আফগানিস্তানজুড়ে আতঙ্ক, অবিশ্বাস, সবার নজর কাবুলে

মুহূর্মুহু হামলায় বড় কয়েকটি শহর দখলে নিয়ে আফগানিস্তানের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আরও সংহত করেছে তালেবান বাহিনী, চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক আর অবিশ্বাস, পালাচ্ছে হাজারো মানুষ।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 August 2021, 07:49 PM
Updated : 13 August 2021, 07:51 PM

বিবিসি জানিয়েছে, তালেবান যোদ্ধাদের হামলার মুখে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে রাজধানী কাবুলে জড়ো হচ্ছে বহু মানুষ। অনেকেই অস্থায়ী তাঁবু টানিয়ে অথবা রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে বাধ্য হচ্ছে।

কিন্তু আফগানিস্তানের পরিস্থিতি এত দ্রুত বদলাচ্ছে যে দুয়েক দিনের মধ্যে রাজধানী কাবুলও আক্রান্ত হতে পারে বলে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

আফগান চলচ্চিত্র নির্মাতা সাহরা কারিমি কাবুল থেকে বিবিসিকে বলেছেন, তার মনে হচ্ছে, পুরো বিশ্ব এখন আফগানিস্তানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তার ভয় হচ্ছে, আবারও হয়ত সেই তালেবানি ‘অন্ধকার যুগ’ শুরু হচ্ছে তার দেশে। 

১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত তালেবানি শাসনামলে আফগানিস্তানে নারীদের মুখ, চুলসহ সম্পূর্ণ দেহ ঢাকা বোরখা পরা বাধ্যতামূলক ছিল। মেয়েদের বয়স ১০ বছরের বেশি হলেই স্কুলে যাওয়া ছিল নিষিদ্ধ। শরিয়া আইনের নামে তারা চালু করেছিল দোররা ও পাথর ছুড়ে হত্যার মত ভয়ঙ্কর সব শাস্তি। 

সাহরা কারিমি বলেন, “আমি বিপদে পড়ে গেছি। কিন্তু এখন আর আমি নিজেকে নিয়ে ভাবছি না। আমার দেশটাই এখন বিপদে। এ দেশের পুরো নতুন প্রজন্ম এখন বিপদে। বহু কষ্ট করে আমরা পরিবর্তন এনেছিলাম। আমি ভাবছি আমার দেশের মেয়েগুলোর কথা… ফুটফুটে, সুন্দর, মেধাবী এই মেয়েরা…”

প্রাণ বাঁচাতে অনেকেই আফগানিস্তান ছেড়ে পাশের দেশে পালানোর চেষ্টা করছেন। বেসামরিক আফগানদের আশ্রয় দিতে প্রতিবেশী দেশগুলোর সীমান্ত খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ।

এর মধ্যে খাদ্য সঙ্কট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি হুঁশিয়ার করে বলেছে, পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে একটি মানবিক সঙ্কট আসন্ন।  

যুক্তরাষ্ট্রের একজন জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তালেবান বাহিনী হয়ত দুয়েকদিনের মধ্যেই কাবুলে ঢোকার চেষ্টা করতে পারে। ওয়াশিংটন অবশ্য আশা করছে, তালেবান বাহিনী কাবুলে হামলা করলে আফগানিস্তানের সরকারি বাহিনী শক্ত প্রতিরোধ গড়তে পারবে।

আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলের বেশিরভাগ এলাকা এবং প্রাদেশিক শহরগুলোর এক তৃতীয়াংশ আগেই তালেবানের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল। শুক্রবার দক্ষিণে দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কান্দাহার এবং পশ্চিমে তৃতীয় বৃহত্তম শহর হেরাতেরও পতন ঘটেছে।

তার আগে বৃহস্পতিবার কাবুল থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে গজনী শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয় তালেবান। কৌশলগতভাবে এই বিজয় তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা কাবুল ও কান্দাহারের মাঝামাঝি এই এলাকা থেকে সড়ক পথে দক্ষিণাঞ্চলে তালেবানদের শক্ত ঘাঁটিতে যোগাযোগ সহজ হয়ে যাবে।

আর ছয় লাখ বাসিন্দার শহর কান্দাহার এক সময় তালেবানের শক্ত ঘাঁটি ছিল। বিমানবন্দর, কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে অগ্রসর এ এলাকার নিয়ন্ত্রণও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

কান্দাহারের কাছাকাছি লস্কর গা শহর এবং কাবুল সীমান্তের কাছাকাছি লোগার প্রদেশেরও নিয়ন্ত্রণও তালেবান পেয়ে গেছে। এর মানে হল আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছে গেছে তারা।

লোগারের রাজধানী পুল-এ-আলম এর পুলিশ সদর দপ্তরসহ জেলখানারও নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তারা। এছাড়া কাল-ই-নাও শহরেরও দখল নিয়েছে তালেবান।

তালেবান এলিট ফোর্স। ছবি: রয়টার্স

টানা দুই দশকের সামরিক অভিযান শেষে যুক্তরাষ্ট্র ও বহুজাতিক বাহিনী যখন আফগানিস্তান ছাড়ছে, তখনই তালেবান যোদ্ধারা একের পর এক এলাকার দখল নিতে শুরু করে। কিন্তু গত মে মাসে শুরু হওয়া এ সংঘাতে তালেবান বাহিনী এত দ্রুত সাফল্য পাবে, তা ছিল ধারণার বাইরে। 

যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের মূল্যায়ন বলছে, ২০০১ সালের পর তালেবানের সামরিক শক্তি সর্বোচ্চ অবস্থায় রয়েছে। এ অবস্থায় কাবুল থেকে দূতাবাস খালি করার তোড়জোড় শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।

