আগাম নির্বাচন ঘোষণার আগের কয়েক দিনে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর আভাস ছিল।
Published : 02 Jul 2024, 09:37 PM
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক গত মে মাসে যখন ৪ জুলাইয়ে আগাম নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দেন, তখন অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন- এমন সময়ে কেন নির্বাচন?
সুনাকের ঘোষণার কিছু দিন আগে যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ে তার কনজারভেটিভ পার্টি। সেখানে বড় জয় পায় কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল লেবার পার্টি।
তারও আগে থেকে বিভিন্ন জরিপে জনসমর্থনে লেবার পার্টির পেছনেই থাকতে দেখা যাচ্ছিল ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টিকে। ফলে এমন নিশ্চিত পরাজয়ের পূর্বাভাসের মধ্যে আগাম জাতীয় নির্বাচন কেন, সে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
আগাম নির্বাচন ঘোষণার আগের কয়েকটি দিন দেশটির অর্থনীতি সুনাক সরকারের জন্য তুলনামূলক স্বস্তির ছিল। সে সময় অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলেই আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) যুক্তরাজ্যে প্রবৃদ্ধির নতুন পূর্বাভাস দিচ্ছিল এবং মূল্যস্ফীতি অবশেষে স্বাভাবিক পর্যায়ে ফেরার লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল।
চলতি বছর এপ্রিল-মে মেয়াদে যুক্তরাজ্য সরকার মূল্যস্ফীতি কমার সুখবর পায়। ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন সেই সুখবর জানিয়ে বলেছিলেন, এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি কমে ২ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে, যা তার আগের মাসে অর্থাৎ, মার্চে ছিল ৩ দশমিক ২ শতাংশ। আর মে মাসে মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়ায় ২ শতাংশে, যেটি ছিল সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্য।
ফলে প্রায় তিন বছরের মধ্যে সরকার প্রথম তাদের মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে সক্ষম হয়। আর সুনাক, যিনি ক্ষমতায় বসেছিলেন মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকা, প্রবৃদ্ধি না থাকা এবং অভিবাসন সংকটের নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে; সেগুলো মোকাবেলায় তার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যায়।
এ পরিস্থিতিতে সব কিছু ‘সঠিক পথে চলছে’ বলার একটি ভিত্তি পেয়ে যায় সুনাক সরকার। তারা যে দেশের জন্য কাজ করেছেন, তাদের পরিকল্পনা যে কাজে আসছে; তা দেশের মানুষকে বলা এবং দেশকে আরও নিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা কার আছে- সেই প্রশ্ন দেশবাসীর সামনে রাখার পট প্রস্তুত হয়।
সেই পরিপ্রেক্ষিতেই জুয়া খেলার সিদ্ধান্ত নেন সুনাক, দিয়ে বসেন আগাম নির্বাচনের ঘোষণা।
ভোটের আগে প্রকাশ করার জন্য মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যানটি ছিল সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সূচকগুলোর একটি। যদিও এককভাবে মূল্যস্ফীতির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হলেও এটিকেই একমাত্র পরিমাপক হিসাবে দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা।
সুতরাং, বলা যায় সেই সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের প্রচার উপদেষ্টা জেমস কারভিলের ১৯৯২ সালের বুলি (“এটা অর্থনীতি, বোকা”), যা আজও কানে বাজে।
ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক মন্দা চলছিল। আর কারভিল প্রচারকর্মীদেরকে সব ক্ষেত্রে অর্থনীতির গুরুত্বের ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে কথাটি বলেছিলেন। কেবল বলেই ক্ষ্যান্ত হননি, প্রচার শিবিরের সদর দপ্তরে ‘এটা অর্থনীতি, বোকা’ লেখা সাইনবোর্ডও টাঙিয়েছিলেন। ক্লিনটনের নির্বাচনী প্রচারের মূলমন্ত্র হয়ে উঠেছিল এই রাজনৈতিক স্লোগান।
