চীনে গতবছর প্রায় এক কোটি ২০ লাখ শিশু জন্ম নিয়েছে। ১৯৬০ এর দশকের পর এই প্রথম দেশটিতে এক বছরে এত কম শিশু জন্মেছে। যা নিয়ে উদ্বেগের কারণে অনেকেই চীনের জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতি বন্ধ করে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
Published : 25 May 2021, 10:41 PM
তবে চীনে শিশু জন্মের এই নিম্নগতির কারণ কি শুধুই দেশটির সন্তান জন্মদান নীতি? না কি দেশটির তরুণ-তরুণীরা সন্তান জন্মদানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন? বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে এ প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজা হয়েছে।
বেইজিংয়ের বাসিন্দা ৩১ বছরের লিলি (ছদ্ম নাম)। দুই বছর আগে তার বিয়ে হয়েছে। এখন পর্যন্ত লিলির মা হওয়ার কোনও ইচ্ছা নেই। তার কথায়, “একটি শিশুকে বড় করে তোলা নিয়ে সবসময় দুশ্চিন্তায় ভোগার চেয়ে আমি বরং জীবনটাকে উপভোগ করতে চাই।”
“আমার চেনা, আমার সমবয়সীদের মধ্যে হাতগোনা কয়েকজনের সন্তান আছে। যাদের সন্তান আছে তারা সন্তানের জন্য একজন সেরা আয়া খুঁজে বের করতে বা সন্তানকে সেরা স্কুলে ভর্তি করাতে মরিয়া হয়ে থাকে। এটা আমার কাছে খুবই বিরক্তিকর।”
নাম প্রকাশ না করার শর্তে লিলি বিবিসি-র সঙ্গে কথা বলতে রাজি হন। তিনি বলেন, যদি তার মা তার ইচ্ছা কথা জানতে পারেন তবে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন। লিলির মতো চীনের নগরাঞ্চলে বাস করা অনেক নারীই এখন সন্তান জন্মদানের বিষয়ে একই ধরনের ইচ্ছা পোষণ করছেন।
চীনে প্রকাশিত সর্বশেষ আদমশুমারিও সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। এ মাসের শুরুতে চীনের সর্বশেষ আদমশুমারি প্রকাশ করা হয়। সেখানে দেখা যায়, গত বছর চীনের প্রায় এক কোটি ২০ লাখ শিশু জন্ম নিয়েছে। ২০১৬ সালের তুলনায় যা উল্লেখযোগ্য হারে কম। সেবার চীনে এক কোটি ৮০ লাখের মত শিশু জন্মগ্রহণ করেছিল।
আদমশুমারির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৬০ এর দশকের পর গত বছরই চীনে জন্মহার সবচেয়ে কম ছিল। যদিও দেশটির মোট জনসংখ্যা এখনও ঊর্ধ্বগামী। তবে গত কয়েক দশকের তুলনায় জনসংখ্যা বাড়ার গতি এখন সব থেকে কম। তাই অনেকেই আশঙ্কা করছে, যেমনটা পূর্বাভাস করা হয়েছিল তার তুলনায় দ্রুততর সময়ে চীনের মোট জনসংখ্যা হ্রাস পেতে শুরু করবে।
জন্মহার অতিরিক্ত হ্রাস পাওয়া একটি দেশের জনভারসাম্যের জন্য সংকটের। কারণ, জন্মহার হ্রাস পেলে দেশে তরুণদের তুলনায় বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে। অর্থনীতিতে যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কর্মশক্তির তুলনায় দেশে পেনশনভোগীর সংখ্যা বেড়ে যাবে। স্বাস্থ্য সেবা এবং সামাজিক পরিষেবার চাহিদাও বাড়বে।
চীনের ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের প্রধান নিং জিঝি বলেন, জন্মহার কম থাকায় চীনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। কোনও দেশ উন্নত হলে শিক্ষা ও পেশাগত জীবনে উন্নয়নের সুযোগ তৈরি হয়। ফলে জন্মহারও কমে যায়।
