গাজার দক্ষিণের নগরী খান ইউনিসের প্রতিটি রাস্তা, ঘর, আনাচে-কানাচে কেবল মানুষ আর মানুষ। এই বাড়তি মানুষের চাপ সামলাতে সেখানে নেই কোনও প্রস্তুতিও।
Published : 16 Oct 2023, 12:21 AM
গাজার দক্ষিণের নগরী খান ইউনিস। উত্তর গাজা থেকে ফিলিস্তিনিরা পালিয়ে এই নগরীতে জড়ো হওয়ায় সেখানে নেমেছে মানুষের ঢল। গাড়ি, ঘোড়া, ভ্যানে চড়ে কিংবা পায়ে হেঁটে যে যেভাবে পেরেছে সেভাবেই এখানে এসেছে।
এসেই তারা দেখেছে মানুষের ভারে নুয়ে পড়া এক নগরীকে। যেখানে এক রাতেই জনসংখ্যা হয়েছে দ্বিগুন। জড়ো হওয়া লাখো মানুষের চাপ সামলাতে সেখানে নেই কোনও প্রস্তুতি। নগরীর প্রতিটি রাস্তাঘাট, প্রতিটি ঘর, আনাচে-কানাচে খালি মানুষ আর মানুষ। আর কোথাও যাওয়ার জায়গাও নেই।
ইসরায়েলের সেনাবাহিনী গত শুক্রবারেই উত্তর গাজার ১১ লাখ বাসিন্দাদকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দক্ষিণে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। হামাস জানিয়েছে, এই ১১ লাখের মধ্যে ৪ লাখ বাসিন্দা গত ৪৮ ঘণ্টায় সালাহ আল দিন সড়ক ধরে দক্ষিণের দিকে চলে গেছে।
কিন্তু গাজা খুব ছোট একটি ভূখণ্ড। সব দিক দিয়েই অবরুদ্ধ। বহির্বিশ্ব থেকেও বিচ্ছিন্ন। সেখানে কারও পালিয়ে কোথাও আশ্রয় নেওয়ার জায়গা খুবই সীমিত। নিরাপত্তার কোনও নিশ্চয়তাও নেই।
ফলে দিশেহারা গাজাবাসীদের অনেকেরই যাদের বাড়ি উড়ে গেছে বোমায়, যারা সবকিছু হারিয়েছে, যারা ভীত-শঙ্কিত তারাই এসে জড়ো হয়েছে খান ইউনিসে। এরপর তাদের ভাগ্যে কী ঘটতে চলেছে তা তারা কেউই জানে না।
খান ইউনিস নগরীতে সাধারণত ৪ লাখ মানুষের বাস। গতরাতে সেখানে মানুষের সংখ্যা বেড়ে ১০ লাখেরও বেশিতে দাঁড়িয়েছে। বাড়তি এই সব মানুষ উত্তরের পাশাপাশি পূর্ব দিক থেকেও এসেছে। ২০১৪ সালের যুদ্ধে যারা ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হয়েছিল।
এই প্রতিটি মানুষেরই দরকার আশ্রয়, খাবার। আর সেটা কতদিনের জন্য তাও তাদের জানা নেই।
ভেঙে পড়ছে নগরব্যবস্থা:
অপ্রতুল যে সম্পদ খান ইউনিসে আছে তাও ফুরিয়ে আসার পথে। নগরীটির অবস্থা এরই মধ্যে নাজুক। তার মধ্যে হঠাৎ করে আরও মানুষের ঢলে গোটা সিস্টেমই ভেঙে পড়তে শুরু করেছে।
নগরীর প্রধান হাসপাতাল, যেখানে প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব লেগেই থাকে, সেখানে এখন ঠাঁই দিতে হয়েছে উত্তর দিক থেকে আসা অসুস্থ এবং আহতদের। হাসপাতালটি এখন শরণার্থী মানুষের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠৈছে।
শরণার্থীরা করিডোরে লাইন ধরে আছে। আর চিকিৎসকরা ইসরায়েলি বোমায় আহত নতুন নতুন মানুষদের সেবা দিচ্ছে।
হাসপাতালে ভিড় করার জন্য মানুষজনকে দোষারোপ করা যায় না। কারণ, যুদ্ধের সময় হাসপাতালগুলোই সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। আন্তর্জাতিক আইনে এর নিরাপত্তা সুরক্ষিত। সেদিক থেকে হাসপাতালে আশ্রয় পাওয়া মানুষেরা সৌভাগ্যবান বলা যায়। অন্তত আপাত সময়ের জন্য।
চিকিৎসকরা বলছেন, হাসপাতালে নতুন আহতদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার মতো বলতে গেলে কিছুই নেই। রোগীদের জন্য দিনে মাত্র ৩শ’ এমএল এর পানি বরাদ্দ আছে। শরণার্থীদেরকে দেওয়ার মতো কিছু নেই।