পেন্টাগন জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপদে আফগানিস্তান ছেড়ে আসার কাজে সহায়তা করতে তারা ইতোমধ্যে ৩ হাজার সেনা পাঠিয়েছে।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও এ বিষয়ে জরুরি বৈঠকে ডেকেছেন। যুক্তরাজ্য ইতোমধ্যে জানিয়েছে, ব্রিটিশ নাগরিকসহ অন্যদের আফগানিস্তান থেকে নিরাপদে বেরিয়ে আসতে ৬০০ সেনা মোতায়েন করা হবে।

এদিকে সীমান্তে ঢুকতে চাওয়া কয়েকশ আফগান নাগরিকের সঙ্গে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষ হয়েছে। চামান-স্পিন বোল্ডাক সীমান্তে ৫৬ বছর বয়সী এক ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেখানে সংঘাতের শুরু হয় বলে জানিয়েছে বিবিসি।

ইরান সীমান্তের লাগোয়া ছয় লাখ মানুষের শহর হেরাত থেকে প্রাদেশিক কাউন্সিলের সদস্য গোলাম হাবিব হাশিমি রয়টার্সকে বলেন, “এটাকে এখন যুদ্ধক্ষেত্রের ভুতুড়ে শহর মনে হচ্ছে। পরিবারগুলো এলাকা ছেড়ে যাচ্ছে নয়তো নিজের বাড়িতে লুকিয়ে থাকছে।”

হেরাতে প্রতিরোধ লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়া মিলিশিয়া বাহিনীর স্থানীয় প্রবীণ কমান্ডার ঈসমাইল খানকেও বন্দি করেছে তালেবান। ‘হেরাতের সিংহ’ নামেই খ্যাতি পাওয়া ঈসমাইল খান সত্তরের দশকে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সম্প্রতি আফগান সরকারের অধীনে স্থানীয় মিলিশিয়াদের নিয়ে তিনি তালেবানবিরোধী যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।

 

তালেবানদের সহিংস হামলায় ইতোমধ্যে কয়েক লাখ বেসামরিক মানুষ নিজের এলাকা ছেড়ে গেছে. তাদের মধ্যে অন্তত ৭২ হাজার শিশুও রয়েছে। গত এক মাসে অন্তত এক হাজার মানুষের প্রাণ গেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।

কুন্দুজ থেকে পালিয়ে কাবুলে আসা ৩৫ বছর বয়সী আবদুল্লাহ বিবিসিকে বলেছেন, তালেবান বাহিনী তার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। খাবার জন্য রুটি কেনার, কিংবা বাচ্চার জন ওষুধ কেনার পয়সাও তার হাতে নেই।

“আমাদের ঘরবাড়ি, আর যা ছিল সব পুড়িয়ে দিয়েছে। বাধ্য হয়ে আমরা কাবুলে এসেছি। এখন শুধু আল্লাহর কাছে দয়া চাইছি।”

কান্দাহারের পতনের আগে আগে সেখানে মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে কাজ করা একটি এনজিওর কর্মকর্তা পাস্তানা দুররানি বিবিসিকে বলেন, তিনি এখন জীবন সংশয়ে আছেন, কারণ নারীদের শিক্ষার জন্য যে ভূমিকা তিনি নিয়েছিলেন, তা তালেবানদে পছন্দ হওয়ার কথা নয়।

যে মেয়েগুলো আমাদের এখানে লেখাপড়া করত, তারাও সব পালিয়েছে। আমি জানি না তারা কোথায গেছে, কিন্তু তাদের নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। ওরা যদি এখন তালেবান যোদ্ধাদের বিয়ে করতে বাধ্য হয়? ওদের সামনে এখন কী আছে?” 

কাবুলে বিবিসির সাংবাদিক ইয়োগাতে লিমায়ে লিখেছেন, মানুষ এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না, যে এক দিনের মধ্যে তালেবান বাহিনী এত এলাকা দখল করে ফেলেছে। প্রচুর মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে আশ্রয়ের আশায় কাবুলে এসেছে, তাদের সংখ্যা ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়ছে।

অনেকেই এখন আফগান সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ। তারা মনে করছে, সরকারি বাহিনী তাদের নিরাপত্তা না দিয়ে বিপদের মধ্যে ফেলে এসেছে। সৈন্য সরিয়ে নেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্যের ওপরও তারা ক্ষুব্ধ। 

কাবুলে যুক্তরাষ্ট্রের দূতবাস

আফগানিস্তানের প্রধান শহরগুলোর মধ্যে কাবুলসহ উত্তরাঞ্চলে মাজার-ই-শরীফ, পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তান সীমান্তের কাছে জালালাবাদ এখনও সরকারে নিয়ন্ত্রণে আছে।

কিন্তু গত দুদিনে তালেবান বাহিনীর অভাবনীয় সাফল্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস মনে করছেন, আফগানিস্তানে এখন দীর্ঘমেদয়াদী গৃহযুদ্ধ শুরু হতে পারে।

পরিস্থিতি পর্যালোচনায় নেটো দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতরা বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন। চলমান সংঘাতে মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। 

কাবুলে মার্কিন দূতাবাসের কর্মীদের সরাতে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতায় ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় সায়গন শহরের পতনেরই ছায়া দেখছেন শীর্ষ রিপাবলিকান সেনেটর মিচ ম্যাককনেল।

শুক্রবার তিনি বলেছেন, “নাগরিকদের ফিরিয়ে আনতে তড়িঘড়ি সেনা পাঠিয়ে কাবুলের পতনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে।”

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার নিয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সিদ্ধান্তের ফলে যুক্তরাষ্ট্র কাবুলে সায়গনের চেয়েও বিব্রতকর পরিণতির দিকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন তিনি।