ভয় আর দুর্দশায় নিপতিত এক আফগান শহর

এবছর বদলে গেছে আফগানিস্তানে যুদ্ধের দৃশ্যপট। শহরের খোলা রাস্তায় তরমুজের পসরা সাজিয়ে বসেছেন তরমুজ বিক্রেতা। সরকারি বাহিনীর এক সাজোয়াঁ যান সমর রেখায় দাঁড়িয়ে। এর ঠিক ৩০ ফুট দূরে তালেবান যোদ্ধারা মাটিতে শুয়ে অবস্থান নিয়ে আছে। রাস্তার এপার থেকে তাদের দেখা যাচ্ছে না।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 July 2021, 05:39 AM
Updated : 15 July 2021, 05:39 AM

দুই পক্ষে গোলাগুলি শুরুর পর, প্রাণ বাঁচাতে ছুটে পালালেন তরমুজ বিক্রেতা, রাস্তায় টেবিলে সাজানো তার তরমুজ পড়ে রইল। গোলাগুলি থামার পর আবার ফিরে এলেন তিনি, বিক্রি শুরু হলো, যদিও এই পরিস্থিতিতে ক্রেতার দেখা পাওয়াটা ভাগ্যের বিষয়।

বিক্রেতা আবদেল আলিম নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, “আমার কোনো উপায় নেই। আমাকে তরমুজ বিক্রি করতেই হবে।”

কথা বলার সময় তার একচোখ সবসময় কুন্দুজ শহরের একটি রাস্তার দিকে ছিলো, যে দিক থেকে তালেবানরা সম্ভাব্য আক্রমণ চালাতে পারে।

তিনি বলেন, “এলাকা ছেড়ে বেশিরভাগ লোকই পালিয়ে গেছে। এখানে সবসময় লড়াই চলছে।”

তলেবানরা চারদিক থেকে কুন্দুজের ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। আফগানিস্তানের উত্তরের এই প্রাদেশিক রাজধানীতে প্রায় পৌনে চার লাখ মানুষের বসবাস।

শুধু কুন্দুজ নয়, এমন আরও কয়েকটি প্রাদেশিক রাজধানীর পরিস্থিতিও একই। আফগানিস্তানের বর্তমান সরকারের সঙ্গে তালেবানের লড়াই একটি নতুন ও বিপদজনক পর্যায়ে মোড় নিয়েছে।

গত বেশ কিছু সপ্তাহ ধরে, তালেবান বাহিনী দেশের উত্তরের বেশকিছু জেলা দখলে নিয়েছে, অনেক সময় একটি গুলিও খরচ না করেই।

বুধবার তারা পাকিস্তানের সঙ্গে একটি সীমান্ত ক্রসিংয়ের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। স্পিন বলদাক নামের ওই ক্রসিংটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার মধ্য দিয়ে এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে চারটি সীমান্ত ক্রসিং দখলে নিলো তালেবানরা।

এর সবই হচ্ছে একটি সীমান্ত কৌশল যার মাধ্যমে তারা ধীরে ধীরে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে। তালেবানরা দেশের প্রান্তীয় অঞ্চলগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে, এবং ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে থাকা কেন্দ্রীয় সরকারকে দিনে দিনে আরও চেপে ধরছে।

জুনের শেষ দিকে, তালেবানরা কুন্দুজ শহরে প্রবেশ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো সেনাবাহিনী ও পুলিশের সক্ষমতা যাচাই করা - যারা এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক গত সপ্তাহে শহরটিতে গিয়েছিলেন সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখতে যে একটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের দখল পেতে কতোগুলো প্রাণ কেড়ে নিতে হয়।

দুই পক্ষের লড়াইয়ের মাঝখানে পড়ে যারা মারা গেছে, তাদের বেশিরভাগই সাধারণ নাগরিক। অনেক লোক মারা গেছে এবং আহত হয়েছে। কুন্দুজের আঞ্চলিক হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ নাইম মঙ্গল জানালেন, এমনও দিন গেছে যেদিন ৭০জনকে হাসপাতালে আনা হয়েছে।

সোমবার রাতে শহরের দুইজন তরুণ বাসিন্দা আলিমের তরমুজের টেবিলের পাশেই ক্রসফায়ারে নিহত হয়।

লড়াইয়ের গতিপ্রকৃতি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, শহরের যে অংশেই আপনি থাকুন না কেনো, এক বা দুই ব্লক দূরেই দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়ে যেতে পারে।

তলেবানরা শহরের ভেতরে এবং বাইরে অবস্থান নিয়ে আছে। রাস্তার ধারের বড় গাছ, বা নিচু মাটির দেয়ালের আড়াল থেকে যেকোন সময় হামলা শুরু করতে পারে তারা। পুলিশ ও সেনা সদস্যরা দিনে রাতে সবসময়ই সতর্ক এবং হামলা প্রতিহত করতে প্রস্তুত।

সন্ধ্যায় সূর্য ডোবার পরপর মাগরিবের আজান আর তালেবানের মর্টার হামলার আওয়াজ মিলেমিশে যায় প্রায়ই।

জুলাইয়ের এই মধ্যভাগে এসে তালেবানরা কুন্দুজের নয়টি পৌর অঞ্চলের চারটিতে প্রবেশ করেছে এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারি বাহিনীর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

বেশিরভাগ সময়ই গোলাগুলি শুরু হয় রাতে, দিনের ক্ষরতাপ কেটে যাওয়ার পর। দিনের বেলায় শহরের কেন্দ্রস্থলে ফেরিওয়ালা আর অস্থায়ী দোকান বসে, কিন্তু ক্রেতার সংখ্যা হাতেগোণা।

