এই মাত্রার ব্যয় সংকোচনে সরকারি কাজকর্ম ব্যাহত হয় কি না কিংবা বড় ধরনের জনপ্রতিরোধের জন্ম দেয় কি না তা নিয়ে সংশয়ী অনেক বিশেষজ্ঞ।
Published : 14 Nov 2024, 01:17 PM
নিউ ইয়র্কে ডনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচারে গেল মাসে ধনকুবের ইলন মাস্ক বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অপচয় থামানো গেলে ‘অন্তত ২ ট্রিলিয়ন ডলার’ বাঁচানো সম্ভব।
টেসলা ও সোশাল মিডিয়া এক্স’ এর কর্ণধারকে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ ট্রাম্প করে দিয়েছেন ভোটে জয় পাওয়ার পরপরই। ‘সরকারি দক্ষতা বিভাগ’ নামে নতুন একটি বিভাগ তৈরি করে এর সহপ্রধান হিসেবে মাস্ককে নিয়োগ দিয়েছেন ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, সবশেষ অর্থবছরে (অক্টোবর ’২৩-সেপ্টেম্বর ‘২৪) সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৬ দশমিক ৭৫ ট্রিলিয়ন ডলার। তার মানে মাস্ক যে ২ ট্রিলিয়ন ডলার কাটছাঁটের কথা বলছেন, সেটি ফেডারেল সরকারের ব্যয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ।
কিন্তু কীভাবে এটির বাস্তবায়ন সম্ভব?
এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য মোট ব্যয়ের খাতওয়ারি তথ্য কাজে দিতে পারে।
বিবিসি লিখেছে, কেবল সরকারি ঋণের সুদ বাবদই ব্যয় হয় প্রায় ৮৮০ বিলিয়ন ডলার (মোট ব্যয়ের ১৩%)। তার মানে খেলাপি হওয়া ছাড়া এই খাতে ব্যয় কমানোর সুযোগ নেই যুক্তরাষ্ট্রের।
অবসরভোগী আমেরিকানদের জন্য যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আছে, তাতে ব্যয় হয় প্রায় ১ দশমিক ৪৬ ট্রিলিয়ন ডলার (২২%)। খরচের এই খাতকে ‘আবশ্যিক’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কারণ তার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
ব্যয়ের আরেকটি বড় খাত হচ্ছে মেডিকেয়ার; সরকারি তহবিলে পরিচালিত এ স্বাস্থ্য ইন্সুরেন্স কর্মসূচির উপকারভোগী ৬৫ ঊর্ধ্বরা।
ব্যয়ের কথিত ‘ঐচ্ছিক’ কিছু খাত আছে, যেগুলোকে আইনগতভাবে স্থায়ী রূপ দেওয়া হয়নি; তবে সেই ব্যয়ের বিষয়ে আইন প্রণেতাদের প্রতি বছর ভোট দিতে হয়।
এর মধ্যে আছে প্রতিরক্ষা (৮৭৪ বিলিয়ন ডলার, ১৩%), পরিবহন (১৩৭ বিলিয়ন, ২%) এবং শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান ও সামাজিক সেবা খাত (৩০৫ বিলিয়ন ডলার, ৫%)।
কংগ্রেশনাল বাজেট দপ্তর বলছে, সবমিলিয়ে ২০২৩ অর্থবছরে এই বিবেচনামূলক খরচের পরিমাণ মোট ব্যয়ের ২৫ শতাংশ। আর ‘ঐচ্ছিক’ খাতের অর্ধেকেরও বেশি অর্থ যায় প্রতিরক্ষায়।
বিবিসি লিখেছে, তত্ত্বীয়ভাবে আসন্ন ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য আবশ্যিক ব্যয়ের চেয়ে ঐচ্ছিক ব্যয় কাটছাঁট করাই সহজ হবে।
ডনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, সরকারি দক্ষতা বিভাগের সহ-প্রধান মাস্ক ও বিবেক রামস্বামী সরকারি আমলাতন্ত্র ভেঙে, অদরকারি বিধিবিধান কমিয়ে এবং সরকারি সংস্থাগুলো পুনর্গঠনের মাধ্যমে খরচ কমাবেন।
২০২৩ সালে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মাস্ক বলেছিলেন, ২০২২ সালে সোশাল মিডিয়া টুইটার (এক্স) অধিগ্রহণের পর কর্মী সংখ্যা ৮০০০ থেকে কমিয়ে ১৫০০ করা হয়েছে।
