থাইল্যান্ডে ডে কেয়ারে হত্যাযজ্ঞ: খেলনা আঁকড়ে কাঁদছে স্বজন

নিহত বেশিরভাগ শিশুরই মৃত্যু হয়েছে ছুরিকাঘাতে, প্রাপ্তবয়স্করা মরেছে গুলিতে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Oct 2022, 10:29 AM
Updated : 7 Oct 2022, 10:29 AM

থাইল্যান্ডকে স্তব্ধ করে দেওয়া ছুরি ও বন্দুক হামলার পরদিন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার তাণ্ডবের সাক্ষী হওয়া সেই ডে কেয়ার সেন্টারেই নিহত শিশুদের খেলনা নিয়ে হাজির হন ক্রন্দনরত, হতভম্ব স্বজনরা।

বৃহস্পতিবার ব্যাংককের ৫০০ কিলোমিটার উত্তরপূর্বে অবস্থিত উথাই সাওয়ান শহরের এ ডে কেয়ার সেন্টারে স্মরণকালের অন্যতম ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ২৩ শিশুসহ ৩৭ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়।

নির্মম এই ঘটনায় শোক জানাতে শুক্রবার থাইল্যান্ডের সরকারি ভবনগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত হয়ে আছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থ রয়টার্স।

ডে কেয়ার সেন্টারটির এক তলা গোলাপী রঙের ভবনের চারপাশে বাগান আর ছোট ছোট পাম গাছ।

একের পর একজনকে ছুরি মেরে, গুলি চালিয়ে বৃহস্পতিবার সুন্দর, স্নিগ্ধ ওই স্থানটিকে মৃতদেহ, মৃত্যু পথযাত্রী আর আহতদের দিয়ে ভরিয়ে সাবেক ওই পুলিশ কর্মকর্তা বাড়ি ফেরেন; এরপর নিজের স্ত্রী সন্তানকে গুলি করে অস্ত্র ঘোরান নিজের দিকে, করেন আত্মহত্যা।

পুলিশ পরে জানায়, ডে কেয়ার সেন্টারে নিহত বেশিরভাগ শিশুরই মৃত্যু হয়েছে ছুরিকাঘাতে, প্রাপ্তবয়স্করা মরেছে গুলিতে।

এক খুনির হামলায় এত শিশুর মৃত্যু সাম্প্রতিক ইতিহাসে আর দেখা যায়নি।

তার হত্যালীলায় প্রাণ যাওয়া ৩ বছর বয়সী তেচিনের ফুপু শুক্রবার ডে কেয়ার সেন্টারটিতে এসেছিলেন ভাইপোর স্টাফড কুকুর আর খেলনা ট্রাক্টর নিয়ে। কোলে খেলনাগুলো রেখে মনে করছিলেন বৃহস্পতিবারের কথা, যখন হামলার খবর পেয়ে দ্রুত ডে কেয়ার সেন্টারে ছুটে এসেছিলেন তিনি।

“এসে দেখি স্কুলের সামনে দুটি মৃতদেহ, সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে যাই, আমার বাচ্চাটাও মারা গেছে,” বলেন ৪০ বছর বয়সী সুয়িমন সুদফানপাক; তেচিনের বাবা-মা ব্যাংককে কাজ করায় ভাইপোকে তারই দেখাশোনা করা লাগতো।

কেবল তেচিনই নয়, বৃহস্পতিবার হত্যার শিকার হওয়া শিশুদের মধ্যে নিটোল গালের ২ বছর বয়সী কৃতসানা সোলাও আছে, যে ডাইনোসর আর ফুটবল খুব ভালোবাসতো, তার ডাকনামও ছিল ‘ক্যাপ্টেন’।

মাত্রই চুলের নতুন কাট দিয়েছিল সে, গর্বের সঙ্গে সবাইকে তা দেখাচ্ছিলও, বলেছেন সোলার ২৭ বছর বয়সী খালা নালিয়ান দুয়াংকেট।

