চীনে নজিরবিহীন বাধা-বিপত্তি ও হুমকি-ধামকির সম্মুখীন হচ্ছে বিদেশি সাংবাদিকরা। সাংবাদিক এবং তাদের উৎসগুলোকে ভয়-ভীতি প্রদর্শনের নতুন নতুন উপায় বের করছে চীন সরকার।
Published : 31 Jan 2022, 07:59 PM
‘ফরেইন করেসপন্ডেন্টস ক্লাব অব চায়না’ (এফসিসিসি)- এর বার্ষিক জরিপ প্রতিবেদনে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে বলে জানিয়েছে সিএনএন।
সোমবার প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে বিদেশি সংবাদদাতারা নজিরবিহীন বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হচ্ছে।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যেসব পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে তার মধ্যে আছে, অনলাইন ট্রলিং, শারীরিক নির্যাতন, সাইবার হ্যাকিং, ভিসা দিতে অস্বীকৃতি এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করা কিংবা আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দেওয়া।
সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হয়েছেন এমন অনেক সূত্রও এমন প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন। জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় সব বিদেশি সাংবাদিকই বলেছেন, চীনে তাদের কাজের পরিবেশ মোটেও আন্তর্জাতিক মানের নয়।
জরিপটি ২০২১ সালের ডিসেম্বরে পরিচালনা করা হয়েছে। এতে বিশ্বের সংবাদ সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী ১৯২ সংবাদদাতা সদস্যদের মধ্যে ১২৭ জনের উত্তর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
বেইজিংয়ে শীতকালীন অলিম্পিকস শুরুর কয়েকদিন আগে এই জরিপ চালানো হয়। সে সময় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকায় বিশ্বব্যাপী সংবাদ সংগঠনগুলোতে অলিম্পিকসের সংবাদ প্রচার চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছিল।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর শাসনামলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর দমনপীড়ন অনেক বেড়ে গেছে। বিদেশি গণমাধ্যম ও তাদের কর্মীদেরকে হয়রানি করার ঘটনাও বেড়েছে।
‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকা জানায়, চীনা গ্লোবাল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক এর অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক চেং লেই এবং ব্লুমবার্গের চীনা সাংবাদিক হেজ ফান গত এক বছরের বেশি সময় ধরে জেলে রয়েছেন।
অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করায় আইনি ব্যবস্থার হুমকি এবং হয়রানির মুখে পড়ে বিবিসি-র সংবাদদাতা জন সুদওর্থ এবং তার স্ত্রী আরটির প্রতিনিধি ভোনি মুরে সন্তান-সন্ততিসহ চীন ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
সুদওয়ার্থ বলেন, “আমরা যখন চীন থেকে তড়িঘড়ি বেরিয়ে আসছিলাম তখন বিমানবন্দর পর্যন্ত সাদা পোশাকের পুলিশ আমাদের পিছু নিয়েছিল । সেখানে কী ধরনের বিপদের মধ্যে আমরা আছি, তা এ থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। স্বাধীন সাংবাদিকতা মোটেও সহ্য করে না চীন।”
‘ফরেইন করেসপন্ডেন্টস ক্লাব অব চায়না’ (এফসিসিসি) বলেছে, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সূত্র কমপক্ষে আটজন বিদেশি সংবাদদাতার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা বা মামলা করার হুমকি দিয়েছে। এভাবে এই সাংবাদিকদেরকে ব্যক্তিগতভাবে বড় ধরনের ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে।
এফসিসিসি দেখতে পেয়েছে, জরিপে অংশ নেওয়া ৬২ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তারা কমপক্ষে একবার পুলিশ বা অন্য কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রতিবেদন তৈরিতে বাধা পেয়েছেন। অন্যদিকে, ৪৭ শতাংশ অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের কাছ থেকে বাধা পাওয়ার কথা বলেছেন। আর ১২ শতাংশ বলেছেন, তাদেরকে প্রতিবেদন তৈরি করা থেকে বিরত রাখতে অপমান এবং শারিরীকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে।
জরিপে অংশ নেওয়াদের চার ভাগের এক ভাগ বলেছেন, অনলাইনে অপপ্রচারের বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন করার কারণে তাদেরকে টার্গেট করা হয়েছে। পূর্ব এশিয়ান বংশোদ্ভূত নারী সাংবাদিকদের বৈষম্যমূলকভাবে ট্রলিংয়ের শিকারে পরিণত হতে হয়েছে।
জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশি সাংবাদিকদের ওপর হামলা বা আক্রমণে সরাসরি উৎসাহ বা উস্কানিও দেওয়া হয় রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র সমর্থিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা থেকে। আবার সরকারি কর্মকর্তারা এবং রাষ্ট্রদূতরা নিয়মিতই পশ্চিমা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে গালাগালি দিয়ে লিখে থাকেন।
তবে এতসবকিছুর পরও বিদেশি সাংবাদিকদের কাজ অবশ্য থামিয়ে বা ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। চীনে প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে অনেক সংবাদভিত্তিক আউটলেটকেই চীনের বাইরে থেকে রিপোর্ট করার পন্থা বের করতে হয়েছে।
২০২০ এবং ২০২১ সালে কয়েক ডজন সাংবাদিককে চীন বহিষ্কার করেছে। তারা এখনও চীনে নিষিদ্ধ রয়েছে। আর এর প্রেক্ষাপটেই নেওয়া হয়েছে ওই বিকল্প রিপোর্টিং ব্যবস্থা। সাংবাদিক নিষিদ্ধের পদক্ষেপকে চীনে আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতার ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত বলেই বর্ণনা করেছেন নিউ ইয়র্ক টাইমসের চীনা ব্যুরো থেকে বহিষ্কৃত প্রধান স্টিভেন লি মায়ার্স। বর্তমানে তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে আছেন।