ইউক্রেইনের চারটি অঞ্চল রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন পুতিন, দিয়েছেন পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি এবং যুদ্ধে শক্তি বাড়াতে লাখো রিজার্ভ সেনা প্রস্তুত করতে বলেছেন। তারপরও ইউক্রেইনের ইস্টার্ন ফ্রন্টের সেনাদের প্রতিক্রিয়া একই রয়েছে। তারা বলছে, প্রতি ইঞ্চি ভূমির জন্য তারা লড়াই করে যাবে।
গত শুক্রবার ইউক্রেইনের জাপোরিজিয়া, খেরসন, দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
যদিও ওই চার অঞ্চলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এখনও রুশ বাহিনী পায়নি। উল্টো তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা একাধিক শহর ও নগর পুনঃদখল করছে ইউক্রেইনের সেনারা।
বিবিসি-র প্রতিনিধিরা দোনেৎস্কের বাখমুত নগরীর ঘুরে এসেছেন। যেখানে রুশ বাহিনীর সঙ্গে ইউক্রেইনীয় সেনাদের তুমুল লড়াই চলছে।
বাখমুতে ইউক্রেইনের হয়ে যুদ্ধ করছেন ৩১ বছরের ওলেকসানদর। তিনি বলেন, ‘‘এখানে পরিস্থিতি বেশ কঠিন। এটা খুবই চাপের। সবাই খুব চাপে আছে। শত্রুরা আমাদের খুব নিকটে রয়েছে। কিন্তু আমরা এখনও শক্ত আছি এবং লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি।”
তিনি প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাম্প্রতিক গণভোটকে ‘ভ্রান্তিমূলক’ বলে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ইউক্রেইন রাশিয়ার বন্দুকের নির্দেশ মত চলবে না।
‘‘আমার মতে, ওইসব গণভোটে কিছুই পরিবর্তিত হবে না। আমরা পুতিনের বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে যাব এবং তাদের আমাদের ভূমি থেকে তাড়িয়েই ছাড়ব।”
যুদ্ধে কতটা চরম মূল্য দিতে হয় তা খুব ভাল করেই জানেন ওলেকসানদর। তিনি বলেন, ‘‘আমার ভাই মারা গেছে। কিন্তু কোথায় এবং কবে সে মারা গেছে আমি তা জানি না। কারণ সে ভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ করছিল।
‘‘আমি ভাই হারিয়েছি। আমি যাদের সঙ্গে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম তারাও মারা গেছে বলে জানতে পেরেছি। আমি যুদ্ধে পরিবার এবং বন্ধুদের হারিয়েছি।”
২৫ বছরের আরেক যোদ্ধা রোমান যুদ্ধে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। তিনি ড্রোন চালান। রোমান বোমায় বিধ্বস্ত একটি কক্ষের উপরের তলায় থাকেন। যেখানে ধ্বসংস্তুপ ও ভাঙা কাঁচের মধ্যে তার সঙ্গী দুটো বেড়াল।
তার ফোনের স্ক্রিনে তার পাঁচ মাস বয়সের ছেলে কিরিলোর ছবি। কিরিলোর জন্ম যখন হয়েছে তখন সবে যুদ্ধ শুরু। রোমান তার একমাত্র ছেলেকে মাত্র একবারই দেখার সুযোগ পেয়েছেন।
‘‘আমি তাকে ছবি বা ভিডিওতে দেখি, বাস্তবে নয়। এটা খুব কঠিন। কিন্তু যদি রাশিয়ার সেনারা আমার পরিবার পর্যন্ত পৌঁছে যায় তবে কী হবে সেটি কল্পনা করাও কঠিন।
‘‘তারা বুচায় যা করেছে আমি চাই না সেটা করার সুযোগ আবার তারা পাক। আমি কিইভে থাকতাম এবং আমি পরিষ্কার ভাবে বুঝেছি কীভাবে নারীরা পালিয়েছে। যদি আমরা দুর্বল হয়ে পড়ি তবে তারা আমাদের পরিবারের কাছে পৌঁছে যাবে।”
গত মাসে পুতিন তার দেশের রিজার্ভ সেনাদের জড়ো করার নির্দেশ দিয়েছেন। এর অর্থ, সামনের দিনগুলোতে ক্রেমলিন যুদ্ধক্ষেত্রে আরো সেনা পাঠাবে। যা নিশ্চিতভাবেই উদ্বেগের কারণ।
রাশিয়ার রিজার্ভ সেনারা কতটা প্রশিক্ষিত বা তাদের হাতে কী ধরণের অস্ত্র থাকবে সেটা পরিষ্কার হওয়া যাচ্ছে না। তবে ইউক্রেইনের মূল চিন্তা রুশ সেনাদের দক্ষতা নিয়ে নয় বরং তাদের সংখ্যা নিয়ে।
প্রচুর সেনা নিয়ে ইউক্রেইন আক্রমণ করেছে রাশিয়া। বাখমুত যুদ্ধে ইউক্রেইনীয় সেনাদের মনে হচ্ছে, রাশিয়ার সেনা সরবরাহ যেন অফুরান।
ইউক্রেইনীয় সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ইরিনা বলেন, গত অগাস্টে তারা পাঁচ দফায় সেনা পাঠিয়েছে।
‘‘তারা শুধু যাচ্ছেই, তারা থামছেই না। তারা গুলিতে বা গোলা বর্ষণে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। আমরা যাদের যুদ্ধবন্দি করেছি তাদের কেউ কেউ ওয়াগনার (রাশিয়ার ভাড়াটে সেনা)। তাদের কাছে উন্নত অস্ত্র রয়েছে।”
সম্প্রতি ইউক্রেইনের পূর্ব ও দক্ষিণ অঞ্চলে প্রায় ছয় হাজার বর্গ কিলোমিটার ভূমি পুনঃদখল করেছে ইউক্রেইন। এই হার রাশিয়ার জন্য চরম অপমানের। তাই তারা যেকোনো মূল্যে বাখমুতে জিততে চায় বলেই বিশ্বাস ইউক্রেইনীয় সেনাদের।
বাখমুত তাই পুতিনের গলার কাঁট হয়ে আছে। এছাড়া, দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক নিয়ে গঠিত দনবাস অঞ্চলের খনি সমৃদ্ধ অংশে যেতে হলে এই বাখমুত দিয়েই যেতে হবে।
রুশ বাহিনী বাখমুত জয় করতে মরিয়া চেষ্টা করছে, যেটি আগে প্রায় ৭০ হাজার মানুষের নগরী ছিল। যুদ্ধ নাগরিক জীবনকে রক্তাক্ত করেছে।