যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পেন্টাগনের দোতলায় একটি মানচিত্রে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মার্কিন এয়ারলাইন্সের ছিনতাই হওয়া বিমানটি কোন পথে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর এই সদরদপ্তরে আঘাত হেনেছিল তা চিহ্নিত করা আছে; এটিই সেই হামলা, যা মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীকে আফগানিস্তানে আক্রমণ চালাতে তাড়িত করেছিল।
Published : 24 Aug 2021, 05:04 PM
ওই মানচিত্র থেকে কয়েক করিডোর দূরেই ঝুলছে ২০০৯ সালের টাইম ম্যাগাজিনের কভারের একটি পোস্টার, যেখানে লেখা আছে, ‘আফগানিস্তানে যেভাবে হারবেন না’; আর আছে আফগানিস্তানের কোনো এক জায়গায় ধুমপানরত এক মার্কিন সেনার ছবি।
ওয়াশিংটন ডিসির কাছে ২০ হাজারেরও বেশি সেনা ও বেসামরিক প্রতিরক্ষা কর্মীর এ কার্যালয়টিতে আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর ২০ বছরের কর্মকাণ্ড, যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম যুদ্ধের অসংখ্য টুকরো টুকরো স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
সেই আফগানিস্তান থেকে এখন যুক্তরাষ্ট্র সৈন্য সরিয়ে নিচ্ছে। তালেবান কাবুল দখলের পর দেশটিতে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, কূটনীতিক ও সহযোগীদের সরিয়ে আনতে জো বাইডেনের প্রশাসনকে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে।
বছরের পর বছর যুক্তরাষ্ট্র যে আফগান সেনাদের অস্ত্র-অর্থ, প্রশিক্ষণ দিয়েছে, তালেবানের ঝড়ের বেগে আফগানিস্তান দখলের পাল্টায় সেসব সেনাদের প্রতিরোধ তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়া, কাবুল থেকে বেসামরিকদের সরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তালগোল পাকানো এবং যে আফগানরা দুই দশকের যুদ্ধে মার্কিনিদের সহায়তা করেছিল তাদেরকে তালেবানের প্রতিহিংসার মুখে ছেড়ে আসার ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
“আমরা একাধিক ভিডিও ও ছবি দেখছি, ঘটনা সম্বন্ধে পড়ছি যা আমাদের অনেককে অনেক কিছু মনে করিয়ে দিচ্ছে এবং এটি তীব্রভাবে ব্যক্তিগত হয়ে উঠছে,” মেরিন সেনাদের লেখা এক মেমোতে এমনটাই লিখেছেন মেরিন কর্পসের কমান্ডান্ট জেনারেল ডেভিড বার্গার।
সেনাদের যেখানে মোতায়েন করা হয়, বিশেষ করে যুদ্ধের সময়, ওই স্থানের সঙ্গে তাদের একধরনের বন্ধন তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক।
প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ডনাল্ড ট্রাম্প যখন ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনেকটা হুট করেই মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটকে (আইএস) পরাজিত করা দুই হাজার মার্কিন সেনাকে সিরিয়া থেকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখনও অনেক সেনাসদস্যের মধ্যে গভীর হতাশা দেখা গিয়েছিল।
একদিকে কুর্দি মিত্রদের ছেড়ে আসা অন্যদিকে রাশিয়া ও ইরানকে সিরিয়ায় লাগামছাড়া প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দেওয়ার ওই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন অনেক কর্মকর্তা ও আইনপ্রণেতা।
আফগানিস্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের আবেগের মাত্রা তো আরও বেশি। দুই দশক আগে এই যুদ্ধ যখন প্রথম শুরু হয়েছিল তখন লক্ষ্য ছিল তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত এবং নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে হামলার পরিকল্পনাকারী আল কায়েদার জঙ্গিদের দমন করা।
এরপর নতুন উদ্দেশ্য দাঁড়ায় নতুন আফগান রাষ্ট্র গঠন; এত বছরে সেখানে আট লাখের মতো মার্কিন সেনা মোতায়েন হয়েছে, এর মধ্যে প্রায় দুই হাজার ৪০০ জনের প্রাণ গেছে, আহত হয়েছে ২০ হাজারের বেশি।
সমালোচকদের কাছে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীও আফগান সমস্যারই অংশ।
জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তারা প্রায়ই অতি-আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হাজির করতেন, যদিও যুক্তরাষ্ট্রের অভিযান ও বিমান হামলায় অনেক নারী ও শিশুরও মৃত্যু হয়েছে।
পেন্টাগনের কর্মকর্তারা বলছেন, আফগান বাহিনীর পলকা প্রতিরোধ টপকে তালেবান দ্রুতই দেশটি দখল করে নেবে, সপ্তাহ দুয়েক আগে গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোতে দেওয়া এই ধারণা তাদের স্তম্ভিত করে দিয়েছিল।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যখন এক ভাষণে ঝুঁকিতে থাকা অনেক আফগান দেশ ছাড়তে চায়নি বলে মন্তব্য করেছিলেন, তখন অনেকে তার সহানুভূতির ঘাটতিতে ক্রুদ্ধও হন।
গত কয়েকদিন ধরে কর্মকর্তাদের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন নাগরিক ও ঝুঁকিতে থাকা আফগানদের সরিয়ে নেওয়ার শ্লথগতিও তীব্র হতাশার জন্ম দিয়েছে।
মার্কিন সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, গত সপ্তাহ থেকে তারা চোখের পানি আটকে রাখতে পারছেন না।
কারও কারও ক্ষেত্রে এটা ঘটছে যেসব ঘাঁটিতে তারা ছিলেন, সেসব ঘাঁটি তালবানের দখলে যাওয়ার প্রতিবেদন পড়ে; কেউ আবার মুষড়ে পড়ছেন আফগানদের কাছ থেকে আসা বার্তা পেয়ে, যেগুলোতে তালেবানের হাতে পড়লে তাদের মেরে ফেলা হতে পারে জানিয়ে সাহায্যের জন্য আকুতি জানানো হয়েছে।
আফগানিস্তানে থাকা সেনাদসদস্যদের এই ‘কষ্ট, ক্রোধ’ প্রশমনে মাঠে নামতে হচ্ছে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের।
“আমি স্পষ্ট বলতে চাই, আপনাদের কর্মকাণ্ড বিফলে যায়নি, সেগুলো পার্থক্য তৈরি করেছে,” গত সপ্তাহে লেখা এক মেমোতে এমনটাই বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মাইক গিলডে।
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ও জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ জেনারেল মাইক মিলির সহযোগীরাও বিভিন্ন প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারে সেনাসদস্যদের বিভিন্ন ধরনের আবেগের উদাহরণ টেনেছেন।
লয়েড ও মিলি দুজনেই একসময় আফগানিস্তানে দায়িত্বপালন করেছেন।
আফগানিস্তান নিয়ে কষ্ট ও ক্ষোভের পরিসমাপ্তিও একসময় হবে, বলেছেন সামরিক বাহিনীর এক কর্মকর্তা।
“এটা একসময় শেষ হবে। নিশ্চয়ই এভাবে শেষ হবে না,” বলেছেন তিনি।