পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো হত্যাকাণ্ডের ১০ বছর পর এর দায় স্বীকার করেছে জঙ্গি গোষ্ঠী তালেবান।
Published : 15 Jan 2018, 08:44 PM
ঊর্ধ্বতন তালেবান জঙ্গি নেতা আবু মনসুর অসিম মুফতি নূর ওয়ালির লেখা নতুন এক বইয়ে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) এই প্রথম ঘটনার দায় স্বীকার করল।
২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে একটি নির্বাচনী সমাবেশ শেষে ফেরার পথে আত্মঘাতী হামলায় বেনজির নিহত হন। বেনজিরের গাড়ি বহরের কাছে গিয়ে তাকে গুলি করে এবং আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটায় বিলাল নামের এক কিশোর।
পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মুশাররফ প্রশাসন টিটিপি’কে বেনজির হত্যার জন্য দায়ী করেছিল। কিন্তু গোষ্ঠীটি এতদিন এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে মুখ খোলেনি। উল্টো এ হত্যা মামলায় মুশাররফের নাম চলে এসেছে।
মুশাররফ অভিযোগ অস্বীকার করে আসলেও গত বছর অগাস্টে রাওয়ালপিন্ডির সন্ত্রাস বিরোধী আদালত তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযুক্ত করে। একই মাসে বেনজির হত্যা মামলা থেকে খালাস পায় টিটিপি’র ৫ সন্দেহভাজন জঙ্গিও।
শেষ পর্যন্ত তালেবান নেতা মনসুর তার বইয়ে বেনজির হত্যাকাণ্ডে তার দল জড়িত থাকার দাবি করলেন। বইটির নাম ‘ইনকিলাব মেহসুদ সাউথ ওয়াজিরিস্তান: ফ্রম ব্রিটিশ রাজ টু আমেরিকান ইমপেরিয়ালিজম।’ গত বছর ৩০ নভেম্বরে এটি প্রকাশিত হয়।
বহু তালেবান নেতার ছবি সম্বলিত ৫৮৮-পাতার এ বইয়ের সংস্করণ রোববার অনলাইনে পোস্ট করা হয়েছে।
এতে মনসুর লিখেছেন, বেনজির ভুট্টোকে হত্যার জন্য বিলাল ওরফে সাঈদ এবং ইকরামুল্লাহ নামে দুই জঙ্গিকে পাঠানো হয়েছিল।
“বিলাল প্রথমে তার পিস্তল দিয়ে বেনজির ভুট্টোকে গুলি করে, গুলি তার ঘাড়ে লাগে। তারপর সে সমাবেশে আসা লোকজনের ভিড়ে আত্মঘাতী হামলা চালায়।”
আর দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের আদিবাসী এলাকার অধিবাসী ইকরামুল্লাহ সেখান থেকে বেঁচে ফেরে। সে এখনও বেঁচে আছে বলে বইতে উল্লেখ করা হয়েছে।
ওই হামলার পর মুশাররফ প্রশাসন একটি অডিও প্রকাশ করে। যেখানে দুই তালেবান সদস্যকে ভুট্টোর মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়।
রাওয়ালপিন্ডিতে হামলার দুই মাস আগেই করাচিতে আরেকটি নির্বাচনী সমাবেশে আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে বেনজিরকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল বলেও বইতে দাবি করা হয়। দুইটি আত্মঘাতী হামলায় সেবার প্রায় ১৪০ জন নিহত হয়।
মুশাররফ প্রশাসন বেনজিরের নিরাপত্তায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় তার উপর সহজে হামলা চালানো সম্ভব হয়েছে বলেও বইতে লেখেন আবু মনসুর।
“করাচিতে বেনজির ভুট্টোর নির্বাচনী সমাবেশে হামলার পরও মুশাররফ প্রশাসন বেনজিরের নিরাপত্তায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। যে কারণে রাওয়ালপিন্ডিতে আবারও তার সমাবেশে হামলা করা সহজ হয়ে গিয়েছিল।”
পাকিস্তানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোর মেয়ে ছিলেন বেনজির ভুট্টো। জেনারেল জিয়া-উল হকের আমলে জুলফিকার আলিকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
১৯৯০-এর দশকে দুইবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন বেনজির। কিন্তু দুইবারই সেনাবাহিনী দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে।
মৃত্যুর আগে তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছা নির্বাসন ছেড়ে দেশে এসেছিলেন বেনজির।
২০০৭ সালের অক্টোবরে তৎকালীন তালেবান প্রধান বাইতুল্লাহ মেহসুদ বেনজিরের মিছিলে হামলার অনুমতি দেন বলে বইতে দাবি করা হয়।
২০০৯ সালে মার্কিন ড্রোন হামলায় বাইতুল্লাহ নিহত হন।
“মুজাহিদিদ-ই-ইসলাম এর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বেনজির ভুট্টো ফিরে এসেছিলেন। বেনজিরকে নিয়ে সাজানো যুক্তরাষ্ট্রের ওই পরিকল্পনার তথ্য বাইতুল্লাহর হাতে এসেছিল।
“যে কারণে বেনজির দেশে ফেরার পর মহসিন মেহসুদ এবং রেহমাতুল্লাহ মেহসুদ নামে দুই আত্মঘাতী হামলাকারী করাচিতে তার সমাবেশে হামলা চালায়।”
বেনজির হত্যায় অংশ নেওয়া দলটিকে তদন্ত কর্মকর্তারা পাকড়াও করেছিল বলেও বইতে দাবি করা হয়।
অথচ গত এক দশক ধরে টিটিপি বেনজির হত্যায় তাদের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে এসেছে। এখন কেন স্বীকার করছে তার কারণও জানা যায়নি।
বইটিতে টিটিপি’র ইতিহাস, তাদের হামলা, তালেবান নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে সেনা অভিযান, আফগানিস্তানে তাদের কার্যক্রম, কিভাবে দল পরিচালিত হয় ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ‘দ্য ডেইলি টাইমস’ পত্রিকা।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির মুখপাত্র ফরহাতুল্লাহ বাবর বলেছেন, তালেবান বেনজির হত্যার দায় স্বীকার করায় ওই হত্যাকাণ্ডের জন্য জঙ্গিদেরকে কাজে লাগানো হয়েছে এমন সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়েছে।
আরব নিউজ’কে বাবর বলেন, “আসলে আমরা জানতে চাই বেনজির ভুট্টোকে হত্যার পরিকল্পনার হোতা কারা ছিল। হোতা যে-ই হয়ে থাকুক তাকে খুঁজে বের করা উচিত। তারাই আসলে হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে এসব লোককে (তালেবান) কাজে লাগিয়েছে।”