উদাহরণ হিসেবে চীনের প্রতিবেশী দেশ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার কথা বলা যায়। বেশি সন্তান নেওয়ার জন্য সরকার দম্পতিদের বিভিন্ন প্রণোদনা দেওয়ার পরও এ দুটি দেশে সাম্প্রতিক কয়েক বছরে জন্মহার রেকর্ড পরিমাণে কমেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের পরিস্থিতি একেবারেই অন্য একটি কারণে খারাপের দিকে যাচ্ছে। সেটি হচ্ছে, দেশটিতে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা অনেক কম। ফলে কোনও পুরুষ পরিবার শুরু করতে চাইলেও বিয়ে করার জন্য একজন পাত্রী খুঁজে বের করা তার জন্য বেশ কঠিন কাজ।
ফলে অনেক পুরুষ ইচ্ছা থাকার পরও বিয়ে করে পরিবার শুরু করতে পারছেন না। গতবছরও চীনে নারীর তুলনায় তিন কোটি ৪৯ লাখ পুরুষ বেশি ছিল।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে চীনে দীর্ঘদিন ধরে কঠোর ‘এক সন্তান নীতির’ ফল আজকের এই চরম লৈঙ্গিক ভারসাম্যহীনতা। ১৯৭৯ সাল থেকে চীনে কঠোর এক সন্তান নীতি চালু হয়।
অনেক দেশের মত চীনের সমাজ ব্যবস্থায়ও মেয়ে শিশুর তুলনায় ছেলে শিশু অধিক কাম্য। এক সন্তান নীতি চালুর পর বেশিরভাগ দম্পতি ছেলে সন্তান চাইতেন। ফলে দেশটিতে গর্ভপাত অনেক বেড়ে যায়। যে কারণে, ১৯৮০ দশকের দিকে চীনে ছেলে শিশু জন্মের হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেতে শুরু করে।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর এর সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মু ঝিং বলেন, লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে বিয়ের ক্ষেত্রে কনে পেতে সংকটে পড়েছেন চীনা পুরুষেরা।
২০১৬ সালে চীন সরকার ‘এক সন্তান নীতির’অবসান ঘটায়। দম্পতিদের দুই সন্তান নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। তবে নীতি বদলের পরও দেশটিতে জন্মহার কমছে। পরিস্থিতির খুব বেশি বদল ঘটেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, চীন সরকার সন্তান জন্মদান নীতি শিথিল করলেও দম্পতিদের সন্তান জন্মদানে উৎসাহিত করতে আর কোনও প্রণোদনার ব্যবস্থা করেনি। যেমন: শিশুদের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তা বা শিশুযত্ন পরিষেবা পাওয়ার সুযোগ।
চীনে জীবনযাত্রা ব্যয় অনেক বেড়ে যাওয়ায় শুধুমাত্র শিশুদের খরচ বহন করতে চান না বলে অনেক দম্পতি সন্তান জন্ম দিচ্ছেন না বলেও জানান বিশেষজ্ঞরা।
ড. মু বলেন, বড় বড় নগরীতে মানুষের জীবনে সাফল্য নিয়ে ভাবনায় বদল এসেছে। সন্তান লালনপালনের ব্যয়ভারের কারণে অনেকে সন্তান নিতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন না। বিয়ে ও সন্তান জন্মের চেয়ে জীবনযাত্রার মান উন্নত করাকে সাফল্য হিসেবে মনে করছেন অনেকে।
চীনে নারীদের সন্তান না নিতে চাওয়ার পেছনে আরও কারণ আছে। বেশির ভাগ দেশের মতো চীনেও সমাজব্যবস্থার কারণে সন্তান লালনপালনের ভার নারীদের ওপরই থাকে।
ড. মু বলেন, সন্তান লালনপালনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক নারীই পেশাগত জীবনে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, এমন আশঙ্কা করে থাকেন।
যদিও চীনে এখন ১৪ দিনের পিতৃত্বকালীন ছুটি চালু হয়েছে। কিন্তু পুরুষদের মধ্যে এই ছুটি গ্রহণের প্রবণতা এখনও কম। পুরুষরা কাজ না করে সন্তান লালন-পালন করছেন এমন চিত্রও সেখানে খুবই বিরল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যক্তি বিবিসি-কে বলেন, চীনে নারীদের জন্য এখনও ভাল কর্মসংস্থানের সুযোগ কম। তাই যেসব নারী ভাল চাকরি করেন, তারা যে কোনো মূল্যে সেটি চালিয়ে যেতে চান। পেশাগত জীবনে উন্নতি করতে চান।
ওই ব্যক্তির প্রশ্ন, ‘‘এ পরিস্থিতিতে কে সন্তান নেওয়ার মতো সাহস দেখাবে?’’