সেখানে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের জন্যই প্রাণের ঝুঁকি রয়েছে।

একজন কার্পেট বিক্রেতা মুস্তাফা তুর্কমেন বলেন, “এটা স্থায়ী লড়াই। এখানে কেউ আসতে পারে না, এবং কেউ এখান থেকে বেরুতেও পারে না। প্রতি রাতেই যখন আমি জেগে উঠি, আমি গোলাগুলির শব্দ শুনি।”

তারপরেও তিনি দোকানে আসেন।

সরকারি বিশেষ বাহিনী অতিকষ্টে এখনও তালেবানদের ঠেকিয়ে রেখেছে। নিয়মিত সেনাদের চেয়ে তারা উন্নত প্রশিক্ষণ পাওয়া এবং বেশি লড়াকু। এই কমান্ডোরা শহরের পরিত্যাক্ত একটি কারখানায় নিজেদের ঘাঁটি বানিয়েছে, যেটা এক সময় এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উৎকর্ষের প্রতীক ছিলো।

কমান্ডোদের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাসন্দ নিজরাবি নিয়মিত সেনা বাহিনী নিয়ে হতাশা প্রকাশ করলেন, যারা এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। আর এর ফলে তালেবানের অভিযাত্রার মুখে তার যোদ্ধাদের প্রতিদিনই একটু একটু করে পিছিয়ে আসতে হচ্ছে।

পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে গত সপ্তাহে নিজ কার্যালয়ে প্রাদেশিক গভর্নর নাজিবুল্লাহ ওমারখিলের চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে এসেছিলো। তিনি বলেন, “প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছি। কোন সন্দেহ নেই যে প্রত্যেকের জীবন হুমকির মুখে। আমার কাঁধে অনেক বড় দায়িত্ব। এবং পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।”

গভর্নরের কার্যালয়ের কাছেই একটি পরিত্যাক্ত পেট্রল পাম্পে দুটি সাজোয়াঁ যান অবস্থান নিয়ে আছে। অবস্থান নেওয়া সেনারা রাতভর লড়ায়ের জন্য সর্ব সতর্ক।

সার্জেন্ট আবদুল মালিক (৩১) বলেন, “আমরা রাতে ঘুমাই না। প্রতিদিনই লড়াই চলছে।” তিনি যখন কথা বলছিলেন, তার সহযোগী একটি টি-শার্ট পরেই যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এম৪ রাইফেল কাঁধে টহল দিয়ে চলেছে।

কুন্দুজের চারপাশের সবগুলো জেলাই এরইমধ্যে তালেবানের দখলে চলে গেছে। শহর থেকে বের হওয়ার রাস্তাটিও তাদের নিয়ন্ত্রণে। এখন পর্যন্ত স্থানীয় বিমানবন্দরটি সচল আছে, যদিও কোন বাণিজ্যিক বিমান ওঠানামা করে না সেখানে। রোবাবার রাতে সেখানে লড়াইয়ে একটি সরকারি হেলিকপ্টার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

জাতিসংঘের হিসাবে কুন্দুজের আশপাশ থেকে ৩৫ হাজারেরও বেশি বাসিন্দাকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে জোর করে উচ্ছেদ করা হয়েছে। উদ্বাস্তুদের অনেকেই তীব্র গরমে খোলা আকাশের নীচে অবস্থান করছে, ক্ষুধা পেটে, অসহায়।

অরক্ষিত গ্রামীণ জেলাগুলো সহজেই নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর তালেবানরা এখন আরও দৃঢ়তার সঙ্গে বড় শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার লড়াইয়ে নেমেছে।

কুন্দুজ শহরের অনেক বাসিন্দা পালিয়ে যাওয়ার কারণে বা তাদেরকে তাড়িয়ে দিয়ে খালি করা ঘরবাড়ির ভেতর থেকে তালেবানরা স্থানীয় পুলিশ স্টেশন লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে অথবা শহরের যেসব স্থানে কম সংখ্যক সেনার অবস্থান রয়েছে সেসব চৌকিতে হামলা করে।

দেশের অন্যান্য প্রাদেশিক রাজধানীও তালেবানদের ঘেরাওয়ের মুখে রয়েছে। গত সপ্তাহে তালেবানরা আফগানিস্তানে দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কান্দাহারের নিরাপত্তা পরিসীমা ভেদ করেছে। মঙ্গলবার শহরের চারটি অংশে লড়াই চলেছে। গোলাগুলিতে আহত অনেককে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, কয়েক হাজার বাসিন্দা শহর ছেড়ে পালিয়েছে।

পাশের হেলমান্দ প্রদেশে, রাজধানী লস্কর গা যে কোন মুহূর্তে তালেবানের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা। কমপক্ষে আরও তিনটি শহরে হামলা করা হয়েছে অথবা ঘিরে ফেলা হয়েছে।

এর আগেও তালেবানের হামলার মুখে পড়েছে কুন্দুজ। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য শহরটির নিয়ন্ত্রণও নিয়েছিলো তারা। দুই ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার সহায়তায় আফগান সেনা বাহিনী তালেবানদের হঠিয়ে শহর পুনর্দখল করেছিলো। ২০১৫ সালেই একবার ভুল করে যুক্তরাষ্ট্রের একটি হেলিকপ্টার গানশিপ ডক্টরস উইদাউট বর্ডারের একটি হাসপাতালে হামলা করে, সেখানে ৪২ জন নিহত হয়।

এবার আমেরিকানরা সাহায্য করবে না। তাই এইবারের কুন্দুজ নিয়ে আফগানিস্তানের দুই পক্ষের লড়াই খুবই হাড্ডাহাড্ডি হতে চলেছে।