নিউ ইয়র্ক সিটির ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে ছিনতাই হওয়ার দুটি বিমানের হামলার মধ্য দিয়ে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সিন্ডি মিকগিনটির জীবনে শুরু হয় শোকের অধ্যায়। সেই হামলায় মারা যান তার স্বামী মাইক মিকগিনটি।
Published : 10 Sep 2021, 12:00 AM
আমেরিকান এয়ারলাইন্স ফ্লাইট ১১ যখন নর্থ টাওয়ারের ৯৩ থেকে ৯৯ তলা পর্যন্ত গুঁড়িয়ে দিচ্ছিল, মাইক তখন ভবনটির ৯৯তম তলায় ছিলেন।
ওই হামলার ঘটনায় স্বজন হারানো কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তাদের বদলে যাওয়া জীবনের গল্প তুলে ধরা হয়েছে রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে।
কানেটিকাটের ব্লুমফিল্ডে নিজের বাড়িতে সিন্ডি মিকগিন্টি বলেন, “লোকজন প্রায়ই আমাকে বলে, ‘২০ বছরতো হয়ে গেল।’ কিন্তু শোক তোমাকে ছাড়ছে না, এটা তুমি ছাড়তে পারবে না।’”
সিন্ডির বয়স এখন ৬৪ বছর, দুই ছেলে ডেভিড আর ড্যানিয়েলকে লালন-পালনের জন্য মন কতটা শক্ত করে তাকে লড়তে হয়েছে, সে কথাই তিনি স্মরণ করছিলেন। সে সময় ছেলেদের একজনের বয়স ছিল ৭ বছর, অন্য জনের ৮।
মিকগিন্টি বলেন, “ওরা এখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠেছে, কিন্তু ওদের বড় করে তুলতে আমাকে অনেক কিছুই করতে হয়েছে।”
ড্যানিয়েলের বয়স এখন ২৮ বছর, কিছুদিন হলে তিনি বিয়েও করেছে। মায়ের দুঃখ, ছেলের বিয়ের দিনটাও দেখতে পারেননি মাইক।
ভারাক্রান্ত মনে মিকগিন্টি বলছিলেন, “বাবা আর স্বামী হিসেবে দারুণ ছিল মাইক। বিয়ের সময় বাবার কাছ থেকে আশীর্বাদ পাওয়ার কথা ছিল ড্যানিয়েলের। কিন্তু সেটা হল না।”
সিন্ডি মিকগিন্টি এখন ‘৯/১১ ডে’ নামে একটি আলাভজনক প্রতিষ্ঠানের একজন পরিচালক।
“আমরা চাই ওই দিনে যারা প্রাণ হারিয়েছেন এবং দেশের জন্য যারা কাজ করেছেন, তাদের প্রত্যেকের স্মরণে মানুষ ভালো কোনো কাজ করবে। ওই হামলার পর যে ঐক্য তৈরি হয়েছিল, আবারও সেই অবস্থান তৈরির এটা একটা উপায়।”
‘ন্যায় বিচারের অভাব’
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে ক্রিস্টেন ব্রেইটউইজারের দীর্ঘ ২০ বছরের লড়াই শুরু হয় যখন তার স্বামী রোনাল্ড ব্রেইটউইজার ৯৩ বছর বয়সে নিহত হন।
“আমার স্বামী রন ছিলেন টুইন টাওয়ারের দ্বিতীয় ভবনের ৯৪তম তলায়, সে আমাকে ফোন করে জানায়, পাশের ভবনটিতে একটি বিস্ফোরণ হয়েছে। তার গালে গরম লাগছে এবং লোকজনকে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়তে দেখছে।
“আমরা দুজন দুজনকে বলেছিলাম- ‘ভালবাসি’, এরপর ফোনটা বন্ধ হয়ে গেল। ভবনের যেখানে সে বসেছিল, সম্ভবত ৩ মিনিট পর সে অংশে বিস্ফোরণ ঘটে।”
সেই ঘটনায় আইনজীবী ক্রিস্টেন ব্রেইটউইজার বিধবা হয়ে গেলেন। এরপর হয়ে উঠলেন একজন অধিকার কর্মী ও লেখক।
“নাইন ইলেভেনের তথ্যগুলোর দিকে তাকান, দেখবেন ৩ হাজার মানুষের প্রাণ হারানোর ঘটনায় বিচার হয়নি, এটা খুবই দুঃজনক। এ ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার, দায়িত্ব এবং দায় নেওয়ার ব্যাপারে সদিচ্ছার বড় ঘাটতি আছে।