কারভিলের সেই কথাকে স্মরণে রেখে যুক্তরাজ্যে ১৪ বছরের কনজারভেটিভ (টোরি) শাসনামলে অর্থনীতির হাল-হকিকত আদতে কেমন গেছে, তার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছে ‘দ্য গার্ডিয়ান’।
পণ্য ও সেবামূল্য এখনও বাড়ছে
করোনাভাইরাস মহামারীর পর যুক্তরাজ্য কীভাবে ভোগান্তিতে পড়েছে তা এক কথায় বলতে গেলে চলে আসে ‘জীবনযাত্রা ব্যয় সংকটের’ কথা। এক দিকে মহামারী, অন্যদিকে ইউক্রেইনে যুদ্ধ- দুই কারণে সব ধরনের সেবা ও পণ্যের মূল্য বাড়ছে; বিশেষত খাবার, জ্বালানি ও উষ্ণ থাকার ব্যবস্থা।
২০২২ সালের অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি পৌঁছেছিল শীর্ষে, যা ছিল ১১ দশমিক ১ শতাংশ। তারপর থেকে এই মূল্যস্ফীতি কমে এসেছে। মাঝে কিছুটা ওঠানামা হলেও ২০২৩ সালে মূল্যস্ফীতি অর্ধেকে নামিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রী সুনাকের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণের প্রচেষ্টা তাতে সহায়ক হয়েছে।
তারপরও খাবারের দাম এখনও ২০২১ সালের জুলাইয়ে যা ছিল তার চেয়ে ২০ শতাংশ ওপরে আছে। পারিবারিক খরচ মেটাতেও টানটান অবস্থা। একটি পরিবারের জন্য খাবার বাবদ ছয় বছর আগে যে ব্যয় হত,সেই তুলনায় এখন অনেক বেশি।
চার সদস্যের একটি পরিবারের জন্য ‘স্প্যাগেটি বোলগনিজ’ বানাতে ২০১৮ সালের মে মাসের দিকে খরচ হত ৮ দশমিক ৪৪ পাউন্ড। সেখানে গত বছর জুনে একই খাবার বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানের দাম চড়ে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৩৫ পাউন্ডে। আর গত মাসে তা একটু কমে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ১৫ পাউন্ডে।
সুদের হার কমার আভাস
সুদের হার ১৯৮০ এর দশকে অনেক বেশি ছিল, যখন সম্পদের মূল্য ছিল কম। কিন্তু বাড়ির দাম বেড়ে যাওয়ায় ২০০০ এর দশকে সুদের হার কমে যায়। এরপর আসে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সময়। ঋণের সুদ কমে দাঁড়ায় প্রায় শূন্যে।
২০২১ সালে বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতির কারণে সুদের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ২৫ শতাংশে। আর এখন অবস্থা আরও খারাপ। সুদের হার বেশি, বাড়ির দামও আকাশছোঁয়া।
মূল্যস্ফীতি কমার পর এখন ব্যাংক অব ইংল্যান্ড এর কর্তারা সেপ্টেম্বরে সুদের হার কমানো শুরু করতে পারেন, তেমন সম্ভাবনা বেশি। আবার ডিসেম্বরেও সুদের হার কমিয়ে ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হতে পারে।
অন্য আরও যে কারণে সেন্ট্রাল ব্যাংক সুদের হার কমতে পারে, তা হচ্ছে অর্থনীতির শ্লথ প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান সামনে আসা এবং বেকারত্ব বাড়তে থাকা- দুটোই বয়ে এনেছে কনজারভেটিভ সরকারের ১৪ বছরের শাসনের ধারা, যে সরকার বিনিয়োগের চেয়ে কৃচ্ছ্র সাধনকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।
সুদের হার কমে এলে অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান মিলবে। কিন্তু সেটিই শেষ কথা নয়। বিশ্ব অর্থনীতির দিক থেকে ঝুঁকি আছে, আবার দেশের ভেতরেও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে চাপ আছে। মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের বিস্তার ঘটলে তেলের দাম বেড়ে যেতে পারে। আবার যুদ্ধে ইউক্রেইন যদি পরাজিত হয়, সে ক্ষেত্রে জ্বালানির দাম ফের বাড়তে পারে।
সরকারের ঋণ এখনও বেশি
যুক্তরাজ্যের জাতীয় আয় বা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে সরকারের ঋণ গত শতকের প্রথমার্ধ থেকে অনকখানি কমে এসেছিল।
১৯৯০ এর দশকে তৎকালীন চ্যান্সেলর গর্ডন ব্রাউনের উদ্বৃত্ত বাজেটের (আয়ের তুলনায় সরকারের ব্যয় কম হওয়া) কারণে সামগ্রিকভাবে ঋণের মাত্রা কমে জিডিপির ৫০ শতাংশেরও নিচে চলে গিয়েছিল।
কিন্তু ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সময় আবার তা শতভাগেরও বেশি বেড়ে যায়। আর এখন সর্বশেষ সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জিডিপির তুলনায় সরকারের ঋণ ৯৭ শতাংশ। আনুপাতিক হারে ঋণ পরিস্থিতি কনজারভেটিভ নেতৃত্বাধীন কোনো সরকারকে অর্থনৈতিক মন্দার আগের অবস্থায় ফেরাতে পারেনি ।
মন্দা কী অতীত হয়েছে?