সাম্প্রতিক বছরে চীনের কিছু শহরে মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়ানো হয়েছে। ৯৮ দিনের বেশি ছুটির জন্য আবেদন করতে নারীদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আবার এ পরিস্থিতিকে কর্মক্ষেত্রে লৈঙ্গিক বৈষম্য বলেও মনে করছেন অনেকে।
গত মার্চে চংকুইং নামের এক নারী চাকরির আবেদন করেন। অন্তঃসত্ত্বা হলে চাকরি ছেড়ে দেবেন, এমন শর্ত মেনে নিতে তাকে বাধ্য করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান।
চীনে এখনও সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে যেসব বিধিনিষেধ আছে, অদূর ভবিষ্যতে সেগুলো তুলে নেওয়া হবে বলে মত বিশেষজ্ঞাদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা জানান, হয়ত আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যেই এমন ঘোষণা আসবে।
তবে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আর দেরি না করে চীনের এখনই সন্তান জন্মদান নীতিতে পরিবর্তন আনা উচিত।
চীনের সেন্ট্রাল ব্যাংকের একদল গবেষক বলেন, ‘‘সন্তান জন্মদানের বিষয়ে চীনা দম্পতিদের এখনই পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। এখনও হয়তো কেউ কেউ সন্তান জন্ম দিতে চাইছেন, কিন্তু সরকারি নীতির কারণে পারছেন না।”
“যখন আর কেউই সন্তান জন্ম দিতে চাইবেন না তখন দম্পতিদের এ বিষয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েও কোনও লাভ হবে না। তাই আমাদের এ নিয়ে দ্বিধায় ভোগা একদমই উচিত হবে না।”
চীনের সেন্ট্রাল ব্যাংকের ওয়েবসাইটে এই গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
তবে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বিষয়টিকে এত সহজভাবে দেখছেন না। তারা মনে করেন, এখনো চীনের শহর এবং গ্রামাঞ্চলে বসবাস করা দম্পতিদের মধ্যে সন্তান জন্মদানের বিষয়ে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। তাই অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলে মনে করেন তারা।
তারা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘‘বেইজিং বা সাংহাইয়ের মত বড় বড় নগরীতে জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেশি হওয়ায় নারীরা সন্তান জন্মদানে দেরি করছেন বা দিতে চাইছেন না। কিন্তু ছোট ছোট শহর বা গ্রামের নারীরা এখনও ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে পরিবার বড় করতে চাইছেন।
“ফলে যদি সন্তান জন্মদানের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া হয় তবে নগরীর তুলনায় ছোট ছোট শহর ও গ্রামে সন্তান জন্মদানের হার বেড়ে যাবে এবং তাতে অন্য ধরনের সংকট তৈরি হবে।”
জিয়ান জিয়াওটং ইউনিভার্সিটির জনসংখ্যাতাত্ত্বিক ড. জিয়াং কুয়ানবাও বলেন, সন্তান লালনপালন ও শিক্ষার জন্য পরিবারগুলো প্রণোদনা পেলে বরং পরিস্থিতি বদলাতে পারে। তিনি বলেন, ‘‘এখনও খুব বেশি দেরি হয়ে যায়নি।”
প্রণোদনা পেলে হয়ত লিলির মত নারীরাও সন্তান জন্মদানে উৎসাহিত হবেন।
লিলি বলেন, ‘‘যদি শিশুদের বড় করে তোলার কাজটি আরও সহজ করে দেওয়া হয় তবে হয়ত আমি সন্তান জন্ম দেওয়ার বিষয়ে মানসিকভাবে আরও বেশি প্রস্তুত হতে পারব এবং আমার উদ্বেগও কমবে। এটা শুনে আমার মাও অনেক বেশি খুশি হবেন।”