শুক্রবার থাই প্রধানমন্ত্রী প্রায়ূথ চান ওচা ডে কেয়ার এলাকাটি পরিদর্শনে যাবেন বলে জানা গেছে। রাজা মাহা ভাজিরালংকর্ন এবং রানি সুথিদারও হতাহতদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করার কথা রয়েছে।

পুলিশ বলছে, বৃহস্পতিবার ডে কেয়ার সেন্টারে হামলা চালানো ব্যক্তি ৩৪ বছর বয়সী পানিয়া কামরাপ পুলিশেরই সার্জেন্ট পদে ছিলেন। মাদক সংক্রান্ত অভিযোগে তিনি চাকরি খোয়ান।

তার বিরুদ্ধে আদালতে মাদকের মামলা চলছিল; ডে কেয়ার সেন্টারে হামলার কয়েক ঘণ্টা আগেও তিনি মামলার শুনানিতে উপস্থিত হয়েছিলেন বলে জানিয়েছে থাই পুলিশ।

শুনানি শেষে ছেলেকে আনতে ওই ডে কেয়ার সেন্টারে যান পানিয়া, ছেলেকে খুঁজে না পেয়ে তিনি শিশু, প্রাপ্তবয়স্কদের হত্যা করা শুরু করেন, সম্প্রচারমাধ্যম থাইপিবিএসকে এমনটাই বলেছেন পুলিশের মুখপাত্র পাইসাল লুসোমবুন।

“তিনি গুলি করে, ছুরি মেরে শিশুদের হত্যা করা শুরু করেন,” বলেন পাইসল।

স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা চক্রপত উইচিতভাইদিয়া বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, শিশুদেরকে বড় ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে, কখনো কখনও একাধিকবারও, আর প্রাপ্তবয়স্কদের গুলি করা হয়েছে বলে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেখাচ্ছে।

হামলার মোটিভ কী ছিল, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

পানিয়া মাসসিক চাপ থেকেই এই কাণ্ড করতে পারেন বলে অনেকেই সন্দেহ করছেন।

“আমি জানি না কেন সে এমনটা করেছে, তবে সে অনেক চাপে ছিল,” ছেলের মাদকাসক্তি ও ঋণের চাপে জর্জরিত হওয়ার কথা জানিয়ে ন্যাশন টিভিকে বলেন পানিয়ার মা। 

উদ্ধারকারী দল তাদের তোলা যেসব ছবি রয়টার্সকে দিয়েছে সেখানে কম্বলে শায়িত ছোট ছোট মৃতদেহ এবং মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা জুসের বাক্স দেখা গেছে।

“হামলাকারী আমার দিকে তেড়ে এসেছিলেন, আমি তখন আমাকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করি, বুঝতে পারছিলাম না কী করব। হামলাকারী কিছুই বলেননি। বাচ্চারা ঘুমিয়ে থাকার সময় তিনি দরজায় গুলি করেন,” কান্না চেপে ধরে থাইপিবিএসকে এমনটাই বলেন এক হতভম্ব নারী।

Also Read: থাইল্যান্ডের বন্দুক আইন ও গুলির যত ঘটনা

বৃহস্পতিবার হামলার সময় ওই ডে কেয়ার সেন্টারটিতে ৩০ এর মতো শিশু ছিল। সাধারণত ওই সময়ে সেখানে আরও বেশি শিশু থাকে, কিন্তু তুমুল বৃষ্টির কারণে সেদিন সেন্টারটিতে শিশুদের উপস্থিতি ছিল অনেক কম।

থাইল্যান্ডে বন্দুক আইন বেশ কঠোর। দেশটিতে অবৈধভাবে আগ্নেয়াস্ত্র বহন করলে ১০ বছরের জেল এবং ২০ হাজার ভাট (৫৩৬ ডলার) পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। তবে থাইল্যান্ডে বন্দুকের মালিকানা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় বেশি।

অবৈধ অস্ত্র, যেগুলো বেশিরভাগই সংঘাতপূর্ণ দেশ থেকে কেনা হয়, সেগুলো থাইল্যান্ডে সহজলভ্য হলেও গণহারে গুলি করে মানুষ মারার ঘটনা বিরল।