টানা দুই প্রান্তিকে অর্থনৈতিক কার্যকলাপের ধীর গতি অথবা বাণিজ্যিক আবর্তন সংকুচিত হলে তাকে মন্দা বলে গণ্য করা হয়। কিছু অর্থনীতিবিদদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিও রয়েছে।
‘দ্য ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ইকোনমিক অ্যান্ড স্যোশাল রিসার্চ’ বলছে, গোটা বছর ধরেই অর্থনীতির সংকোচন হতে হয়; কিন্তু এতে ২০২৩ সালে অর্থনীতি নিম্নগামী হওয়ার ধারণা ধোপে টেকে না। ওই বছরে অর্থনীতি জুন এবং ডিসেম্বরের মধ্যে সংকুচিত হয় কিন্তু পুরো বছরের মধ্যে আবার কিছুটা প্রবৃদ্ধিও হয়েছিল।
২০২০ সালের বসন্তে করোনাভাইরাস মহামারীর প্রভাবে বিশাল সংকোচন হয়েছিল অর্থনীতিতে। তবে তখন অর্থনীতির চাকা বন্ধ ছিল সরকারের নির্দেশে। ফলে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডসহ গৃহস্থালি খাতে সহায়তা করার জন্য সরকার ভর্তুকি দিয়েছিল।
২০০৯ সালের মন্দার সময়ও সরকার নাগরিকের আয়ে ধাক্কা কমিয়েছিল। ১৯৯০ সালের অর্থনৈতিক সংকোচনের সময় থেকে মানুষ যে রাষ্ট্রের খুব বেশি হস্তক্ষেপ ছাড়া জীবন ধারণ করে এসেছে, তা নয়। তারপরও হাজারো মানুষ বাড়িঘর হারিয়েছে, অনেক ব্যবসা লাটে উঠেছে।
মন্দা সব সময় দূরে থাকে না। ব্যবসার প্রসারে প্রচুর ঋণ নিয়ে যখন তা ঠিক পথে এগোয় না, তখন মন্দা দেখা দেওয়ার প্রবণতা থাকে। আর এর পুনরাবৃত্তিও সব সময় একই ধারায় হয় না; বিশেষ করে যখন সুদের হার থাকে উচ্চ। তবে আরও অনেক বিষয়ও এখানে আসতে পারে।
ফুড ব্যাংকের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে, বেতন একই জায়গায় থাকলে রেকর্ড সংখ্যক মানুষ ফুড ব্যাংকের ওপর নির্ভর করে।
যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় ফুড ব্যাংক দাতব্য সংস্থা ‘ট্রাসেল ট্রাস্ট’ দ্রুতই তাদের কার্যক্রমের প্রসার দেখছে।
ফুড ব্যাংকের সংখ্যা থেকে শুরু করে জরুরি পার্সেল পাঠানোর সংখ্যার বিচারে যুক্তরাজ্যে গরিব পরিবারের সংখ্যা বাড়তে থাকারই এক দুঃখজনক রেকর্ড পাওয়া যায়।
ফুড ব্যাংকের দারস্থ যারা হয়, তাদের বেশিরভাগই কর্মজীবী। কিন্তু নিম্ন মজুরির কারণে তারা পরিবারের খরচ চালাতে পারে না। ভোক্তা ব্যয়ই যে কেবল বাড়ছে তা নয়, বাড়ছে কর, ভাড়া এবং বন্ধকের কিস্তি।
সর্বশেষ সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ভাড়ায় মূল্যস্ফীতি রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। যাদের নতুন করে মর্টগেজের প্রয়োজন, তারা মাসে দ্বিগুণ-তিনগুণ সুদ দেওয়ার মুখে পড়তে পারে।
আবার গৃহহীনদের দাতব্য সংস্থা ‘ক্রাইসিস’ এর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রাস্তা-ঘাটে ঘুমানো মানুষের সংখ্যা ১০ বছর আগের তুলনায় এখন ৬১ শতাংশ বেশি। আর ২০১০ সালে যখন গৃহহীনদের তথ্য সংগ্রহ শুরু হয়েছিল, তখনকার চেয়ে এ সংখ্যা ১২০ শতাংশ বেশি।