পুতিনের ছয় বছর পশ্চিমাদের জন্য উদ্বেগ, স্বস্তি চীন-ভারত-ইরান- উ. কোরিয়ার

ছবি: রয়টার্স।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পেয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আরও অন্তত ছয় বছর ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করেছেন। তার এই ছয় বছরের শাসনামল পশ্চিমা অনেক দেশের জন্য উদ্বেগজনক হলেও চীনসহ কয়েকটি দেশের জন্য তা সুসংবাদ এবং স্বস্তির।

পুতিনের জয়ের পর সোমবার বিশ্বে তার ভবিষ্যৎ শাসনামলের এই প্রভাব বিশ্লেষণ করে দেখার চেষ্টা করেছে সিএনএন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুতিনের জয় পশ্চিমা দেশগুলোর নেতাদের আরও একবার মনে করিয়ে দিয়েছে রাশিয়ার রাজনৈতিক অঙ্গনে এ নেতার নিরবচ্ছিন্ন প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি।

রোববার রাশিয়ার নির্বাচনের প্রাথমিক ফলে দেখা যায়, পুতিন প্রায় ৮৮ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। রয়টার্স লিখেছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন পরবর্তী যুগে রাশিয়ার কোনও নেতার সবচেয়ে বড় ব্যবধানে নির্বাচনে জয়ের রেকর্ড এটি।

ভোটের দিন রাশিয়ার বিভিন্ন অংশে পুতিন বিরোধী বিক্ষোভের মধ্যেও তার অন্য তিন প্রতিযোগীর কারও ভোটের হার দুই অঙ্কের কোটায় পৌঁছেনি। তারা কেউ ৪ শতাংশের বেশি ভোট পাননি।

পশ্চিমা কয়েকটি দেশ রাশিয়ার এই নির্বাচনের নিন্দা করেছে। জার্মানি বলেছে, এটি ছিল ছদ্ম-নির্বাচন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ আরও কয়েকটি দেশ বলেছে, এই নির্বাচন অবাধ ও মুক্ত ছিল না। কারণ, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদেরকে কারাবন্দি করা হয়েছে এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের কণ্ঠ রুদ্ধ করা হয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বৈদেশিক নীতি বিষয়ক প্রধান জোসেফ বরেল বলেছেন, দমনপীড়ন এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করে এ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হয়েছে। ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, পুতিন ক্ষমতার জন্য মরিয়া। তার শাসন চিরস্থায়ী করার জন্য তিনি সব করছেন। 

অন্যদিকে, ইরান, চীন সহ আরও কয়েকটি দেশের নেতা রাশিয়ার নির্বাচনে পুতিনের জয়ে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এই দেশগুলো পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন বিশ্ব ব্যবস্থা মেনে নিতে চায় না। মূলত এ দেশগুলোই পুতিনের বিজয়ে উপকৃত হয়েছে বলে অভিমত বিশ্লেষকদের।

পুতিনের জয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছেন, তার পুননির্বাচন রাশিয়ার জনগণের পূর্ণ সমর্থনের প্রতিফলন ঘটিয়েছে। জিনপিং দুই বছর আগে ইউক্রেইনে রাশিয়ার আগ্রাসনের শুরু থেকেই পুতিনের পাশে ছিলেন। তিনি দু’দেশের পূর্বঘোষিত 'সীমাহীন' বন্ধুত্বের সম্পর্ক থেকে সরে আসেননি। পুতিনের জয়ে বরং জিনপিং দুই দেশের সম্পর্ক আরও টেকসই করার অঙ্গীকার করেছেন।

শি'র এই অবস্থানের কারণে চীনকে মূল্য দিতে হয়েছে। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে তিনি পুতিনকে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে দেখেন।

এই দুই নেতা মনে করেন, বর্তমান বিশ্বে অন্যায়ভাবে ওয়াশিংটনের বেঁধে দেওয়া নিয়ম-নীতি ও মূল্যবোধ আধিপত্য বিস্তার করছে। রাশিয়ার সঙ্গে স্থিতিশীল সম্পর্ক চীনকে তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগরের মতো বিষয়গুলোর দিকে নজর দেওয়ার সুযোগ করে দেয়।

