নভেল করোনাভাইরাসের মহামারীর মধ্যে স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের (পিপিই) ঘাটতির কথা জানিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে সতর্ক করার কয়েকদিন পর এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে নিজেই প্রাণ দিলেন এক বাংলাদেশি ডাক্তার।
Published : 11 Apr 2020, 12:18 PM
ইউরোলজির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ৫৩ বছর বয়সী আবদুল মাবুদ চৌধুরী ১৫ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর বুধবার ইস্ট লন্ডনের র্যামফোর্ডে কুইন্স হাসপাতালে অবস্থায় মারা যান বলে বিবিসি জানিয়েছে।
গত ২৩ মার্চ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পাঁচ দিন আগে কোভিড-১৯ প্রতিরোধ যুদ্ধে সামনের কাতারে থাকা ডাক্তার/নার্স/স্বাস্থ্য কর্মীদের ঝুঁকির কথা তুলে ধরে তাদের রক্ষার জন্য বরিস জনসনকে উদ্দেশ্য করে ফেইসবুকে পোস্ট দেন।
সেখানে তিনি লিখেন, “প্রিয় প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, দয়া করে ব্রিটেনে এনএইচএসের (জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা) সব স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষার জিনিসপত্র নিশ্চিত করুন। মনে রাখবেন, আমরা যারা ডাক্তার/নার্স/স্বাস্থ্যকর্মী, তাদের প্রতিদিন সরাসরি রোগীদের সংস্পর্শে আসতে হয়। কিন্তু আমরাও মানুষ, আমাদেরও মানবাধিকার আছে; এই পৃথিবীতে সন্তান এবং পরিবার পরিজন নিয়ে রোগমুক্তভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আমাদেরও আছে।”
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের অবস্থার উন্নতি হওয়ায় বৃহস্পতিবার আইসিইউ হতে সাধারণ ওয়ার্ডে নিয়ে আসা হয়েছে। আর আবদুল মাবুদ চৌধুরী বুধবার রাতে আইসিইউতে মারা যান।
যুক্তরাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্য বিভাগে অনেক বিদেশি কর্মীদের মধ্যে শত শত বাংলাদেশি রয়েছেন। সেখানে করোনাভাইরাসে মৃত প্রথম বাংলাদেশি চিকিৎসক আবদুল মাবুদ চৌধুরী।
পঞ্চাশোর্ধ্ব এই বাংলাদেশি চিকিৎসকের আগে থেকে গুরুতর কোনো স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছিল না বলে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
বিবিসি বাংলা বলছে, পারিবারিক ও বন্ধু মহলে ফয়সাল নামে পরিচিত এই চিকিৎসকের স্ত্রীও ডাক্তার। তিনিও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন, কিন্তু সেরে উঠছেন।
এনএইচএসের বাংলাদেশি ডাক্তার তাদের পারিবারিক বন্ধু বিশ্বজিৎ রায়কে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, সপ্তাহখানেক আগে ডা. ফয়সালের জ্বর ও ডায়রিয়া দেখা দেয়। এক পর্যায়ে ‘সামান্য ডেলিরিয়ামের (প্রলাপ)’ লক্ষণ দেখা দিলে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন।
“হাসপাতালে যাওয়ার পর জানা যায় যে ডাক্তার আবদুল মাবুদ চৌধুরীর ফুসফুসটি ভালভাবে কাজ করছে না। প্রথম দিন থেকেই তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল তার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তিন দিন পর তাকে হাসপাতালে ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটে সরিয়ে নেয়া হয়।”
বিশ্বজিৎ বলেন, “কৃত্রিম অক্সিজেন দিয়েও যখন অবস্থার কোনো উন্নতি হলো না, তখন তাকে ভেন্টিলেশন দেওয়া হয়। প্রথমদিকে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়।
“কিন্তু এরপর তার গায়ে আবার জ্বর দেখা দেয়। একইসাথে তার কিডনি, লিভার ইত্যাদির কাজ বন্ধ হয়ে যায়, যাকে আমরা ‘মাল্টি অর্গান ফেইলিউর’ বলে থাকি।”
বুধবার রাত সাড়ে ১০টায় ডাক্তার আবদুল মাবুদ চৌধুরীর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
নভেল করোনাভাইরাসের মহামারির বিরুদ্ধে ব্রিটেনে সামনের কাতারে লড়াইতে থাকা ডাক্তারদের মধ্যে অন্তত নয়জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তাদের সবাই ভারত, পাকিস্তান, মিশর, নাইজেরিয়া, সুদানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা।
এই তালিকায় এখন সর্বশেষ যুক্ত হলেন বাংলাদেশি ডাক্তার আবদুল মাবুদ চৌধুরী।
ডা. আবদুল মাবুদ চৌধুরী ব্রিটেনের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে সুপরিচিত মুখ; যুক্ত ছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে।
তিনি পড়াশোনা করেছেন বাংলাদেশের সিলেট ক্যাডেট কলেজ এবং চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে। স্ত্রী, এক ছেলে এবং এক মেয়েকে নিয়ে ছিল তার সংসার।
তার ছেলে ইনতিসার চৌধুরী স্কাই নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “ভুল ধরিয়ে দিতে আমার বাবা কোনোদিন ভয় পাননি।
“কারণ তিনি তার সহকর্মী, বন্ধু, পরিবার- সবার কথা ভাবতেন। এমনকি যাদের সঙ্গে হয়তো তার দেখা হয়নি, তাদের কথাও তিনি ভাবতেন।”