মাস্ক যে ২ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় কমানোর কথা বলছেন, তার পুরোটাই যদি ঐচ্ছিক খাতে বাস্তবায়ন করা হয়, সেক্ষেত্রে পরিবহন, কৃষি থেকে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি-সব খাতই পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হবে। ২০২৩ অর্থবছরে ঐচ্ছিক খাতে মোট ব্যয়ই ছিল ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার।
বিবিসি লিখেছে, মাস্ক স্পষ্ট করে বলেননি যে এক বছরে নাকি দীর্ঘ সময়ে ২ ট্রিলিয়ন ডলার কাটছাঁটের লক্ষ্য তার। তবে এই মাত্রার ব্যয় সংকোচনে অদূর ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কাজকর্ম ব্যাহত হয় কি না কিংবা বড় ধরনের জনপ্রতিরোধের জন্ম দেয় কি না তা নিয়ে সংশয়ী অনেক মার্কিন জন-অর্থায়ন বিশেষজ্ঞ, এমনকি মার্কিন সরকারের ব্যয় হ্রাসের পক্ষের বিশেষজ্ঞরাও।
২০২২ সালে হাউজ অব রিপ্রেজেন্টিভের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর রিপাবলিকানরা ঐচ্ছিক খাতে ১৩০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় কমানো উদ্যোগ নেন। তবে অন্যান্য রিপাবলিকানদের বাধার মুখে বিলটি পাস করাতে গিয়ে তাদের হিমশিম খেতে হয়।
বিবিসি লিখেছে, এটিও লক্ষ্যণীয় যে- ডনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক সুরক্ষার আয়কর তুলে দিয়ে কর্মসূচিটিকে আর্থিকভাবে আরও উদার করবেন বলে প্রচার চালিয়েছেন। সেই সঙ্গে প্রতিরক্ষা বিষয়ে ট্রাম্প বলেছেন, তিনি আমেরিকার চারপাশে একটি ‘আয়রন ডোম ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ঢাল' তৈরি করবেন। তার মানে এই খাতে তিনি আরও বেশি ব্যয় করতে যাচ্ছেন, কাটছাঁট নয়।
মার্কিন ট্রেজারি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ২৩ শতাংশ খরচ করেছে ফেডারেল সরকার। অবশ্য অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় এই খরচকে কমই বিবেচনা করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব স্কুলের খরচ বহন করা হয় সরকারিভাবে, তবে সেটি করে থাকে রাজ্য প্রশাসন। আর এই রাজ্যগুলো আয় করে থাকে স্থানীয় বিক্রিবাট্টা ও সম্পত্তির শুল্ক থেকে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ২০২৪ সালে রাজ্যগুলোর আলাদা আলাদা ব্যয়সহ যুক্তরাষ্ট্রে ‘সরকারের সাধারণ খরচ’ দাঁড়াতে পারে জিডিপির ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ। যুক্তরাজ্যে এই হার ৪৩ শতাংশ, জার্মানিতে ৪৮ শতাংশ এবং ফ্রান্সে ৫৭ শতাংশ।
মার্কিন সরকার বর্তমানে ব্যয় এবং রাজস্বের মধ্যে যে ঘাটতিতে আছে, তা দেশটির অর্থনীতির প্রায় ৬ শতাংশের সমান। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণ দেশটির অর্থনীতির প্রায় ৯৭ শতাংশের সমান।
এটি আগামী ২০৩৫ সালের মধ্যে ১২৫ শতাংশে উন্নীত হবে হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে কমিটি ফর এ রেসপনসিবল ফেডারেল বাজেট (সিআরএফবি)।
নির্দলীয় গবেষণা সংস্থাটির প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, বড় অংকের ব্যয় না কমিয়ে ডনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক ছাড় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে আগামী দশকে ঘাটতির পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে। তাতে পরবর্তী দশকের মাঝামাঝি নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের পরিমাণ তার অর্থনীতির তুলনায় ১৪৩ শতাংশ হবে।