেছে। আর কীটপতঙ্গের প্রজাতির সংখ্যা কমেছে ২৭ শতাংশ।
“পোকামাকড় ধ্বংস হয়ে গেলে বা কমে গেলে জনস্বাস্থ্য এবং আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।”
যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেভ গলসন সিএনএনকে বলেছেন, “আমাদের ফসলের তিন-চতুর্থাংশের উৎপাদন নির্ভর করে কীটপতঙ্গের ওপর। (কীটপতঙ্গ কমে গেলে) ফসল উৎপাদন কমা শুরু করবে। স্ট্রবেরির মত অনেক কিছুই তখন আর ফলবে না।”
তিনি বলেন, “পোকামাকড় যদি দুনিয়ায় না থাকে, তাহলে এই সাড়ে ৭০০ কোটি মানুষকে আমরা খাওয়াতেও পারব না।”
আউটহোয়েইট সিএনএনকে বলেন, তাদের গবেষণায় কিছু অঞ্চলের পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্ত মেলেনি। ফলে প্রতিবেদনে যা এসেছে, প্রকৃত পরিস্থিতি হয়ত তার চেয়ে অনেক বেশি খারাপ।
ইউনিভার্সিটি অফ রিডিংয়ের ফলিত বাস্তুবিদ্যার অধ্যাপক টম অলিভার এক বিবৃতিতে বলেন, কীটপতঙ্গের সংখ্যা কমে যদি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে, সেখান থেকে আর স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফেরা সম্ভব না, তাহলে ক্ষতি কতটা বড় হবে, তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে কি না, বিজ্ঞানীরা এখনও জানেন না।
“এখন যদি প্রশ্ন করা হয় যে কীটপতঙ্গের ঠিক কতটা ক্ষতি হলে সেটা পুরো বাস্তুতন্ত্র ধ্বসিয়ে দেবে, সত্যি কথা বলতে কি, আমরা সেটা এখনও জানি না।
“তবে আমরা এটা জানি যে, এটা কেবল কীটপতঙ্গের প্রজাতি ধ্বংসের মধ্যে থেমে থাকবে না। শেষ পর্যন্ত একটা বিপর্যয়কর পরিণতি ডেকে আনবে পারে,” বলেন টম অলিভার, যিনি এ গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না।
গবেষকরা বলছেন, কীটনাশক এবং রাসায়নিক সার ব্যবহার, ফসলের বৈচিত্র্য কমে যাওয়া, বিশাল মাঠজুড়ে ফসলের ক্ষেত, এক জায়গায় অনেক বেশি গবাদিপশু- এরকম যে বিষয়গুলো আধুনিক কৃষিকাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্য, সেগুলোই কীটপতঙ্গ ধ্বংসে বড় ভূমিকা রাখছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু সংকটের সঙ্গে ভূমির অতি ব্যবহার মিলে বিপদ দ্বিগুণ করে তুলছে। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে, যা স্থানীয় জলবায়ুকে নাটকীয়ভাবে বদলে দিতে পারে, তাপমাত্রাও অনেক বাড়িয়ে তুলতে পারে।
গবেষকরা বিশ্বের এমন অঞ্চলগুলোতে কীটপতঙ্গ কমে যাওয়ার প্রমাণ পেয়েছে, যে অঞ্চলগুলো অনেক বেশি উষ্ণ, বিশেষ করে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল। গবেষক আউটহোয়েইটের ভাষায়, কীটপতঙ্গের বৈচিত্র্যে সেসব এলাকায় যে মাত্রায় হ্রাসে পেয়েছে, সেটা উদ্বেগজনক।
এই গবেষকরা ৬ হাজার স্থানের ২০ বছরের বেশি সময়ের ডেটা বিশ্লেষণ করেছেন। প্রজাপতি, মথ, ড্রাগনফ্লাই, ফড়িং এবং মৌমাছিসহ কীটপতঙ্গের প্রায় ১৮ হাজার প্রজাতির ওপর পর্যবেক্ষণ চালিয়েছেন।
আধুনিক পদ্ধতিতে আগ্রাসী চাষাবাদ শুরু হয়নি, আশপাশে কীটপতঙ্গের প্রাকৃতিক আবাস্থল আছে এবং উষ্ণায়ন কম হয়েছে, এরকম এলাকায় কীটপতঙ্গ কমেছে মাত্র ৭ শতাংশ। আর যেখানে ব্যাপক মাত্রায় আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু হয়েছে, উষ্ণায়ন বেশি হচ্ছে এবং পোকামাকড়ের প্রাকৃতিক আবাস্থল কমে গেছে, সেসব এলাকায় কীটপতঙ্গ কমেছে ৬৩ শতাংশ।
অনেক পোকামাকড় গরমের দিনে ছায়ার জন্য গাছের উপর নির্ভর করে। প্রাকৃতিক আবাসস্থলের ক্ষতি এগুলোকে আরও অরক্ষিত করে তোলে।
আউটহোয়েইট সিএনএনকে বলেন, “এই সংকট থেকে বাঁচতে আরও দেশীয় প্রজাতির এবং উনো ফুলগাছ রোপণ করে, বাগানে কীটনাশক ব্যবহার কমিয়ে দিযে, এমনকি ঘনঘন ঘাস না কেটে আমরা ব্যক্তিগত পর্যায় থেকেও ভূমিকা রাখতে পারি।
আউটহোয়েইট বলেন, বাণিজ্য ও খাদ্য উৎপাদনের কী প্রভাব পরিবেশে পড়ছে, তা নির্ধারণে সরকারগুলোর একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। যেসব এলাকায় বন উজাড় করা হচ্ছে, সেখান থেকে খাদ্য আহরণের চেষ্টা থামাতে হবে।
জাতিসংঘের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, কীভাবে বিশ্বের বাস্তুতন্ত্রগুলো মানুষের জীবন যাপনের সঙ্গে খুব বেশি যুক্ত। যদি তাপ না কমে তাহলে এই গ্রহের জীববৈচিত্র্য, বিশেষ করে পোকামাকড়ের বড় ক্ষতি দেখতে থাকবে।
অলিভার বলেন, কীটপতঙ্গ কমে গেলে বাস্তুতন্ত্রের কার্যকারিতা ঠিকঠাক চালু থাকবে কি না, কিংবা শেষ পর্যন্ত তারা নিজেরাই হারিয়ে যাবে কিনা, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও জানা নেই।
“সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে এখনই আমাদের কাজ করা ভালো, যাতে আমাদের বাস্তুতন্ত্রের পতন দেখতে না হয়।”