কোথাও কোথাও খান ইউনিসের বাসিন্দারা নতুন আগতদের জায়গা দিচ্ছে। খান ইউনিসে অনেকেই খুব অল্প জায়গার মধ্যে বাস করে। এখন সেখানে মানুষে গাদাগাদি অবস্থা।
ছোট্ট একটি অ্যাপার্টমেন্ট, যেখানে আগে থেকেই ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি মানুষের বাস, সেটি এখন হয়ে উঠেছে ৫০ থেকে ৬০ জন মানুষের বাড়ি। বেশিদিন কারো পক্ষেই এভাবে বাস করা সম্ভব না।
যুদ্ধকালে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্কুলগুলোও মানুষে পরিপূর্ণ। নগরীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা স্কুলগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে বহু পরিবার। জাসিংঘ পরিচালিত একটি স্কুলের প্রতিটি শ্রেণিকক্ষ ভরে উঠেছে মানুষে। প্রতিটি বারান্দা ভরে উঠেছে তারে মেলা কাপড়ে।
মা, দাদি, নানিরা বাইরের খোলা জায়গায় বেঞ্চে রাখা চুলায় খাবার রান্না করছেন। ক্ষুধার্ত শিশুরা অধীর হয়ে আছে খাওয়ার অপেক্ষায়।
কিন্তু মানুষকে জায়গা দেওয়ার মতো স্থান যখন আর থাকবে না, তখন মানুষে সয়লাব হবে রাস্তা। আন্ডারপাসগুলো মানুষে ভরে উঠবে। রাস্তার ধুলাবালি, ধ্বংসস্তুপের মধ্যেই চলবে জীবনযাপন, ঘুম। ভাল কিছু হওয়ার অপেক্ষায় দিন কাটাবে মানুষ। যে ভাল হয়ত আর কখনওই আসবে না।
খান ইউনিসে আছে খুবই সামান্য খাবার। দোকনগুলোতে নেই পানি। সেক্ষেত্রে পানি স্টেশনগুলোই ভরসা। পরিস্থিতি বিপর্যয়কর। তাও যদি নগরীটি যুদ্ধে কোনও ক্ষয়ক্ষতি হওয়া থেকে নিরাপদ হত, সেটি একটা কথা ছিল। কিন্তু খান ইউনিসেও নিয়মিতই বোমা হামলা হয়।
নগরীটি এখনও এক যুদ্ধক্ষেত্র। সেখানেও রাস্তায় আছে বাড়িঘরের ধ্বংসস্তুপ। সেখানে হাসপাতালের কাছ থেকে রকেট ছোড়ার শব্দ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন বিবিসি’র স্থানীয় এক সাংবাদিক।
ইসরায়েলের ভেতরে হামাস অনবরতই এভাবে রকেট হামলা চালিয়ে আসছে। আর এই রকেট ছোড়া মানে ইসরায়েলকে পাল্টা জবাব দিতে যেন প্রকাশ্যেই আহ্বান করা। ইসরায়েল বোমা হামলা চালালে আর ভবন ধ্বংস হলে ফের হাসপাতাল এবং মর্গগুলো ভরে উঠবে মানুষে।
গাজা থেকে বের হয়ে যাওয়ার একটি মাত্র যে বিকল্প পথ আছে তা হচ্ছে রাফা সীমান্ত পারাপার এলাকা। যেটি চলে গেছে মিশরে। এই সীমান্ত ক্রসিংটিও বন্ধ করে রাখা হয়েছে। কারণ, কায়রো জানে এই ক্রসিং খুলে দেওয়া হলে নতুন মানবিক বিপর্যয় তৈরি হবে।
এ মুহূর্তে গাজার ১০ লাখ শরণার্থী রাফা সীমান্ত পারাপার এলাকা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরেই অবস্থান নিয়ে আছে। ক্রসিং খুলে দেওয়া মাত্রই দেখা দেবে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। ২০১৪ সালেও ঠিক এরকম পরিস্থিতি দেখা যাওয়ার কথা জানিয়েছেন, বিবিসি’র সাংবাদিক রুশদি আবু আলফ।
তবে তিনি বলেন, এবার পরিস্থিতি গতবারের চেয়ে আরও অনেক খারাপ হবে। আর মিশর সেই ভয়টাই পাচ্ছে। মানুষের ঢলে ভেসে যাবে সীমান্ত। সেটি হবে ফের এক বিশৃঙ্খলা আর বিপর্যয়কর অবস্থা।