নির্বাচনে পুতিনের জয় অন্যান্যদের মধ্যে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের জন্যও স্বস্তির। সম্প্রতি তিনি ক্রেমলিনে গিয়ে পুতিনের সঙ্গে দেখা করেছেন। রাশিয়ার সঙ্গে মজবুত সম্পর্ক উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে কিমের জন্য একটি বড় সুযোগ।

পুতিনের জয়ে তাই উত্তর কোরিয়ার নেতা দ্রুতই তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা জর্জরিত ইরানও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের বিস্তার ঘটাচ্ছে। রাশিয়ার কাছে ড্রোন ও গোলাবারুদ বিক্রি করে ইরান। ফলে আরেক দফায় পুতিনের শাসনামল ইরানের জন্যও সুখবর।

ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটানো এবং ইউক্রেইনে শান্তির আহ্বান জানালেও রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেন কমায়নি। বিশেষত, ছাড় দেওয়া মূল্যে তেল কেনার ক্ষেত্রে।

বিশ্বজুড়ে দক্ষিণের অন্যান্য কিছু দেশও রাশিয়ার সঙ্গে অংশীদারিত্ব বাড়াতে চায়। যদিও তারা ইউক্রেইনে শান্তি ফিরে আসুক তা চায় এবং এই যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক দুর্দশায় ভুগেছে।

এবারের নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে রাশিয়ার ২০০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকতে যাচ্ছেন পুতিন।

কারাগারে আলেক্সি নাভালনির রহস্যমৃত্যু নিয়ে সমালোচনার ঝড় এবং ইউক্রেইন যুদ্ধে রুশ সেনা নিহতের তালিকা দীর্ঘ হওয়া নিয়ে দেশের ভেতরে দানা বাঁধতে থাকা ক্ষোভের মধ্যেও নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পুতিন জয় পেয়েছেন।

ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরুর পর দেশে পুতিন ভাড়াটে সেনাদল ওয়াগনারের প্রধান যুদ্ধবাজ নেতা ইয়েভগেনি প্রিগোজিনের কাছ থেকে বিরোধিতার মুখে পড়েছেন। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্ব বাজার থেকে দেশটি একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

এতেও পুতিন তার অবস্থান থেকে টলেননি। বরং দেশে তিনি দমনপীড়ন আরও জোরদার করেছেন। প্রিগোজিনকে সরানোর পাশাপাশি তিনি তার কট্টর সমালোচক অ্যালেক্সি নাভালনিকেও দূর করে দিয়েছেন; গতমাসে কারাগারে যার মৃত্যু হয়েছে।

এবার পুতিন আরও ছয়বছরের জন্য শাসনক্ষমতায় আবির্ভূত হয়েছেন। নিষেধাজ্ঞার মুখে টিকে থাকা অর্থনীতি দেখভাল করাসহ তাকে রণক্ষেত্রেও নজর দিতে হবে। যেখানে তার বিরোধীদের এখনও চূড়ান্ত কিছু হতে দেখা বাকি।

নির্বাচনের পরে এক সংবাদ সম্মেলনে পুতিন ইউক্রেইনে আগ্রাসন চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। ইউক্রেইন যুদ্ধ এবং সার্বিকভাবে এই যুদ্ধে পশ্চিমাদের বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এক ক্রান্তিলগ্নের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় রাশিয়ায় নির্বাচন হয়েছে।

ইউক্রেইনকে সামরিক সহায়তা দিয়ে যাওয়ার বিষয়টি সম্প্রতি মার্কিন রাজনীতিতে বড় অনুঘটক হয়ে দেখা দিয়েছে। নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও এ বিষয়টি প্রভাব রাখতে পারে।

যুদ্ধে অনেক কিছুই পরিবর্তন হতে পারে। তবে সেইসব দেশ যারা পুতিনের ঘনিষ্ঠ এবং পুতিনকে বিচ্ছিন্ন করার যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা এড়িয়ে চলেছে, তারা রুশ প্রেসিডেন্টের এই জয়ে রাশিয়ার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক স্থিতিশীল রাখার নিশ্চয়তা পেয়ে গেল। আর পশ্চিমা-বিরোধী জোট দানা বেঁধে ওঠার সম্ভাবনাও বাড়ল।