“আমি আশা নিয়ে সামনে এগোতে চাই, হয়তো একদিন নাইন ইলেভেন হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত আমাদের মতো পরিবারগুলো তাদের পাওনা বুঝে পাবে, সেটাই হবে শান্তি আর সমাপ্তির।”
ওই হামলার পরিণতিতে বিধবা হওয়া নিউ জার্সির চার নারী পরে সংবাদমাধ্যমে ‘জার্সি গার্লস’ হিসেবে পরিচিতি পান। ক্রিস্টেন ব্রেইটউইজার তাদেরই একজন। নাইন ইলেভেনের তদন্ত প্রকাশ্যে আনতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে চাপ দিয়ে যাচ্ছে ‘জার্সি গার্লস’।
‘ওয়েক আপ কল: দ্য পলিটিক্যাল এডুকেশন অব নাইন ইলেভেন উইডো’ নামে নিজের লেখা একটি বইতেও সেই হতাশার কথাও তুলে ধরেছেন ব্রেইটউইজার।
রয়টার্সকে তিনি বলেছেন, অন্যান্য বছরের মতই নাইন-ইলেভেন হামলার বিংশতম বার্ষিকীতে নিজের মেয়ের সঙ্গে প্রকৃতির মধ্যে সময় কাটাবেন তিনি।
“সেখানেই আমি আমার স্বামীর সান্নিধ্য অনুভব করি এবং এটাই সেই স্থান যেখানে আমরা কিছুটা হলেও শান্তি পাই।”
যেভাবে গড়ে ওঠে ‘টল অর্ডার’
নাইন ইলেভেন হামলার পর ফায়ার সার্ভিস, হাসপাতাল এবং জরুরি সহায়তা কর্মীদের মোজা সরবরাহের কাজে নেমে পড়েছিলেন যমজ দুই ভাই মাইক এবং ড্যান ফ্রিডম্যান।
ওই দিনের হামলায় তারা নর্থ টাওয়ারের ৯২তম তলায় ৪৪ বছর বয়সী বাবা অ্যান্ড্রু ফ্রিডম্যানকে হারিয়েছিলেন।
ড্যান বলেন, “বাবাই ছিলেন আমাদের সব, বন্ধু কিংবা কোচ হিসেবে তিনি ছিলেন একজন পথিকৃৎ। তাকে আমরা আর কখনও দেখতে পাব না- এটা ভাবাও আমাদের জন্য কঠিন ছিল।”
ক্যান্সারের পরীক্ষা এবং কেমোথেরাপির সময় তার স্বামী কতোটা সহায়তা করেছেন সে কথা স্মরণ করছিলেন অ্যান্ড্রুর স্ত্রী লিজা ফ্রিডম্যান ক্লার্ক।
“দুনিয়ায় একটি বিষয় নিয়েই তার দুশ্চিন্তা ছিল, সেটা হচ্ছি আমি। সে এমনই ছিল।”
ছেলে ড্যান জানালেন, মোজা তৈরির পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ‘টল অর্ডার’ এর ভাবনাটা আসে নাইন ইলেভেন হামলার ঠিক পরের শুক্রবার।
“বিভিন্ন জায়গা থেকে তারা আসছিল… গ্রাউন্ড জিরোর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে তারা উদ্ধার কাজে সহায়তা করছিল। সেখানে তাদের পা নোংরা হয়ে উঠছিল, ঘামছিল আর দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল।
“তারা পরিষ্কার আর শুকনো মোজা খুঁজছিল… উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য সহায়তা চাইছিল। আমরা তাই করলাম, সেই থেকে মোজাই আমাদের পরিবারের আশার আলো হয়ে উঠল।”
প্রতি বছর বাবাকে যেভাবে স্মরণ করেন, বিংশতম বার্ষিকীতেও মাইক এবং ড্যান সেটাই করবেন বলে জানালেন।
“আমরা প্রতিবারই ব্রুকলিনে বাবার পছন্দের পিটার লুগার রেস্তোরাঁয় যাই। সেখানে তার ছোট বেলার বন্ধুদের সঙ্গে একত্রিত হই। গল্প করি, খাবার খাই… খুব ভালো একটা সময় কাটাই। যতদূর সম্ভব ইতিবাচক থাকার চেষ্টা করি।”